ঢাবি কুইজ সোসাইটির সভাপতির নারী কেলেংকারী

বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে আসার পর একজন শিক্ষার্থী শুধু ক্লাস আর পাঠ্যবই থেকেই জ্ঞান অর্জন করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষকদের মুখে প্রায় শোনা যায়, ‘অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে একজন শিক্ষার্থী যা শিখতে পারে না এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে কিছুদিন নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করো, তাহলে আরও বেশি কিছু শিখতে পারবে।’

তাহলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে এখানকার শিক্ষার্থীদের আলাদা করে সে বিষয়টা কি? সেটা হলো এখানকার সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের ক্লাবগুলোতে অংশগ্রহণের অবারিত সুযোগ। কিন্তু সহশিক্ষার এসব ক্লাবগুলোতে ছাত্ররা যে পরিমাণ অংশ নিচ্ছে, ছাত্রীরা অংশগ্রহণের সে পরিবেশ পাচ্ছে কেন পাচ্ছে না এমনই প্রশ্ন অনেকের।

ঢাবিতে সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে এমন একটি সংগঠনের নাম ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি কুইজ সোসাইটি’। প্রতিষ্ঠা লগ্নে সংগঠনটিতে ছাত্র-ছাত্রীরা সমানভাবে অংশ নিলেও সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রীরা আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে এমন দাবি করলেন সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত কয়েকজন শিক্ষার্থী।

কুইজ সোসাইটিতে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের অংশগ্রহণের হার কেন কমে গেছে একটি সাধারণ সভার বৈঠকে সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে এমন প্রশ্ন ছিল সাধারণ সদস্যদের। তবে এ প্রশ্নের উত্তর সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক কাউকে দিতে হয়নি। উত্তর দিয়েছেন খোদ সেখানে উপস্থিত এক ছাত্রী। ওই সভায় এ ছাত্রী বলেন, ‘এখানে ছাত্রীদের উপস্থিতি কমে যাওয়ার কারণ হলো সংগঠনের সভাপতির ‘ক্যারেক্টার’ ভালো না।’ ওদিন একথা বলে বেরিয়ে যান তিনি। আর কোন দিন আসেননি কুইজ সোসাইটিতে।

কুউজ সোসাইটির সভাপতির বিরুদ্ধে একজন সদস্য অভিযোগ আনেন, সংগঠনের কাজের বাইরে রাতে মেয়েদের মোবাইল করে ও মেসেঞ্জারে নক দিয়ে ‘অযাচিত’ কথা জানতে চান তিনি। রাত ১২টা, ১টা এমনকি ২টার সময়ও ‘বিএফ আছে’ বলা সত্ত্বেও প্রেম নিবেদন করেন তিনি। সাধারণ সম্পাদকের কাছে এ অভিযোগ করলে তিনি সভাপতিকে সংশ্লিষ্ট ছাত্রী হলে আর কোনরকম মিটিং বা কার্যক্রমে না যেতে বলেন।

অভিযুক্ত কুইজ সোসাইটির সভাপতির নাম রাকিব হাসান। তিনি সমাজকল্যাণ ইনিস্টিটিউটের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্যসেন হলে।

সংগঠনের আরেক জন সদস্যও একই অভিযোগ করেছেন। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সে আমাকে মোবাইল করে ও মেসেঞ্জারে জিজ্ঞাস করে আমি প্রেম করি কিনা, বিএফ আছে কিনা। আমার বিএফ আছে বলা স্বত্বেও সে বিভিন্নভাবে আমাকে বিরক্ত করে। বিএফের বাড়ী কোথায়, কোথায় পড়ে এসব জানতে চায়। তাকে আমার বিএফের বাড়ী ও কলেজের নাম বললে বলে ওই এলাকার লোকজন ভালো না। ওই কলেজের ছেলের সাথে কেন প্রেম করো। আমার সাথে প্রেম করো এসব।’

ওই ছাত্রী আরও বলেন, ‘তিনি সবসময় এরকম দেখাতে চেষ্টা করেন যেন তিনি সবকিছুর প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি অনেক সাইকোলজির বই পড়েছেন। যাতে মানুষের সাইকোলজি বুঝতে পারেন। তাই তার কাছে সব শেয়ার করতে বলেন তিনি।’

তিনি বলেন, ‘বিএফের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে তার (স্বামী) সাথেও ফেসবুকে এড হয়। আমাদের পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে। যার কারণে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা হচ্ছে।’

কয়েকজন ছাত্রী শুধু তাদের সাথে নয় আরও অনেক মেয়ের সাথে অভিযুক্ত রাকিব এ ধরণের আচরণ করেছে বলেও অভিযোগ আনেন।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কুইজ সোসাইটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ১ বছর পর নির্বাচন দেয়ার কথা থাকলেও নিদিষ্ট সময়ের আরও ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও কমিটি দেননি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এনিয়ে ইতোমধ্যেই কুইজ সোসাইটির মধ্যে গ্রুপিং তৈরি হয়েছে বলে জানালেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র কয়েকজন শিক্ষার্থী।

কুইজ সোসাইটির সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন অযুহাতে ৩ মাস সময় বাড়িয়ে নেন তারা। কিন্তু বর্ধিত সময়সহ ৯ মাস অতিক্রম করতে চললেও এখনও কমিটি দিচ্ছেন না তারা।

সিভি নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ: সংগঠনটির পদপ্রত্যাশী কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষার্থীর অভিযোগ, সংগঠনে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছেন এমন শিক্ষার্থীরা কমিটি দিতে বললে তিনি সবাইকে সিভি জমা দিতে বলেন। এরপর সিভি জমা দিয়েছেন এমন সিনিয়রদের বাদ দিয়ে নিজ হল থেকে জুনিয়রদের নিয়ে এসে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এনিয়ে ক্ষুব্ধ সিনিয়র নেতারা।

ডিভাইডেশন: সদস্যদের অভিযোগ, রাকিব পুরো সংগঠনকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছেন। যারা কমিটির দাবি করেছেন, তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের নিয়ে তিনি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। রাকিবের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন সংগঠনটির জসিম উদ্দিন হল, বিজয় একাত্তর হল, বঙ্গবন্ধু হলসহ কয়েকটি হলের নেতারা।

অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতা: এদিকে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে অর্থনৈতিক কোন হিসাব নিকাশ কারো কাছে পেশ করেননি বলে জানান অন্য নেতারা। সংগঠনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা বড় অংকের টাকা ও স্পন্সরবাবদ টাকা পেলেও তার খরচ নিয়ে অসচ্ছতার অভিযোগ আছে।

সংগঠনটির সহ-সভাপতি মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে আরও দীর্ঘসময় পার হয়ে গেলেও কমিটি দেয়া হয়নি। বিষয়টা নিয়ে কয়েকবার দাবী করা হলেও তারা সেটা আমলে নেয়নি। আমরা এ বিষয়ে সাবেক সভাপতি সাধারণ সম্পাদকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা বর্তমান দায়িত্বশীলদের এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলেন। তবু তারা কোন উদ্যোগ নেয়নি। পরে আমরা বেশ কয়েকজন হতাশ হয়ে একেবারে চলে এসেছি। এছাড়া এ কমিটি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আমাদের সাথে নিয়ে কোন ফাইনান্সিয়াল মিটিং ডাকা হয়নি।

সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আলমাস বলেন, আমরা বারবার বলার পরও নতুন কমিটি দেয়া হয়নি। তাদের কারণেই সংগঠনে বিভক্তি তৈরি হয়েছে এবং অনেক দায়িত্বশীল ও সিনিয়র সদস্য মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন

এ বিষয়ে অভিযুক্ত রাকিব বলেন, বিষয়গুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। স্যারদের সাথে কথা বলে আমরা এর সমাধান করবো। আর নারী কেলেংকারীর যেসব বিষয়গুলো বলা হচ্ছে তার কোন সত্যতা নাই।

সংগঠনটির মডারেটর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ কে এম ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, ‘যারা অভিযোগ এনেছে তারা যদি লিখিত অভিযোগ দেয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রক্টরিয়াল বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে।’


সর্বশেষ সংবাদ