বিবিসির অনুসন্ধান
চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি কী?
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৭ AM , আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৯ AM
সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরে যাওয়ার বয়স বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে দীর্ঘদিন। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে আবারও আলোচনা তৈরি হয়েছে। চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ ও অবসরের বয়স ৬৫ বছর করতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ গত ৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আবেদন করেছে। বিষয়টি যেহেতু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিধির আওতার মধ্যে পড়ে, তাই গত ১৮ সেপ্টেম্বর সেই চিঠি বা প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
অনেকে মনে করছেন, ওই চিঠির প্রেক্ষিতে বয়সসীমা উভয়দিক থেকেই বৃদ্ধি হতে পারে। সেক্ষেত্রে এ প্রশ্নটি সামনে আসছে যে, বয়সসীমা বাড়ানো সংক্রান্ত নতুন প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে সেটি কি রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সাথে মিলে আরও বোঝা তৈরি করবে? বয়সসীমা বাড়ানোর যৌক্তিকতাও বা কতটা, সেটি নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন।
বয়সসীমা বাড়ানোর যুক্তি কী?
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর, আর অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা ৫৯ বছর। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীদের ক্ষেত্রে প্রবেশের বয়স ৩২ ও অবসরে যাওয়ার বয়স ৬০ বছর নির্ধারণ করা আছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রেই বয়সসীমা বেশি না, বিশেষ কিছু পেশার ক্ষেত্রেও অবসরের বয়সসীমা বেশি। আর এখানেই বৈষম্য খুঁজে পাচ্ছে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
যেমন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক (অবসর গ্রহণ) আইন, ২০১২’ অনুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর। সংবিধানের ৯৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৭ বছর। সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন সময় যেসব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকের অবসরের বয়স ৬৭ বছরের বেশি বলে সংগঠনটি তাদের চিঠিতে জানিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত বছরের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক তিন বছর, যা আজ থেকে দুই দশক আগের তুলনায় বেশি। যারা দাবি তুলে ধরছেন তারা মনে করেন, জীবনকালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চাকরির বয়সসীমা নির্ধারণ করা উচিৎ। সংগঠনের সভাপতি মো. আনোয়ার উল্লাহ বলেছেন, ‘গড় আয়ু যেহেতু বেড়েছে, সেক্ষেত্রে অবসরের বয়স না বাড়ালে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয় থেকে যাচ্ছে।’
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর, আর অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা ৫৯ বছর। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীদের ক্ষেত্রে প্রবেশের বয়স ৩২ ও অবসরে যাওয়ার বয়স ৬০ বছর নির্ধারণ করা আছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রেই বয়সসীমা বেশি না, বিশেষ কিছু পেশার ক্ষেত্রেও অবসরের বয়সসীমা বেশি। আর এখানেই বৈষম্য খুঁজে পাচ্ছে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
যদিও তার বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারের অনেক কর্মী একযোগে পদোন্নতি পেয়েছেন। এর অন্যতম কারণ, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অনেকে নিয়মিত পদোন্নতি পাননি। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বঞ্চিত থাকা চাকরিজীবীদের ক্ষতিপূরণ করার জন্য বয়সসীমা বৃদ্ধির এ দাবি জানানো হচ্ছে কি না জানতে চাওয়া হয়েছিল আনোয়ার উল্লাহ’র কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা মনে করার কারণ নেই যে বঞ্চিতদের সুযোগ দেওয়ার জন্য এটা হচ্ছে। কারণ যাদের পদোন্নতি হচ্ছে, তাদের বেতন বাড়বে না খুব বেশি। শুধু কর্মকাল বাড়বে।’ তিনি যদিও বলছেন, চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি করলে বেতন-ভাতা বা খরচ খুব বেশি বাড়বে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বয়সসীমা বাড়ালে সরকারের ব্যয় তো বাড়বেই। সেই সাথে প্রশাসনের কার্যক্রমেও অনেক জটিলতা তৈরি হতে পারে। যারা বছরের পর বছর চেষ্টা করেও সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে পারেননি বা যাদের বয়সসীমা প্রায় শেষের দিকে বা রাজনৈতিক কারণে যারা চাকরির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, বয়সসীমা বাড়ানোটা আপাতদৃষ্টিতে তাদের জন্য একটা সুযোগ।
কিন্তু যারা নতুন করে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেবে, তারা অসম প্রতিযোগিতার মাঝে পড়ে যাবে। অর্থনৈতিকভাবেও সরকারকে ‘দীর্ঘমেয়াদে চাপের মুখে পড়তে হবে’ বলে মনে করছেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি’র ডিস্টিংগুইশড ফেলো অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর ইমিডিয়েট এবং মিডিয়াম লং টার্ম ইফেক্ট আছে। অবসরের সময় বাড়ালে পেনশনের চাপটা বিলম্বিত হবে। কিন্তু যখন দিতে হবে, তখন আরও বেশি দিতে হবে।
বাংলাদেশের বাজেটের বড় অংশ ব্যয় হয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৭ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর প্রস্তাব মেনে নিলে সরকারকে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি সংক্রান্ত আরেকটি জটিলতার জায়গা হলো বেকারত্ব।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে, বাংলাদেশে এখন বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। যদিও বাস্তবে সংখ্যাটা আরও বেশি বলে মত অর্থনীতিবিদদের। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্যানুযায়ী, দেশে বেকারত্বের হার তিন দশমিক ছয় শতাংশ। এর মধ্যে যুব বেকারত্বই ৮০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের তরুণদের সরকারি চাকরির প্রতি ঝোঁক এখন বেশি। চাকরিতে প্রবেশের বয়স আরও বৃদ্ধি করা হলে বিশাল কর্মক্ষম তরুণদের অনেকে ‘একদিন না একদিন সরকারি চাকরি হবে’ আশায় শেষ পর্যন্ত চাকরির প্রস্তুতি নেবে। ফলে দীর্ঘসময় পর্যন্ত তরুণদেরকে কাজে লাগানো যাবে না বিধায় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যদিও অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান এও মনে করেন, ‘সবাই সরকারি চাকরির আশায় বসে থাকে না। একটা চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চাকরি না হলে তারা অন্য কোথাও হয়তো কাজ করে।’
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান মনে করেন, বয়সসীমা বাড়ানোটা যৌক্তিক না। কারণ গত ১০ বছর ধরে সেশনজটের ঝামেলা না থাকায় একজন শিক্ষার্থী নিয়মিত পড়াশুনা করলে ৩০ বছর পর্যন্ত অন্তত সাত বার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায়। যদি দুই বছরেও একটি পরীক্ষা হয়, তাও দুই থেকে তিনবার সে সুযোগ পাচ্ছে। তারপরও বেশ কিছুদিন ধরে এই আন্দোলন কেন চলছে, তা জানি না।
বয়সসীমার একদম শেষ প্রান্তে এসে চাকরিতে প্রবেশকারীরা তরুণ চাকরিজীবীদের সাথে কতটা খাপ খাইয়ে চলতে পারবেন, সেটি নিয়েও ভাবনার বিষয় আছে। তিনি বলছিলেন, ‘ইয়াং, এনার্জেটিক, ফ্রেশ গ্রাজুয়েট হিসাবে যখন আপনি চাকরিতে জয়েন করেন, তখন আপনি যে পরিমাণ কাজ করতে পারবেন, তা আপনি ৩৫ বছর বয়সে করতে পারবেন না।একজন অ্যাপ্রেন্টিসকে কি আপনি ৩৫ বছর বয়সে নেবেন?’
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা শুধু নয়, অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি নিয়েও আপত্তি করেন আবু আলম শহীদ খান। সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬৫ বছর করার দাবিকে ‘মজার জিনিস’ হিসাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা বাড়ালে সরকারি চাকরিতে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হবে।’
চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের বরাতে একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, দেশে বর্তমানে সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদ আছে ১৯ লাখ ১৫১টি। এর মধ্যে শূন্য আছে তিন লাখ ৭০ হাজার ৪৪৭টি। সেক্ষেত্রে দেশে যে পরিমাণ সরকারি চাকরিজীবী আছে, সেখান থেকে ৬০-৭০ হাজার প্রতিবছর অবসরে যায়। কিন্তু যদি অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হয়, তখন তারা অবসরে যাবেন না।
আরো পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানেই শিক্ষাবিদ বা শিক্ষা বিশেষজ্ঞ নয়
এখন যখন পুরাতনরা অবসরে যাবেন না, তখন ধীরে ধীরে চাকরিপ্রত্যাশীদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান এটিকেই ‘অসম প্রতিযোগিতা’ বলছেন। আবু আলম শহীদ খান বলেন, নতুনদের জন্য তখন নতুন পদ সৃষ্টি করতে হবে। এমনিতেই দেশে সরকার বেশি বড় হয়ে গেছে। তার মাঝে আরও যদি বাড়িয়ে দিই, তখন সরকার আরও বড় হবে।’
বয়সসীমা যদি বাড়াতেই হয়, তবে দু’দিক থেকেই বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। কারণ চাকরিতে যোগদানের পর একজন কর্মীর দক্ষ হয়ে ওঠার জন্য সময় প্রয়োজন। সেইসাথে প্রায় শতভাগ পেনশন পাওয়ার জন্য ২৫ বছর চাকরি করা লাগে। যারা দেরি করে চাকরিতে প্রবেশ করেন, তারা এই সুবিধাটা সম্পূর্ণভাবে পান না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের দাবির বিষয়ে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করছে, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’র আনোয়ার উল্লাহও বয়সসীমা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘কেউ যদি ৩৩ বছর বয়সে গিয়ে চাকরিতে ইন করে, তাহলে তার জন্যও একটি এক্সিট রাখতে হবে।’
আগেও বাড়ানো হয়েছে বয়স
আগে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর ও অবসরের বয়স ছিল ৫৭ বছর। ১৯৯১ সালে অবসরের বয়সীমা না বাড়ানো হলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়। এরপর ২০১১ সালে অবসরের বয়স বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়। সে সময় অবসরের বয়স বাড়ানোর পরের বছর ফের চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করে চাকরিপ্রত্যাশীরা। কিন্তু তৎকালীন সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।
২০১৯ সালেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা প্রসঙ্গে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি তখন বলেছিলেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা হলে ‘করুণ অবস্থা হবে’। তার যুক্তি ছিল, ৩৫ বছরের পর চাকরির পরীক্ষা দিলে রেজাল্ট, ট্রেনিং শেষ করে যোগ দিতে দিতে ৩৭ বছর লাগে। ‘একটা সরকার তাহলে কাদের দিয়ে চালাব?
সর্বশেষ গত মে মাসেও বয়স বাড়ানো নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলো চাকরিপ্রত্যাশীরা। সরকারি চাকরিজীবীদের সংগঠনের সভাপতি আনোয়ার উল্লাহ এও বলেছেন, তারা তাদের জায়গা থেকে সরকারের কাছে বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি করতেই পারেন। কিন্তু সরকার যদি মনে করে, তবে ৩২ থেকে ৩৩ করতে পারে। ওদিকে ৬০ থেকে ৬১ বছর।