তিন সদস্য নিয়োগ নিয়ে পিএসসি’র ভেতর-বাইরে তুলকালাম
- শিহাব উদ্দিন
- প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩৯ AM , আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:১২ AM
পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) সদ্য নিয়োগ পাওয়া তিন সদস্যকে নিয়ে কমিশনের ভেতর এবং বাইরে তুলকালাম শুরু হয়েছে। এই তিন সদস্য ‘পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের’ সুবিধাভোগী উল্লেখ করে তাদের অব্যাহতির দাবি তুলেছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। এমনকি এই তিনজনের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পিএসসির কর্মকর্তারাও। গত রবিবার নতুন সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান হওয়ার কথা থাকলেও সব মহল থেকে আপত্তি উঠায় শপথ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) তাদের শপথ হওয়ার কথা থাকলেও তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
অব্যাহতির দাবি ওঠা তিন সদস্য হলেন- ডা. সৈয়দা শাহিনা সোবহান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ এফ জগলুল আহমেদ এবং ড. মো. মিজানুর রহমান। গত ২ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চুক্তি ও বৈদেশিক শাখা থেকে তাদের নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ এফ জগলুল আহমেদ ডিজিএফআইয়ের সাবেক ডিজি ছিলেন। ২০১৪-২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় ‘আয়নাঘরে’ অনেকেই বন্দি ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের পিএসসিতে নিয়োগ দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চুক্তি ও বৈদেশিক নিয়োগ শাখার উপসচিব আবুল হায়াত মো. রফিক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘পিএসসিতে সদস্য নিয়োগ হয় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে। নিয়োগের অনুমোদন হওয়ার পর আমরা কেবল ওয়েবসাইটে প্রজ্ঞাপন আপলোড করি। কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হয়, এটি সরকার বলতে পারবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সদ্য পিএসসি’র সদস্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ডা. শাহীনা সোবহানের বাবা জামালপুর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া ডা. শাহীনা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির বান্ধবী। অভিযোগ রয়েছে, ডা. শাহীনা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নানা সুবিধা ভোগ করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: পিএসসিতে ‘নাশকতা’ করতে গিয়ে যুবক আটক
অন্যদিকে ড. মো. মিজানুর বিসিএস ৮৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগের সময়ে বিয়াম ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিয়াম ফাউন্ডেশনকে প্রশাসন ক্যাডারদের ‘কেন্দ্রবিন্দু’ ধরা হয়ে থাকে।
এছাড়া ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ এফ জগলুল আহমেদ ডিজিএফআইয়ের সাবেক ডিজি ছিলেন। ২০১৪-২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় ‘আয়নাঘরে’ অনেকেই বন্দি ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
যদিও নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ এফ জগলুল আহমেদ। তার দাবি, ‘আওয়ামী লীগের আমলে তিনি কোনো সুবিধা নেননি। এমনকি ডিজিএফআইএর মহাপরিচালক থাকাকালীন আয়নাঘরের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। অভিযোগগুলো মিথ্যা বলে তিনি দাবি করেন।’ অভিযোগের বিষয়ে অন্য দুই সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
‘যাদের কারণে দেশের হাজার হাজার ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছেন, তাদের সঙ্গে কাজ করা কঠিন। পিএসসিতে বর্তমানে যে সদস্যরা রয়েছেন, তারা আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধা নেওয়া নতুন তিন কর্মকর্তার সঙ্গে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেছেন।—পিএসসির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা
আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী এই তিন সদস্যকে পিএসসিতে নিয়োগ দেওয়ার পর থেকেই শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থীদের পাশাপাশি পিএসসি’র ভেতরেও সমালোচনার ঝড় বইছে। পিএসসির একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন আওয়ামীপন্থীদের পিএসসিতে নিয়োগ দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। এর ফলে ছাত্র-জনতার রক্তের সাথে বেঈমানি করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের নিয়োগ বাতিল করে নতুন সদস্য নিয়োগের দাবি উঠেছে পিএসসির ভেতর থেকেও।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পিএসসি’র এক কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে চাকরিপ্রার্থী থেকে শুরু করে সব মহলে সমালোচনা হয়েছে। পিএসসি’র সুনাম ফেরাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন। তবে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের সুবিধা নেওয়া ব্যক্তিদের কমিশনে সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় সেই উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে। তখন চাকরিপ্রার্থী এবং শিক্ষার্থীদের আস্থা ফেরানো কঠিন হবে।’
পিএসসি’র আরেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘যাদের কারণে দেশের হাজার হাজার ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছেন, তাদের সঙ্গে কাজ করা কঠিন। পিএসসিতে বর্তমানে যে সদস্যরা রয়েছেন, তারা আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধা নেওয়া নতুন তিন কর্মকর্তার সঙ্গে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। এই অবস্থা চলমান থাকলে পিএসসিতে স্থবিরতা তৈরি হতে পারে। অবিলম্বে সরকারের উচিত এই তিনজনের নিয়োগ প্রজ্ঞাপন বাতিল করে নতুন সদস্য নিয়োগ দেওয়া।’
এদিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ডা. সৈয়দা শাহিনা সোবহান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ এফ জগলুল আহমেদ এবং ড. মো. মিজানুর রহমানের নিয়োগ বাতিল করা না হলে আন্দোলনে নামা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের একটি অংশ।
‘৫ আগস্টের পরে আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন দলকানা আমলাদের বিভিন্ন সরকারি অফিসে পদায়ন করার মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বীজ বপন করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকলে বর্তমান সরকার সফল হতে পারবে না।’—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আলামিন মিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘১৭ বছরের আওয়ামী লীগের সহযোগী ও শেখ হাসিনার অনুগত ভোট চোরদের পিএসসির মত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়ে কি আওয়ামী লীগ/ছাত্রলীগের দলীয় ক্যাডারদের পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে? শেখ হাসিনার অনুগত আমলাদের ৫ আগস্টের পরও পিএসসিতে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে দুই হাজার শহীদ এবং ৩০ হাজারের অধিক আহতদের রক্তের সাথে বেইমানি করা হয়েছে। অবিলম্বে অভিযুক্তদের নিয়োগ বাতিল করতে হবে। তা না হলে দেশের ছাত্র সমাজকে নিয়ে আন্দোলন শুরু হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী শেখ ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘৫ আগস্টের পরে আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন দলকানা আমলাদের বিভিন্ন সরকারি অফিসে পদায়ন করার মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বীজ বপন করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকলে বর্তমান সরকার সফল হতে পারবে না। কাদের প্রেসক্রিপশনে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে আওয়ামী আমলারা নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন তা জাতির সামনে প্রকাশ করা উচিৎ।’
আরও পড়ুন: ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের সম্ভাব্য সময় জানাল পিএসসি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সঞ্জয় বলেন, ‘আওয়ামী সরকারের দোসরদের নিয়োগ অনতিবিলম্বে বাতিল করতে হবে। নতুবা এই সকল দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের নিয়োগের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করে তোলা হবে। এই আন্দোলনে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে এর দায় অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো: মোখলেস উর রহমানকে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে মুঠোফোনে মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো উত্তর মেলেনি।