কারখানা গড়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মামুন, পুলিশের গুলিতে নিভে যায় স্বপ্ন

  © সংগৃহীত

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর মিরপুর এলাকায় বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ৩৪ বছর বয়সী কর্মঠ তরুণ মামুন মিয়া। এতে ভেঙে যায় এক উদ্যমী ও স্বাপ্নিক যুবকের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা।

শৈশব থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন মামুন মিয়া। কিন্তু কখনো লক্ষ্য অর্জনে সাহস হারাননি, বরং সব সময় অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের আদম বারইপাড়া গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা মামুনকে স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করতেই অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।

১৮ বছর আগে মামুন ভাগ্য পরিবর্তন এবং পরিবারকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে রাজধানী ঢাকায় চলে যান। এখানে-সেখানে ঘুরে বিভিন্ন কাজ করার পর শেষে এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করেন মামুন। কিন্তু অচিরেই তিনি বুঝতে পারেন যে তার অল্প আয়ে পরিবারকে দারিদ্র্যমুক্ত করা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হবে না।

বছরের পর বছর প্রচেষ্টা করে মামুন কয়েক বছর আগে ঢাকা শহরে তার বন্ধু মাসুদুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুর-১ এলাকায় ‘বিসমিল্লাহ ফ্যাশন’ নামে একটি ছোট আকারের কাপড়ের কারখানা শুরু করেন।

সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিল। ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি বিয়ে করেন। স্ত্রী শারমিন আখতার লতা ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইডেন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।

লতা বর্তমানে দীন মোহাম্মদ চক্ষু হাসপাতাল ও রিসার্চ সেন্টারে কল সেন্টার এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করছেন এবং তার মায়ের সঙ্গে ধানমন্ডি এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন।

লতার বাবা লুৎফর রহমান টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার থানার পাহাড়পুর গ্রামের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি দুই বছর আগে মারা গেছেন। তার মা সুশীলা আখতার (৫০) একজন গৃহিণী।

মামুন ছিলেন চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। তার এক ভাই ও দুই বোন। মামুনের বোন নাসরিন আখতার ও অঙ্কি বেগম দুজনেরই বিয়ে হয়েছে। তারা রংপুরে স্বামীদের সঙ্গে বসবাস করেন।

ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম সবুজ (২৪) পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। মামুন কয়েক বছর আগে ছোট ভাই সবুজকে ঢাকা নিয়ে যান। তিনিও বিয়ে করেছেন এবং গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করেন।

মামুন মিয়ার বাবা আজগর আলী (৬০) রাজধানীর একটি পাইপ তৈরির ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। গত ১০ বছর ধরে তিনি পুরান ঢাকার একটি মেসে বসবাস করছিলেন। মামুনের মা তসলিমা বেগম (৫৫) গৃহিণী। আদম বারইপাড়া গ্রামে মাত্র আট শতাংশ জমিতে একটি বাড়িতে বসবাস করেন।

মামুনের বাবা আজগর আলী জানান, তিনি মামুনের লাশ নিয়ে আদম বারইপাড়া গ্রামে আসার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমি আমার প্রিয় ছেলে মামুনকে হারিয়ে শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমি ঢাকা শহরে আমার কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারছি না। আমি এখন শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছি।’

মামুনের মা তসলিমা বেগম বলেন, ‘আমি আমার ছেলে মামুনকে হারিয়েছি। আমার স্বামী মানসিকভাবে অক্ষম হয়ে গেছেন এবং কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। আমি জানি না, মামুন ছাড়া আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব।’

মামুনের ছোট ভাই সবুজ বলেন, মামুন ‘বিসমিল্লাহ ফ্যাশন’-এ ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে শার্ট, জার্সি, প্যান্ট, ট্রাউজার, শিশুদের পোশাক তৈরি করতেন এবং সেগুলো বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করতেন।

তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই মামুন নিয়মিত ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও মিটিং-মিছিলে অংশ নিতেন। ৫ আগস্ট মামুন সকালে নিজ কারখানায় গিয়ে কাজ শুরু করেন। দুপুর নাগাদ ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার পতনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মামুন কারখানা থেকে বের হয়ে ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে যোগ দেন। মামুনের সঙ্গে আমিও মিছিলে যোগ দিই এবং আগারগাঁও এলাকায় যাই। কিন্তু আমি আগারগাঁও থেকে আর সামনে যাইনি। তবে মামুন বিশাল বিজয় মিছিলের সঙ্গে এগিয়ে যান। সে সময় মিরপুর-১ গোল চত্বরে ছাত্র-জনতা ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। মিরপুর থানার সামনে পুলিশ নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও ধাতব গুলি চালায়।

আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগীরা বিজয় মিছিলে হামলা চালায় এবং পুলিশ মামুনকে গুলি করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আড়াইটার দিকে মামুনের বাম পিঠে একটি গুলি প্রবেশ করে এবং বাম বুক দিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর বিকেল সাড়ে তিনটায় ছাত্ররা তাকে মিরপুর-১০-এর আলোক হাসপাতালে নিয়ে যায়।’

কেউ একজন মামুনের মোবাইল ফোন থেকে কল দিয়ে এ খবর জানালে সবুজ ও মামুনের বন্ধু রাসেল সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে যান। আলোক হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের পরামর্শে সবুজ মামুনকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

সবুজ বলেন, ‘পথে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণের কারণে আমরা কোনো রকমে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে পৌঁছতে পারি। সেখানে বিকেল সাড়ে চারটায় ডাক্তার মামুনকে মৃত ঘোষণা করেন।’

পরে ৬ আগস্ট মামুনের লাশ তার মাতৃভূমি আদম বারইপাড়া গ্রামে নিয়ে আসা হয় এবং সকাল ১০টায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

মামুনের স্ত্রী শারমিন আখতার লতা জানান, স্বামী মামুন তাকে মে মাসে তার গ্রামের আদম বারইপাড়া নিয়ে যান, যাতে তিনি রংপুরের একটি ভালো হাসপাতালে সন্তান জন্ম দিতে পারেন।

তিনি বলেন, ‘জুলাই মাস থেকে আমি নিরীহ ছাত্রদের ওপর নির্যাতন, বিশেষ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড দেখে অসুস্থ হয়ে পড়ি। এতে আমার গর্ভের সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

পরে লতাকে আধুনিক মাল্টিকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে একটি মৃত কন্যা শিশুর জন্ম দেন।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার সন্তান জন্মের আগেই হারিয়ে গেছে। আর স্বামী মামুনকে হারানোর পর আমি সবকিছু হারিয়েছি। আমি আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই।’

এখন পর্যন্ত ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ মামুনের বাবা ও তার স্ত্রীর জন্য আড়াই লাখ টাকা করে দিয়েছে এবং জামায়াতে ইসলামী মামুনের বাবা ও লতাকে ১ লাখ টাকা করে দিয়েছে।

এ ছাড়া আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন মামুনের পিতা-মাতাকে ১ লাখ টাকা এবং পীরগাছা ইউএনও ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন।


সর্বশেষ সংবাদ