ছাত্রদলের সাংগঠনিক সফর ও এর পেছনের উদ্দেশ্য
বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে, ছাত্ররাজনীতির নামে বাংলাদেশে একটি অপরাজনীতি চালু ছিল যার অগ্রণী ভূমিকায় ছিল ছাত্রলীগ। এই ছাত্রলীগ তথা আওয়ামী লীগের দৈরাত্তের কারণে সাধারন ছাত্র- জনতার মাঝে রাজনীতি সম্পর্কে একটি বিরুপ মনভাব গড়ে উঠেছে। যার প্রভাব দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সর্বত্র প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু, দেশের রাজনীতি ভাল না, শুধু এটা ভেবে যদি সাধারন ছাত্ররা রাজনীতি বিমুখ হয় তবে তার খেসারত ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে আরও চরমভাবে দিতে হবে।
এটা বুঝতে পেরেই হয়ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটি ব্যতক্রমধর্মী উদ্যোগ নিয়েছেন, যেটা ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। তারেক রহমানের উদ্যোগে, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের নেতারা ৩৮ টি ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে, সারাদেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় মাস ব্যাপী সাংগঠনিক সফর করেন। প্রতি দলে ৩-৪ জন করে কেন্দ্রীয় সংসদের নেতা ছিলেন, যারা নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে দেশের সবগুলো জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংগঠনিক সফর করেন। প্রতিটি জেলাতেই, কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে উপস্থিত ছিলেন জেলা ও উপজেলার নেতাকর্মীরা। এই সাংগঠনিক সফরের উদ্দেশ্য ছিল- সাধারান শিক্ষার্থীরা আগামীতে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চায় তার একটা ধারনা নেয়ার পাশাপাশি বিএনপির অতীত ইতিহাস এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে তুলে ধরা।
একজন গবেষেক হিসাবে, ছাত্রদলের নেতারা এই সাংগঠনিক সফরে কি করেছেন তা বোঝার জন্য, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের কয়েকজন নেতার ফেসবুক পেজ থেকে কিছু ভিডিও এবং লেখা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। যেসকল ছাত্রদল নেতার কিছু ফেসবুক পোস্ট থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি তারা হলেন- শাকির আহমেদ (সহ-সভিপতি, কেন্দ্রীয় সংসদ), ইজাজুল কবির রুয়েল (সহ-সভিপতি, কেন্দ্রীয় সংসদ), মুঞ্জরুল রিয়াদ (সহ- সভিপতি, কেন্দ্রীয় সংসদ) ও ইমরান আলী সরকার (যুগ্ম সাধারন সম্পাদক, কেন্দ্রীয় সংসদ)। ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সারাদেশে যে ৩৮ টি দলে ভাগ হয়েছিলেন, তারমধ্যে শাকির আহমেদ ছিলেন ময়মনসিংহ ও জামালপুর এলাকায়, ইজাজুল কবির রুয়েল ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবং মুঞ্জরুল রিয়াদ ও ইমরান আলী সরকার ছিলেন ফেনী-নোয়াখালী এলাকায়।
এখানে বলে রাখা ভাল- সবাই কিন্তু সকল কাজ ফেসবুকে পোস্ট করেননি আবার সবার সব পোস্টও আমি দেখিনি। সুতরাং এই সাংগঠনিক সফরে ছত্রদলের নেতাকর্মীরা যেসব কাজকর্ম করেছেন তার সবগুলো তুলে ধরা সম্ভব না। তবে, স্যাম্পল বেসিসে কিছু কার্যক্রমের সারমর্ম নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।
প্রথমে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবদান, শেখ মুজিবের বাকশাল পরবর্তী বাংলাদেশে বহুদলীয় গনতন্ত্রের প্রচার-প্রসারে জিয়াউর রহমানের অবদান, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বাংলাদেশে খাদ্যে ও অর্থনীতিতে শহীদ জিয়ার ভূমিকা, পোশাক শিল্পে ও জনশক্তি রফতানীতে শহীদ জিয়ার ভূমিকার মত বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়। তারপর, স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়ার অবদান ও ছাত্রদলের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি এসিড সন্ত্রাস নির্মূলে, নারী শিক্ষায় ও নারীর ক্ষমতায়নে বেগম জিয়ার অবদানের কথা বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়। অতপর, ২০২৪ এর গণ-আন্দোলনে বিএনপির অবদানের দিক আলোকপাত করে, তারেক জিয়ার ভূমিকার কথা বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়। সাথেসাথে, ২০২৪ এর আন্দোলনে বিএনপির নেতাকর্মীদের ত্যাগের কিছু পরিসংখ্যানগত আলোচনা করা হয়, যেমন- ছাত্রদলের ১১৫-১২০ জন নেতাকর্মীসহ বিএনপি পরিবারের ৫৫০ জনেরও বেশি শহীদ হন।
সর্বশেষে, বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফা নিয়ে আলোকপাত করে, ভবিষ্যতে সরকার গঠন করতে পারলে- কীভাবে দেশ তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করা হবে তার একটি রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এই সাংগঠনিক সফর ব্যতিক্রমী এবং প্রশংসনীয়? প্রথমত, বাংলাদেশের ইতিহাসে, সাধারন শিক্ষার্থীদের মতামত নেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নেতাদের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় এমন সাংগঠনিক সফর হয়েছিল বলে আমার জানা নাই। দ্বিতীয়ত, এই সাংগঠনিক সফরটি কেন্দ্রের সাথে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ও সাধারান শিক্ষার্থীদের একটি শক্তিশালী সেতুবন্ধন। তৃতীয়ত, এই সফরের মাধ্যমে, তারেক রহমান হয়ত বিএনপি ও জনগণকে আগামীর জনবান্ধব রাজনীতি সম্পর্কে একটি বার্তা দিলেন।
পরিশেষে বলতে চাই, এই সফরে নেতাকর্মীরা যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন সেগুলো তারেক রহমান একটি ভিডিও কনফারেন্স অথবা একটি প্রেস রিলিজ এর মাধ্যমেও করতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে, কেন তিনি নেতাকর্মীদেরকে দিয়ে এই সফর করালেন? এই কেনোর উত্তর খুঁজতে গেলেই আপনি হয়তবা তারেক রহমানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন। তবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে তারেক রহমানের কাছে আশা করি, তিনি যেন, বিএনপির প্রতিটি অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের দিয়ে প্রতি বছর একটি করে এরকম সাংগঠনিক সফর করান এবং সফরে প্রাপ্ত সাধারান মানুষের মতামতের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার মূলনীতিগুলো নির্ধারন করে সেগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন।
লেখক: মো. মেহেদী হাসান মানিক
গবেষক, লেখক ও মানবাধিকার কর্মী