শিক্ষানগরী হওয়ার পথে কতটুকু এগিয়েছে ময়মনসিংহ
- শফিকুল ইসলাম
- প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২১, ০৯:৪১ AM , আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:৪৯ AM
লন্ডন, মিউনিখ, সিউল কিংবা টোকিও— বিখ্যাত এই শহরগুলোর ‘শিক্ষানগরী’ নামে রয়েছে বৈশ্বিক পরিচিতি। এছাড়া ভারতের রাজিব গান্ধী এডুকেশন সিটি অথবা কাতারের আল-রাইয়ান এডুকেশন সিটির মতো পরিকল্পিত ‘শিক্ষানগরীর’ও দেখা মেলে বিভিন্ন দেশে।
শিক্ষার সব স্তরের প্রতিষ্ঠান থাকার পাশাপাশি সেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও গবেষণার মান, জীবনযাপন ব্যয়, শিক্ষার্থী বৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসহ নানা বিষয়কে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই ‘শিক্ষানগরী’ নামকরণের পেছনে।
এসব মানদণ্ড বিবেচনায় আমাদের দেশের ময়মনসিংহ নগরীকে শিক্ষানগরী হিসেবে বিবেচনা করতে চান অনেক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, শিক্ষার প্রায় সব স্তরেরই প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই নগরীতে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশপাশি গবেষণা ক্ষেত্রেও রয়েছে এই জেলার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করার মতো কাজ। তাই শুধু নামে নয়, শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা চান ‘শিক্ষানগরী‘ হিসেবে এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং আলাদা বরাদ্দ।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, যদিও ময়মনসিংহকে শিক্ষানগরী বলার বিষয়টি আগে তেমন শুনিনি। তবে এমন দাবি আসলে আমি তার সঙ্গে একমত হব। কারণ, ময়মনসিংহে প্রায় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। শিক্ষাবোর্ড থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ন্যাপের কার্যালয় ছাড়াও রয়েছে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই জেলাকে এক অন্যরকম মর্যাদা দিয়েছে। তাই ময়মনসিংহ জেলাকে ‘শিক্ষানগরী’ বলাটা মানানসই হবে বলে আমি মনে করি, বলেন অধ্যাপক মো. ওয়াহিদুজ্জামান।
ময়মনসিংহ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকার দিকে তাকালে অধ্যাপক ওয়াহিদুজ্জামানের বক্তব্যের সপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ মেলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত পুরোনো এই জেলায় রয়েছে মেডিকেল কলেজ, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কলেজ, হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ, টির্চাস ট্রেনিং কলেজ, প্রথম গার্লস ক্যাডেট প্রতিষ্ঠান, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, মাদ্রাসা, শারীরিক শিক্ষা কলেজ, আর্ট ও চারুকলা স্কুলসহ বহু প্রতিষ্ঠান।
বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায় মৈমনসিংহ গীতিকার জন্য বিখ্যাত এই জেলায় সারা দেশ থেকে প্রতিবছর সহস্রাধিক ছেলে-মেয়ে আসেন উচ্চশিক্ষা নিতে।
এই জেলায় স্বাধীনতার পূর্বে স্থাপিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে (বাকৃবি) বলা হয় দেশের কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শস্যের জাত উৎপাদন, প্রাণীদের রোগ নির্ণয় ও প্রতিষেধক টিকা উৎপাদন, কৃত্রিম প্রজনন সহ কৃষি ক্ষেত্রে যুগান্তকরী সব অবদান রেখে চলেছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটি ছাড়া ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি) এবং প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় এই জেলাকে দিয়েছে আলাদা মর্যাদা।
বাংলাদেশের সেরা সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে একটি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে প্রতি বছর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অর্ধশতাধিক বিদেশি শিক্ষার্থীও ভর্তি হন। জেলায় রয়েছে বৃহত্তর ময়মনসিংহের একমাত্র বেসরকারি কমিউনিটি ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ।
ময়মনসিংহে স্নাতক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কলেজ রয়েছে অর্ধশতের বেশি। এদের মধ্যে আনন্দ মোহন কলেজ, নটরডেম কলেজ (ময়মনসিংহ শাখা), ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (টিটিসি), ময়মনসিংহ নার্সিং কলেজ ইত্যাদির খ্যাতি আছে দেশজোড়া। পাশাপাশি মাধ্যমিক পর্যায়েও আছে অর্ধশতের বেশি স্কুল। অন্যদিকে, জামিয়া আরাবিয়া আশরাফুল উলুম বালিয়া ও জামিয়া ইসলামিয়া মোমেনশাহী নামের বৃহৎ দুটি মাদ্রাসা এই জেলার মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের চাহিদা পুরণ করছে। এছাড়া জেলার ১৩ উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে মোট ২ হাজার ১৪২টি।
চার হাজার ৩৬৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই জেলায় শিক্ষা গবেষণা ক্ষেত্রেও রয়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ন্যাশনাল একাডেমি ফর প্রাইমারি টিচার্স এডুকেশন (ন্যাপ), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ (টিটিসি), ভেটেরিনারী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (পিটিআই) উল্লেখযোগ্য।
এত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারণে অনেকেই ময়মনসিংহকে ‘শিক্ষানগরী’ বলে ডাকতে চান। জেলার ব্রান্ডিংয়ের সময়েও ময়মনসিংহকে ‘শিক্ষানগরী’ বলে উল্লেখ করা হয় বলে জানান জেলার শিক্ষা কর্মকর্তা মো: রফিকুল ইসলাম।
তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা না থাকলেও ময়মনসিংহকে সবাই মুখে মুখে ‘শিক্ষানগরী’ বলেই ডাকে। প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এবং শিক্ষার মান উভয় মানদণ্ডে এটি শিক্ষানগরী হবার যোগ্যতা রাখে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার ব্র্যান্ডিংয়ের সময়েও ময়মনসিংহকে শিক্ষানগরী বলা হয়। তবে এই মৌখিক স্বীকৃতি পূর্ণতা পাবে সরকার এই জেলাকে পরিকল্পিত শিক্ষানগরী ঘোষণা দিলে।
জেলার শিক্ষা কর্মকর্তার এই কথার সমর্থন পাওয়া যায় ছাত্র ইউনিয়ন ময়মনসিংহ জেলা সংসদের সভাপতি বাহাউদ্দিন শুভর কথায়ও। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে শুভ বলেন, এই জেলায় শিক্ষার সব স্তরেরই প্রতিষ্ঠান আছে। কিছু হয়ত গুণগত মানের না। কিন্তু সব মিলিয়ে বেশ কিছু মানানসই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে এখানে।
জীবন নির্বাহ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে এই ছাত্র নেতা বলেন, তিন বছর আগেও এই জেলায় প্রাত্যহিক ব্যয় নির্বাহ খরচ অনেক কম ছিল। কিন্তু ময়মনসিংহকে বিভাগ ঘোষণার পর থেকে বাড়তে থাকে এই খরচ। তবুও গড় হিসেবে এই খরচ অন্যান্য বড় শহর থেকে বেশি নয়। অন্যদিকে বিভাগীয় শহর হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী তাদের ব্যয় নির্বাহের জন্য পার্ট টাইম কাজেরও সুযোগ পাচ্ছেন।
পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিরও ‘সুষ্ঠু পরিবেশ’ আছে বলে দাবি করে শুভ। তিনি বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠানে অল্প বিস্তর বাধা থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই মুক্ত রাজনীতি চর্চার পরিবেশ আছে।
ময়মনসিংহকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শিক্ষানগরী’ ঘোষণার দাবি তোলা যায় কিনা সে বিষয়টি আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে তো আমরা অনেকেই বলি। তবে সরকার থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য দাবি তোলা যায় কিনা সে বিষয়ে এই জেলার শিক্ষানুরাগী বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আলোচনা করব।