দেশে দারিদ্র্য কমেছে, বৈষম্য বেড়েছে: বিবিএস

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো  © সংগৃহীত

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে ২০২২ সালে অতি দারিদ্র্যের হার ব্যাপকভাবে কমেছে। তবে দেশে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য। সেই সঙ্গে গ্রামে বেড়েছে মানুষের খরচ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস সম্মেলন কক্ষে ‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০২২’ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের হাতে জাতীয় আয়ের ৩০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় মাত্র শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ।

প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, বৈষম্য দারিদ্র্যের চেয়েও মারাত্মক সমস্যা। কারণ, দারিদ্র্য কমছে। এক সময় হয়তো আরও কমবে। তবে বৈষম্য কোনোদিন হয়তো শেষ হবে না। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। এর মধ্যে পল্লি অঞ্চলে ২০ দশমিক ৫ এবং শহরে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। তবে ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ এবং ২০১০ সালের হিসাবে ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে দেশে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ (হ্রাসের গতি) কমেছে। 

এছাড়া অতিদারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে। এক্ষেত্রে পল্লি এলাকায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। এদিকে ২০২২ সালের হিসাবে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। যেটি গিনি সহগের মান (বিশ্বব্যাংকের হিসাব পদ্ধতি) শূন্য দশমিক ৪৯৯, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২। 

২০১০ সালে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। অন্যদিকে বেড়েছে ভোগবৈষম্যও। ২০২২ সালের হিসাবে ভোগব্যয়ের জন্য গিনি সহগের মান শূন্য ৩৩৪, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২৪। তবে ২০১০ সালে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৩২১। 

এছাড়া দেশের সর্বোচ্চ ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের ৩০ দশমিক ০৪ শতাংশ। অপরদিকে সর্বনিুে থাকা ৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় মোট আয়ের শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। এখানে স্পষ্ট হয়েছে যে, ধনীদের আয় বাড়ছে উচ্চহারে আর গরিবদের বাড়ছে ধীরে। এ দুই অংশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিরাজ করছে। 

আরও পড়ুন: সবচেয়ে বেশি গরিব বরিশালে: বিবিএস

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে ভিন্নচিত্র বরিশালে। আগে কুড়িগ্রামে সর্বোচ্চ দরিদ্র মানুষের বাস থাকলেও এবার উঠে এসেছে বরিশালে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। রংপুর থেকে এখন দারিদ্র্য বরিশালে গেছে। একসময় রংপুর বিভাগের মানুষ বেশি গরিব ছিল। দারিদ্র্যের হারও ওই অঞ্চলে বেশি ছিল। এখন দেশের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার বরিশাল বিভাগে। বরিশাল অঞ্চলটি শস্যভান্ডার হিসাবে পরিচিত। সেখানে দারিদ্র্য কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে ওই বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম পার্শ্ববর্তী খুলনা বিভাগে। এ বিভাগের দারিদ্র্যের হার ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালে জাতীয়ভাবে প্রতিটি পরিবারের গড় ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা। গড়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ দশমিক ২৬ ধরে মাথাপিছু ঋণ দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। ২০২৬ সালে জরিপে ছিল পরিবারপ্রতি ঋণের পরিমাণ ৩৭ হাজার ২৪৩ টাকা। মাথাপিছু ঋণ ছিল ৯ হাজার ১৭৩ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে প্রতিটি পরিবারের ঋণ বেড়েছে ১১১ দশমিক ১০ শতাংশ। এছাড়া গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারের ঋণ বেড়েছে। ২০২২ সালের হিসাবে গ্রামে পরিবারপ্রতি ঋণ ৪৪ হাজার ৪১১ টাকা, সেখানে শহরে পরিবারপ্রতি গড় ঋণ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৫৬ টাকা। এটি গ্রামের তুলনায় তিনগুণ বেশি। 

আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালে আনুমানিক ১৪ দশমিক এক শতাংশ খানার একজন সদস্য ছিলেন যারা ১২ মাসে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। এটি ২০১৬ ও ২০১০ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ, যার হার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে ২১ দশমিক ১১ শতাংশ ব্যক্তি মাঝারি বা মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। যেখানে ২০২২ সালে পল্লি এলাকায় এ হার ছিল ২২ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দেশে ২০২২ সালে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ ব্যক্তি মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিলেন। 

এখন ভাতের প্রতি মানুষের চাহিদা কমেছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ২০২২ সালে চালের দৈনিক মাথাপিছু গড় ভোগের পরিমাণ ছিল ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম। ২০২৬ সালে এটি ছিল ৩৬৭ দশমিক ২ গ্রাম। ২০১০ সালে ছিল ৪১৬ গ্রাম এবং ২০০৫ সালে ৪৩৯ দশমিক ৬ গ্রাম। এর বিপরীতে ফল, সবজি ও মাংসের ভোগ বাড়ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগে মানুষ খাদ্যপণ্য কিনতে বেশি টাকা ব্যয় করলেও এখন খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ক্রয়ে বেশি টাকা ব্যয় করছে। ২০২২ সালের হিসাবে খাদ্যব্যয়ের শতকরা হার হচ্ছে ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হয়েছে ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে ২০১৬ সালে খাদ্যের জন্য ব্যয় হতো ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় ছিল ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ। 


সর্বশেষ সংবাদ