দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন পাগলের হাতে!

ড. মো. কামরুল হাসান মামুন
ড. মো. কামরুল হাসান মামুন  © সম্পাদিত

"কোনো শিক্ষার্থীর বয়স ১২ বছর পূর্ণ না হলে এবং ১৮ বছরের বেশি হলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে না। এই বিষয় মাথায় রেখে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করার কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড।"- প্রথম আলো

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন পাগলের হাতে তা বুঝতে বেশি কিছু করতে হবে না। উপরের বাক্য দুটি পড়লেই বোঝা যায় এদের হাতে পরে আমাদের শিক্ষার ১৩টা বেজে যাচ্ছে। মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র আর বাসস্থানের পরেই ৪ নম্বরে আসে 'শিক্ষা' আর ৫ নম্বরে আসে চিকিৎসা। আসলে মানুষের ৫টি মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে শিক্ষা এমনই একটি চাহিদা যে এটি পূর্ণ হলে বাকি চারটি আপনা আপনি পূরণ হয়ে যায়। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি চাহিদাকে আমরা বয়স দিয়ে বেঁধে দিচ্ছি। আমরা বলে দিচ্ছি যে ১৮ বছরের বেশি হয়ে গেলে কেউ আর নবম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারবে না।

আচ্ছা এমন হতে পারেনা যে বড় ভাইয়ের বয়স যখন ১৫ তখন বাবা মারা গেল। মামা চাচারা কেউ তাদের দেখাশুনা করছে না। ওর মা কিছু করে না। ছোট ছোট ভাইবোন আছে। সংসার, জীবিকা এবং দায়িত্ববোধের কারণে বড় ভাই চাকুরী বা ব্যবসায় ঢুকে গেল। বড় ভাইয়ের বয়স ২৫ তখনই সে যেকোনো ভাবেই হউক আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল শুধু না বেশ সফল এবং সে এখন পড়াশুনায় ফিরে আসতে চায়। তার পড়াশুনার দরজা বন্ধের অধিকার কি রাষ্ট্রের আছে? তাহলে মৌলিক চাহিদার কি হবে? শিক্ষা  তো যেকোনো বয়সেই শুরু কিংবা আবার শুরু হতে পারে। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে কি এইভাবে বয়স দিয়ে শিক্ষাকে বেঁধে দেয়?

আরও পড়ুন : এই ছবিটা জাতীয় লজ্জার!

শুধুই কি এই কাজ? শিক্ষার বর্তমান দায়িত্বে যারা তারা এরচেয়েও ঘোরতর ক্ষতিকর কাজ করতে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত নতুন যেই শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে সেটা চালুর ৫-৬ বছর পরেই সরকার নিজেই বাদ দিতে বাধ্য হবে। দশম শ্রেণী পর্যন্ত সবাইকে এক ঘাটের পানি খাওয়ানোর নামে বিজ্ঞানকে যেভাবে দুর্বল করা হচ্ছে এই দেশে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও গবেষকের মারাত্মক সংকট হবে।

উচ্চতর গণিত নাই করে দিয়েছে। অথচ একই দেশের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা তা পড়বে। সবার জন্য সমান করতে গিয়ে বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয় যেমন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীবনবিজ্ঞানকেও লঘু করতে হয়েছে। এইসব বাদ দিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রযুক্তিকে। বিজ্ঞানের আগে প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দেয় কোন বলদে?

বিজ্ঞান হলো প্রযুক্তির জ্বালানি। বিজ্ঞানের আগে প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া যায় ভোকেশনাল ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিকুলামে। কিন্তু আমরা কি করছি? মেইন স্ট্রিম শিক্ষাকে এখন কারিগরি শিক্ষার পর্যায়ে নামিয়ে আনছি। শুধুই-কি তা। কারিগরি শিক্ষা যেমন জীবন ও জীবিকা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি।

বিজ্ঞানকে অবহেলা করে প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যারা করেছে তাদের বোঝা উচিত ছিল সব কিছুরই pre-requisite থাকে যেমন প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পড়ার আগে বিজ্ঞান ও গণিত জানতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।

আরও পড়ুন : বিবর্তন মানবা না তাহলে d/dt মানবা কিভাবে?

আমি আবারো বলছি এই পদ্ধতি চালু করতে গিয়ে সরকারকে বিশাল অংকের অর্থ খরচ করে নতুন বই প্রণয়ন করতে হবে। আর ৫-৬ বছর পরে যখন বুঝবে ও মাই গড! তখন আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে আবার প্রজেক্ট এবং বিশাল অংকের টাকার খরচ।

সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করতে গিয়ে আমরা যেমন সৃজনশীল শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে এবং যারা ইতিমধ্যেই শিক্ষক ছিলেন তাদের সৃজনশীল না বানিয়েই আমরা সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করেছিলাম। আবার নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে এবং মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম—দুটোই থাকছে। আমরা কি এমন মানের শিক্ষক নিয়োগ এবং ট্রেনিং দিয়েছি যারা unbiased ধারাবাহিক মূল্যায়ন করতে পারবে?

স্বাধীনভাবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করতে হলে শিক্ষকদের আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে হবে এবং একই সাথে দলীয় প্রভাবমুক্ত হতে হবে। এই দুটো হওয়ার বাস্তবতা কি বাংলাদেশে আছে? যখন যেই দল ক্ষমতায় থাকবে সেই দলের লোকাল নেতাদের চাপ এই শিক্ষকরা সামলাতে পারবে? এমনিতেই বাংলাদেশের শিক্ষার মান দক্ষিণ এশিয়ার তলানিতে। নতুন শিক্ষাক্রম চালু হলে বাংলাদেশের শিক্ষার মান পাতালে নামবে।

এখনো সময় আছে এই পাগলামি থামান। শিক্ষার মেরামতের জন্য শিক্ষাবিদদের মতামত নিন। ইন ফ্যাক্ট, বাংলাদেশের শিক্ষার সংকট নিয়ে আমাদের ৫ বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক কবির চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মিলে আজ থেকে ১২ বছর আগে কিছু যুগান্তকারী প্রস্তাব করেছিলেন। আপনারা তাদের কথা শুনেন না কেন?


সর্বশেষ সংবাদ