আমরা আট ভাইবোন একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি

অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার
অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার  © টিডিসি ফটো

প্রতি বছর ৮ মার্চ পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো নারীর সম-অধিকার, সম-সুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ। দিবসটি উপলক্ষে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছেন রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার। একজন নারী হিসেবে তিনি জানিয়েছেন নারীদের নিয়ে তার চিন্তা, ভাবনা ও তার জীবনের গল্প। তার কথাগুলো শুনেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের রাবিপ্রবি প্রতিনিধি আহ্সান হাবীব

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন নারীর সফলতার মূলে কোন অনুষঙ্গগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে? সেক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতা কেমন?
অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার: নারী কখনো একা সফলতা অর্জন করতে পারে না। নারীর সফলতার পেছনে তার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন—এমনকি তার স্বামী-সন্তানদেরও ভূমিকা রাখতে হয়। সব কিছু মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। একজন মানুষের সফলতার পেছনে তার একক কোন শক্তি নয় বরং অনেকগুলো শক্তিমিলিয়েই সে শক্তির অনন্যতে পৌঁছে যায়। তাই আমি মনে করি সফলতার পেছনে সবার দোয়া, আশীর্বাদ ও সহযোগিতা দরকার।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার জন্মস্থান, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া (শিক্ষাগত বিষয়), কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার: আমি রাঙ্গামাটি জেলাম চন্দ্রঘোনা নামক স্থানে, চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতালে ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করি। পড়াশোনা শুরু করি খ্রিষ্টান মিশনারীতে। সেখানে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে কর্ণফুলি পেপারস মিলস হাইজস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছি।

সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার উদ্দেশ্যে ঢাকা বদরুন্নেসা মহিলা মহাবিদ্যালয়ে পড়তে যাই। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্নাস (ম্যানেজমেন্টে বিভাগে ভর্তি হই)।

১৯৮৪ সালে সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ১৯৮৫ সালে একই বিভাগে মাস্টার্স করি। এরপর কিছু দিন ঢাকায় আইএফআইসি ব্যাংকে কাজ করেছি। সেখান থেকে ১৯৮৮ সালের পহেলা নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছি। সেই থেকে শিক্ষকতা জীবন এখনো চলমান। অবশেষে ২০২২ সালের ২০ সেপ্টেম্বরে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেছি ও এখনো দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার এ পর্যন্ত আসতে সবচেয়ে বেশি কার ভূমিকা ছিল?
অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার: আজকে এই অবস্থানে আসার পথে অবশ্যই আমার বাবা-মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আমি যখন পড়ালেখা করেছি তখন তো মেয়েরা সর্বোচ্চ ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করতে পারতো। এরপরে তাদের বাবা-মা তাদের বিয়ে দেয়ার জন্য হন্যে হয়ে পাত্র খুঁজতো।

সাধারণ শিক্ষিত মানুষ হয়েও আমার বাবা শুধু স্কুল পড়িয়েই সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং আরো শিক্ষিত হতে ঢাকায় পড়াশুনো করতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তারপরে বিয়ে। কোনদিন তারা এটা চিন্তা করেননি যে আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এর জন্য আমাকে দ্রুত বিয়ে দিতে হবে।

আমরা আট ভাই-বোন এক সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। একটা সাধারণ পরিবার থেকে ৮ ভাই-বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, আমার মনে হয় তখনকার সময়ে অন্যান্য পরিবারে তা সম্ভব ছিলো না। এক ভাই ডাক্তার। এছাড়া আমরা ৭ ভাই-বোন সকলেই চবিতে পড়েছি।

আমার মা অত্যন্ত বিদ্যানুরাগী একজন ব্যক্তি। তাকে আমি হাজার সালাম জানাই। আমার শিক্ষক, পিএইচডি ডিগ্রি, উপাচার্য হওয়ার পেছনে আমার পরিবারের ভূমিকা অসীম। যদি আমি এই পরিবারে জন্মগ্রহণ না করতাম, তাহলে হয়ত আমি এসব কিছুই হতে পারতাম না। আমার মাকে আমি স্যালুট জানাই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসঃ আপনার অবসর সময় কীভাবে কাটে, আপনার শখ ইত্যাদি সম্পর্কে যদি বলেন...
অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার: অবসর জিনিসটা এখন আমার জীবনে নেই। আগে প্রচুর অবসর পেতাম। তখন এখনকার মতো ব্যস্ত ছিলাম না। অবসরে আমি প্রচুর বই পড়ি। পছন্দের তালিকায় রাজনৈতিক বই, ভ্রমণ কাহিনি, বিভিন্ন মনীষীদের জীবন কাহিনি মূলক বইগুলো।

গল্পের বই খুব একটা পড়া হয় না। বড় বড় লেখকের বইগুলো পড়তে ভীষণ পছন্দ করি। পড়াশুনো ছাড়া আসলে আমার ভালো লাগে না। এখন একটা আক্ষেপ খুব কাজ করে, কেন আমি আগে থেকে লিখলাম না? আমার লেখা আমার শিক্ষার্থীরা খুব পছন্দ করে। আসলে এক জীবনে হয়ত সবকিছু একসাথে পাওয়া যায় না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার রাজনীতি, রাজনৈতিক জীবন ও নানা অর্জন বিষয়ে জানতে চায়...
অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা কাজে আমি জড়িত থাকতাম। অনেকে অনেক চেষ্টা করেও আমাকে থামাতে পারেনি। আমি আলোর পূজারি। আলোর দিকে ছুটে চলি। আমার প্রাণে আলো আছে। এসব রাজনীতির হাতেখড়ি আমি ঢাকায় পড়ার সময় শিখেছি।

ঢাকা এমন এক জায়গায় যেখানে নিজেকে তুলে ধরা যায়। ওই দুই বছরই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যা আমি ঢাকায় থাকতে অর্জন করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে ছাত্রলীগের আলাউদ্দীন-শফি পরিষদ শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলাম। পাশাপাশি শামসুন নাহার হলেরও সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলাম। ওইখান থেকেই রাজনীতি (১৯৮৩-১৯৮৬) পর্যন্ত। ১৯৮৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে ফেলি।

শিক্ষক রাজনীতিতে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত (মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত শিক্ষক সমাজের (হলুদ দল) আমি একজন সক্রিয় সিনিয়র নেতা ও সদস্য। সেখান থেকে নমিনেশন পেয়ে ২০০৮ সালে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করি। এরপর আবারো ২০২২ সালে সভাপতি পদে একই গ্রুপ থেকে নির্বাচন করি।

ওখানে ১১০০ শিক্ষকের মাঝে নির্বাচন করে প্রতিপক্ষের থেকে প্রায় ১০০ ভোট বেশি পেয়ে জয় লাভ করে সভাপতি হই। আমার মনে হয় শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় বরং বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ এত ভোটে জয় পেয়েছে কিনা আমি জানি না। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে বাংলাদেশে ও চবির প্রথম নারী সভাপতি হিসেবে আমিই প্রথম নির্বাচিত সভাপতি। এটা আমার অপূর্ব বিজয়। এই বিজয় আমি উপভোগ করি। চবিতে নারী শিক্ষক বড়জোর দুইশত হবে। বাকী ৯০০ শিক্ষক ছিল পুরুষ। বাকি ভোটগুলো কিন্তু পুরুষ শিক্ষক থেকেই পেয়েছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার রাজনীতিক জীবনেরও দীর্ঘ গল্প রয়েছে। এ পথ বাড়ি দিতে কেমন বাঁধা অতিক্রিম করতে হয়েছে?
অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার: কোন মানুষের জীবন কাঁটাবিহীন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে সমানভাবে যাচাই-বাছাই করেই নেয়া হয়। আমি তেমন কোন বাঁধা পাইনি। তবে আমাদের যে রাজনৈতিকভাবে যে ঈর্ষা, বৈষম্যএগুলো পেয়েছি। শিক্ষকতার ক্ষেত্রে আমি কোন অনিয়ম পাইনি।

তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মেয়েরা শিক্ষক রাজনীতি বা দেশের বড় বড় ক্ষেত্রে খুব বেশিদূর যেতে পারে না। কারণ তাদের ডাউন করে রাখার যত রকম ষড়যন্ত্র আছে তা সব প্রয়োগ করে হয়। আমার উপরেও প্রয়োগ করা হয়েছিলো। আমি মূলত ছাত্রলীগ করা একজন মেয়ে। আমার পরিবারের অনেক অবদান আছে এই দেশের জন্য, এই রাজনীতির জন্য এই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সেসময় ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে আপনার পরিবারে উপর কোনো ধরনের চাপ এসেছিল কিনা?
অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার: আমার ছোট ভাই আবুল কালাম আজাদ ছিলেন চবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও শাহ্জালাল হলের প্রেসিডেন্ট। তখন আমার ভাইয়ের টিউটোরিয়াল পরীক্ষা হচ্ছে। সেখান থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে নির্যাতন করা হয়। প্রায় মৃত ভেবে ফেলে দিয়ে গিয়েছিলো ওরা। ড্রিল মেশিন থেকে শুরু করে বুকের উপরে ইট ও মাথায় আঘাত করা হয় তাকে। শুধু আল্লাহর দয়ায় ও মায়ের দোয়ায় সে বেঁচে যায়।

আমার ভাইয়ের উপরে এত নির্যাতন গেছে যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তার কারণ একটাই সে চবির একচ্ছত্র নেতা ও শিবিরের ত্রাস। এতকিছুর পরেও সে শুধু কষ্ট পেয়ে গেছে। আসলে বিপদে কাউকে পাশে পায়নি সে, কেউ এগিয়েও আসেনি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে বার্তা পৌঁছানোর পরেই তিনি তার ভাই বাহাউদ্দীন নাসির কর্তৃক আজাদ ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য এক লাখ টাকা অনুদান দেন। সেজন্য আমি ও আমার পরিবার বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে চির কৃতজ্ঞ।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নারী দিবস নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার: ৮ মার্চের ভাবনার তুলনা হয় না। শিকাগো শহরের সেই সুতার কারখানার মধ্যে যে নারী শ্রমিকরা তাদের ১৬ ঘণ্টাকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন, সেটা কিন্তু আজকে দিবস হিসেবে আমরা পালন করছি। জাতিসংঘও স্বীকৃতি দিয়েছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার:
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্যেও শুভকামনা।


সর্বশেষ সংবাদ