উৎসব আয়োজন আর আন্দোলনমুখর ছিল ২৪-এর ডুয়েট

  © টিডিসি ছবি

ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েটে) নতুন সেশন শুরু হয় কয়েক দিন আগে। ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর শুরু হয় ২০২২-২৩ সেশনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ক্লাস। ভালো-মন্দ নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ক্যাম্পাসের একটি বছর।

বছরের শুরুর কিছুদিন ডুয়েটের নতুন শিক্ষার্থীদের কাটে র‍্যাগ আতঙ্কে। ছাত্রলীগের অতি উৎসাহী কিছু নেতাকর্মীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে র‍্যাগিং-মুক্ত চিরসবুজ ডুয়েট ক্যাম্পাসে র‍্যাগিং-এর বিষবাষ্প ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করে কিছু উৎশৃঙ্খল  শিক্ষার্থী। কিন্তু শিক্ষার্থী বান্ধব ডুয়েট প্রশাসনের আন্তরিকতায় সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। 

বছরের শুরুর দিকে যুগান্তকারী এক উদ্যোগ নেয় এএসসিই স্টুডেন্ট চ্যাপ্টার, ডুয়েট। এই স্টুডেন্ট চ্যাপ্টারের উদ্যোগে আয়োজিত হয় দেশের সবচেয়ে বড় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফেস্ট সিভিলাইজেশন সিজন ওয়ান। দেশের প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় ২৫০টির মতো টিম অংশ নেয় ইভেন্টে।

এএসসিই ডুয়েট স্টুডেন্ট চ্যাপ্টারের তৎকালীন সভাপতি সৈয়দ আল-রাহাত বলেন, সিভিল্যাইজেশন ছিল আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার কারণ এবারই ছিল আমাদের জন্য প্রথম। বিগত দিনগুলোতে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে গিয়ে সাফল্য ছিনিয়ে এনেছিলেন। ফলে আমাদের মাঝে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল একটা আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ইভেন্ট করার। আমরা প্রথমবারই ব্যাপক সাড়া পাই। প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিযোগীরা আসে। মোট ৯টি সেগমেন্টে সিভিলাইজেশন আয়োজিত হয়। মোট প্রাইজমানি ছিল দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা। সিভিলাইজেশনে ক্যাম্পাস উইনার হয় ডুয়েট। আমাদের আয়োজন নিয়ে সবার মোটামুটি পজেটিভ রিভিউ ছিল।

অ্যাডভান্সমেন্ট ইন ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং শীর্ষক ৩য় আন্তর্জাতিক কনফারেন্স আয়োজন করে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি। ২৫, ২৬ ও ২৭ এপ্রিল এই তিন দিনব্যাপী আয়োজিত কনফারেন্সে। ওই কনফারেন্সে টিচার্স, রিসার্চার, স্কলার্স, স্টুডেন্ট ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাক্টিভিস্টদের মাঝে নলেজ শেয়ারিং সেশন অনুষ্ঠিত হয়। কি-নোট স্পিকার ছিলেন প্রফেসর মোহাম্মদ আতাউল করিম, প্রফেসর মাসারি ইসহি, প্রফেসর মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম ও প্রফেসর জাহাঙ্গীর হোসাইন।

মেকানিক্যাল, ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং শীর্ষক ২য় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের আয়োজন করে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি। ২৯, ৩০ ও ৩১ মে, এই তিন দিনব্যাপী কনফারেন্সে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের রিসার্চার, একাডেমিক,  স্কলার্স, স্টুডেন্ট এবং ইন্ডাস্ট্রিয়্যাল এক্টিভিস্টরা অংশগ্রহণ করেন। কি-নোট স্পিকার ছিলেন প্রফেসর জঙ টাও, প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল কালাম, প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান, প্রফেসর হিরোমিসি ওবারা, ড. মাহমুদুর রহমান এবং ড. মোহাম্মদ আব্দুল আলিম।

রমজানে ইফতার মাহফিল আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা দেয় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। এর প্রতিবাদে ২ রমজান ডুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গণ-ইফতার কর্মসূচি পালন হয় ডুয়েটে। মুসলমানদের মৌলিক ইবাদত ইফতার কর্মসূচি পালনে ও বাধা সৃষ্টি করে ডুয়েট প্রশাসন ও ছাত্রলীগ। দলটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক শত বাধা সত্ত্বেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বানের জলের মতো ভেসে যায় ছাত্রলীগ। গণ-ইফতার বাস্তবায়নে যুক্ত ছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুর রহিম। তিনি বলেন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বারবার মুসলিম সংস্কৃতিতে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছিল। শাবিপ্রবি ও নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে ইফতার পার্টির ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মুসলিম সংস্কৃতির ওপরে নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল। এর  প্রতিবাদে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণইফতার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।

জুনের মাঝামাঝি থেকে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন করেন। ডুয়েট ও তার ব্যতিক্রম ছিল না। শিক্ষকদের দাবি মেনে নেয়া না  হলে ৩ জুলাই পরিক্ষা বর্জন করেন শিক্ষক সমিতি। এতে অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে যায় ডুয়েটের অবশিষ্ট সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষাগুলো।

এরই মাঝে দেশে শুরু হয় কোটাবিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে ডুয়েটে। ১০ জুলাই বেলা ১১টায় ডুয়েটের সামনে অবস্থান নেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে অবস্থান নেয় মাঝিরখোলা রেলক্রসিংয়ে। বন্ধ হয়ে যায় রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ। ১১ জুলাই বেলা ৩টায় বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে ওই দিনের কর্মসূচি সমাপ্ত করা হয়।

আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ডুয়েট শিক্ষার্থী শাহজাহান চৌধুরী আন্দোলনের দিনগুলোর বর্ণনা এভাবে দেন, ‘আমরা ৯ তারিখ প্রথমের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ এবং পরে গোপনে চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিই। ১০ তারিখ একটা মিছিল করার পর জানতে পারি ৩য় বর্ষও মিটিং করে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা ওদের সাথে কোলাবোরেট করে ১০ তারিখ বেলা ১১টায় ডুয়েট গেটে অবস্থান নিই এবং এরপর মাঝিরখোলা রেলক্রসিং অবোরোধ করা হয়। ওই দিন আমরা ঘোষণা দিই ১১ তারিখ বেলা ৩টায় আবার মিছিল করার। কিন্তু ১১ তারিখ জয়দেবপুর থানার ওসি সকাল থেকে আমাকে ফোন দিয়ে হুমকি দিতে থাকেন এবং এরপর আবার ডিজিএফআই থেকেও কল করে হুমকি দেওয়া হয়।  কিন্তু আমার টার্গেট ছিল যেকোনো মূল্যে ডুয়েট গেটে দাঁড়ানো। মিছিলের উদ্দেশ্যে আমরা ডুয়েট স্কুলের মাঠে কয়েকজন জড়ো হলে ছাত্রলীগের কয়েকজন এসে আমাদের এফ আর খান হলে গেস্ট রুমে নিয়ে যায়। সেখানে আমাদের মোবাইল চেক করা হয়। শিবির ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করা হয় এবং শেষে কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় আমাদের ছেড়ে দিয়ে ক্যাম্পাসে আমাদের দিয়ে জোরপূর্বক ছাত্রলীগের মিছিল দেয়।’

এরপরে ১৫ তারিখের রাতে আশপাশের সবাই ডুয়েট গেটে এসে রাজাকার রাজাকার স্লোগান দিচ্ছিল। কিন্তু আমরা হল থেকে বের হতে পারছিলাম না। তৎক্ষণাৎ আমরা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে বেশ কয়েকজনের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই যে ১৬ তারিখ বিকেল ৩টায় ডুয়েট গেট থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করার। রাতে বের হতে না পারলে ও আমরা সকালে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে একটু দূরে ক্যাম্পাসের কয়েকজন এবং আশপাশের স্কুল-কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে মিটিং করি। আশপাশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিটিং করে আমরা বিকাল ৩টায় বিশাল জমায়েত ঘটাই ডুয়েট গেটে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমাদের ডুয়েট গেট ছেড়ে দেওয়ার জন্য বারবার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। আমরা তাদের কাছে বলি, মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য আমরা ডুয়েট গেটে অবস্থান করতে চাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। পরে আমরা উপজেলা পরিষদের গেটে অবস্থান নিই। আমাকে মিছিল শুরু করার আগ মুহূর্তে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে থ্রেট দেওয়া হয় ডুয়েটের সব স্টুডেন্টের দায়িত্ব তোমার। যদি কোনো স্টুডেন্ট আহত হয় বা ক্ষয়ক্ষতি হয়, তাহলে তোমাকে আস্ত রাখব না আর তোমার ছাত্রত্ব বাতিল হবে। তবু আল্লাহর ওপর ভরসা করে চৌরাস্তায় মিছিল নিয়ে যাই। কিন্তু ফেরার পথে নাওভাঙ্গা মোড়ে আমাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। ১৬ তারিখের পর আর ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে পারিনি।

এরপর ১৭ জুলাই নিহতদের গায়েবানা জানাজা আয়োজন করে ডুয়েট শিক্ষার্থীরা। ১৮ জুলাই ডুয়েট থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল এবং সমাবেশ করেন ডুয়েট শিক্ষার্থীরা। ১৮ জুলাই সারাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে গনহত্যা চালায় ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার প্রশাসন। ১৯ জুলাই সারা দেশে জুমার পর বিক্ষোভ মিছিল করে সাধারণ ছাত্র-জনতা। ডুয়েট শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ মিছিল জয়দেবপুর বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছালে পুলিশ অতর্কিত হামলা চালায়। মুহুর্মুহু রাবার বুলেট এবং টিয়ারশেলে প্রকম্পিত হয় পুরো জয়দেবপুর। ধাওয়া পালটা ধাওয়ায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বাস স্টান্ড এলাকায়। আহত হয় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। জুমার পর থেকে শুরু হয়ে সংঘর্ষ চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যায় গুপ্ত হামলার আশঙ্কায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা পিছু হটলেও এরপর শুরু হয় মেসে মেসে তল্লাশি। ছাত্রলীগের সহায়তায় বিভিন্ন মেস থেকে শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ২০ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে হল থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেয় ডুয়েট প্রসাশন।

এর পরের দিনগুলোতে ডুয়েট শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ নিজ জায়গায় থেকে অংশগ্রহণ করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে।

ডুয়েট সাংবাদিক সমিতির তৎকালীন সভাপতি লতিফ গাজী বলেন, ৩ আগস্ট সরকার পতনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার সিদ্ধান্তটি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসে নিউজ প্রকাশ করলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের ভিসিকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করতে থাকেন।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পলায়ন করলে ক্যাম্পাসে ফিরে আসে ডুয়েট শিক্ষার্থীরা। ফ্যাসিবাদের দোসর ডুয়েটের উপাচার্য ড. হাবিবুর রহমানের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে ডুয়েট শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে ডুয়েটের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য,  ছাত্র-কল্যাণ পরিচালক, রেজিস্ট্রার পদত্যাগ করেন।

হাসিনার পলায়নের পরপরই ভারতের সৃষ্ট রাজনৈতিক বন্যায় ভেসে যায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলা। বন্যার্ত মানুষের সহযোগিতায় বড় ভূমিকা রাখে ডুয়েটের শিক্ষার্থীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে প্রায় ৩৫ লাখ টাকার ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয় বন্যার্ত মানুষের জন্য। ডুয়েট শিক্ষার্থীরা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে প্রায় ১৫ দিন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে চলে ত্রাণ কার্যক্রম। এ কাজে সমন্বয় করেছেন এমন একজন ছিলেন ডুয়েট শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আমানুল্লাহ।

তিনি বলেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সবাই যখন নতুন করে দেশ সাজাতে ব্যস্ত, তখন আমরা পরিকল্পনা করছিলাম ক্যাম্পাস সংস্কারের। কিন্তু হঠাৎ ভারতের ছেড়ে দেওয়া পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে ফেনীসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চল। এই এলাকার মানুষের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। একটি সফল অভ্যুত্থানের যে আনন্দ তা নিমেষেই বিলীন হতে শুরু করে। জাতীয় জীবনে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ছুটে চলে দক্ষিণের মানুষের সহায়তায়। উদ্ধারকাজের জন্য ট্রাকের পর ট্রাক সারিবদ্ধভাবে নৌকা নিয়ে, কেউবা শুকনা খাবার নিয়ে ছুটে চলে ফেনীর দিকে।

বসে থাকেনি আমাদের প্রিয় ডুয়েট। শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে শুরু হয় ফান্ড রেইজিং, ক্রাউড ফান্ডিং। শুধু যে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসেছিল তা নয়। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী থেকে শুরু করে এলাকাবাসী তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে পাশে দাঁড়ান। ৩৫ লক্ষ টাকার বেশি ফান্ড উত্তোলন করে ঢাবির পরেই শীর্ষে অবস্থান করে ডুয়েট। উত্তোলিত ফান্ড থেকে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, কুমিল্লা, মিরেরসরাই, ফটিকছড়ি, খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে কোথাও উদ্ধার অভিযানে নৌকাসহ টিম পাঠানো হয়, কোথাও শুকনা খাবার, ওষুধ, কোথাও ভারী খাবার, পোশাক পাঠানো হয়। সর্বশেষ ডুয়েটিয়ানদের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ২৩টি পরিবারকে ৫ লাখ টাকা সাহায্য করা হয়।

বন্যার সময়ে যেভাবে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কাধে কাধ মিলিয়ে জাতীয় সংকট কাটিয়ে উঠতে কাজ করেছিলাম তা অবিস্মরণীয়।  আমি প্রত্যাশা করি সেই স্পিরিটকে ধারন করে আগামীর সব জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রয়োজন। এই জাতি কখনো হারেনি, হারবে না, হারতে পারে না। সম্প্রীতির যে ডুয়েট আমরা পেয়েছিলাম, আমি চাই যুগ যুগ ধরে ডুয়েটিয়ানদের মধ্যে এই বন্ধন অটুট থাকুক। এগিয়ে যাক প্রাণের ক্যাম্পাস।

গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে পালিত হয় প্রশাসনবিহীন ডুয়েট ডে। এদিন সকালেই প্রফেসর ড. আরেফিন কাওসারকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়া হয়। নতুন ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ড. উৎপল কুমার দাসকে।

নতুন প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীরা প্রথম দাবি  বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের সাথে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের শাস্তি এবং দ্রুত পরীক্ষা গ্রহণের। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে দ্রুত পরীক্ষা আয়োজন করে ডুয়েট প্রশাসন। কিন্তু অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পরিক্ষার জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করায় পরীক্ষার দুদিন আগে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা শুরু হয়। ক্যাম্পাসে অবস্থান করা কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মীকে বের করে দেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এতে দুদিন পিছিয়ে যায় পরীক্ষা।

১ অক্টোবর ডুয়েটে নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়। এর পরপরই ২১ অক্টোবর উপাচার্য  হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ড. জয়নাল আবেদীনকে এবং উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয় ড. আরেফিন কাওসারকে।

২৫ অক্টোবর ডুয়েট রোবটিকস ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত হয় এশিয়ার সবচেয়ে বড় টেকফেস্ট IIT Bombey-এর বাংলাদেশ জোনাল রাউন্ড। এতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কলেজের প্রায় ৫০টি টিম অংশগ্রহণ করেন। ডুয়েট রোবটিক্স ক্লাবের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন বলেন ডুয়েট রোবটিক্স ক্লাব কতৃক আয়োজিত টেকফেস্ট আইআইটি বোম্বেতে দেশের ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫০ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়েছিলেন। এ ছাড়া গাজীপুরের বিভিন্ন স্কুল থেকে ৪০০ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিলেন। টেকফেস্টে ৩টি ইউনিভার্সিটি লেভেল সেগমেন্ট ছিল এবং ১টি স্কুল লেভেল সেগমেন্ট ছিল। আইআইটি বোম্বেতে ফাইনাল রাউন্ডে অংশ নেওয়ার জন্য প্রতিটি সেগমেন্ট থেকে ৫ টি করে টিম সিলেক্ট করা হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডুয়েটের টিম ছিল। কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে অবনতি এবং ভারত থেকে ভিসা না দেওয়ার কারণে আমরা ভারতের মুম্বাইয়ে যেতে পারিনি। আমরা চাচ্ছি বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট আয়োজন করতে।

রিয়েস্ট ইনোভেশন ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড আর্কিটেকচার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক প্রথম আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের আয়োজন করে ডুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি। ৭, ৮ ও ৯ নভেম্বর এই তিন দিনব্যাপী আয়োজনে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আর্কিটেক্ট বিষয়ক স্কলার্স, রিসার্চার, স্পেশালিষ্ট এবং স্টুডেন্টদের মাঝে নলেজ শেয়ারিং সেশন অনুষ্ঠিত হয়। কি-নোট স্পিকার ছিলেন মোট সাত জন তাদের মধ্যে ড. আইনুন নিশাদ, ড. কিজুকিনোসিতা, ড. শাখাওয়াত চৌধুরী, ড. ইউইয়া তাকাহাসি, ড. পিটার আর্মস্ট্রং, ড. পাউল ক্লেস এবং  ড.মতিয়ার রহমান।
 
১৪ ও ১৫ নভেম্বর ডুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি প্রথম বারের মত আয়োজন করে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা বিল্পবী বাংলা২.০ । এতে সারা দেশের প্রায় ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিযোগীরা অংশ নেন। ডুয়েট ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি আব্দুল্লাহ কোরাইশ বলে বলেন, বিতর্ক সার্কিটে ভালো কিছু করতে হলে জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়েই আপনি জাতীয় বিতর্ক ও বিতার্কিকদের লেভেল বুঝতে পারবেন। সে অনুযায়ী নিজেকে, নিজের বিতর্ক সংসঠনকে প্রস্তুত করতে পারবেন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে ডুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি (ডিডিএস) এই আয়োজনটি কখনোই বাস্তবায়ন করেনি।

আমরা সেই ব্যর্থতা কাটিয়ে জুলাই বিপ্লবের পর, শহীদদের স্মরণে প্রথম বারের মতো ‘বিপ্লবী বাংলা ২.০’ আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা-২৪ আয়োজন করি এবং এরই মাধ্যমে আমরা জাতীয় বিতর্ক সার্কিটে নিজেদের সুপরিচিত বিতর্ক সংগঠন এবং আমরা জাতীয় বিতার্কিক তৈরির রসদ সংগ্রহ করেছি। আশা করি, আমরা খুব দ্রুতই এর সুফল ভোগ করব।

১৬ ও ১৭ নভেম্বর দুই দিন ডুয়েটে ভর্তি পরিক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এবারের ভর্তিযুদ্ধে প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়।

ডিসেম্বরের শুরুতে ডুয়েটে আয়োজিত হয় আন্তবিভাগ ফুটবল টুর্নামেন্ট।  ২৪ ডিসেম্বর টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। বিজয়ী হয় টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং রানার্সআপ হয় কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। ৩০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় জুলাই২৪ স্মৃতি ক্রিড়া প্রতিযোগিতা। 

এ ছাড়া ডুয়েটের শিক্ষার্থীরা এ বছর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেন। ডুয়েটের রোবটিক্স ক্লাব, কম্পিউটার সোসাইটি, স্থাপত্য সংঘ এবং এএসসিই স্টুডেন্ট চ্যাপ্টার এবং ডুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি বছরব্যাপী বিভিন্ন আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ইভেন্টে অংশ নিয়ে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করে।

আন্দোলন, সংগ্রাম, সাফল্য আর মেধা বিকাশের প্রতিযোগিতায় ডুয়েটের প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনের অম্লান স্মৃতি হয়ে থাকবে ২০২৪। 

আসিফ ইকবাল
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)


সর্বশেষ সংবাদ