বুক রিভিউ

রবার্ট ল্যাংডনের সঙ্গে ধর্ম ও বিজ্ঞানের অলিগলিতে

লেখক ও তার বই এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস
লেখক ও তার বই এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস  © টিডিসি ফটো

বর্তমান সময়ের অতি পরিচিত একটি নাম ড্যান ব্রাউন যিনি তাঁর থ্রিলারধর্মী বইগুলোতে এনেছেন অসাধারণ রহস্যের অভিনবত্ব এবং অপ্রত্যাশিত চমক। ড্যান ব্রাউনের সৃষ্ট একটি কাল্পনিক এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় চরিত্র রবার্ট ল্যাংডন যিনি পেশায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিলিজিয়াস সিম্বোলজি বা ধর্মীয় প্রতীকবিদ্যা বিষয়ের অধ্যাপক। তবে মজার ব্যাপার হলো সত্যিকার অর্থে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সিম্বোলজি নামক কোনো বিভাগ নেই!

রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের অভিনবত্বই হলো এ্যাকশনধর্মিতায় কম মনোযোগ দিয়ে কোডস ব্রেকিং, সংকেত উদ্ধার, গুপ্ত সংগঠন ও তাদের কার্যক্রমসহ অনেক দুর্বোধ্য বিষয়ের রহস্য উন্মোচন। রহস্যের অনুসন্ধানের পিছনেই যেন ঘুরঘুর করতে থাকে ড্যান ব্রাউনের থ্রিলারগুলো। এছাড়া তিনি ধর্ম, ইতিহাস এবং বিজ্ঞানের মধ্যকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে এসেছেন এই থ্রিলার সিরিজে।

ড্যান ব্রাউনের রচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু সিম্বল। সিম্বলিক জটের সমাধানই বইগুলোর উপজীব্য হয়ে ওঠে। তিনি রবার্ট ল্যাংডনের মাধ্যমে এমনভাবে সিম্বলিক জটগুলোকে পাঠকের সামনে হাজির করেন যে, পাঠক নিজেই যেন বসে যান রহস্যের জট খুলতে। তাঁর সফলতা এখানেই।

এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস

এটি রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের প্রথম বই। উপন্যাসের কাহিনীর মূলে থাকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টার সার্ন এবং ইতালির ভ্যাটিকান সিটি। এই বইতেই ড্যান ব্রাউন সৃষ্টি করেন তাঁর বিখ্যাত রবার্ট ল্যাংডন চরিত্রটি। বইটি মূলত কয়েক ঘন্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযানের কাহিনী।

ঘটনার শুরু একটি খুনের মাধ্যমে। জঘন্য ভাবে খুন করা হয়েছে পদার্থবিদ লিওনার্দো ভেত্রাকে। মৃতদেহের বুকে নৃশংসভাবে আঁকা হয়েছে একটি সিম্বল। সার্ন থেকে পাওয়া একটি ফ্যাক্সে মৃতদেহের বুকে এই সিম্বলটি দেখেই রবার্ট ল্যাংডন ছুটে যায় সার্নে। সার্নের ডিরেক্টর কোহলার রবার্টকে মৃতদেহের কাছে নিয়ে গেলে চমকে উঠে সে! মৃতদেহের বুকে ছাপ মারা ছিল অত্যন্ত পুরোনো গুপ্ত সংগঠন ‘ইলুমিনাতি’র এম্বিগ্রাম, বর্তমান শতাব্দীতে যেই সংগঠনের কোনো অস্তিতই নেই!

এরপর কাহিনীতে আসে মৃত বিজ্ঞানীর জীব-পদার্থবিজ্ঞানী মেয়ে ভিক্টোরিয়া। পদার্থবিজ্ঞানের চমৎকার এক আবিষ্কারের কথা জানায় সে যা ছিল বাবা মেয়ের দীর্ঘদিনের সাধনার ফসল-অ্যান্টিম্যাটার। এই আবিষ্কারই ছিল তার বাবার মৃত্যুর কারণ। কিন্তু ভিক্টোরিয়া জানায় এই আবিস্কারের কথা তারা দুজন ছাড়া কেউই জানত না, তাহলে কিভাবে সম্ভব! এরপর সার্নেই আরো কিছু অপ্রত্যাশিত ধাক্কার সম্মুখীন হয় কোহলার, ভিক্টোরিয়া ও ল্যাংডন।

কাহিনী মোড় নেয় অন্যদিকে। খুনিকে ধরার বদলে ল্যাংডন ভিক্টোরিয়াকে সাথে নিয়ে ছুটে যায় ভ্যাটিকান সিটিতে। কাহিনীতে আসে নতুন সব চরিত্র-মোরতাতী, কামেরলেঙ্গো, জুইস, ওলিভেতি। পাঠকের মনে হবে এক জগত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেক জগতে চলে এসেছে। ভ্যাটিকান সিটিকে রক্ষার জন্য রবার্ট ল্যাংডন জড়িয়ে পড়ে ইলুমিনাতি ও ক্যাথলিক চার্চের সংঘাতের মধ্যে। যেনো বিজ্ঞানের চমকপ্রদ জগত থেকে একলাফে ইতিহাস আর ধর্মের জগতে জড়িতে যাওয়া!

এই উপন্যাসে ড্যান ব্রাউন খ্রীস্ট ধর্মের অনেক গোপন আর অনেক ঐতিহাসিক সত্যকে গল্পের মাধ্যমে সাজিয়ে হাজির করেন পাঠকের সামনে। সেইন্ট পিটার স্কয়ার, সিস্টিন চ্যাপেল, ভ্যাটিকান মিউজিয়াম, ভ্যাটিকান লাইব্রেরি, পোপ নির্বাচনের নিয়ম, কনক্লেভ প্রোগ্রাম আরো অনেক অনেক ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুর সাথে পাঠক চরম উত্তেজনা নিয়ে পরিচিত হতে থাকে। এর সাথে সাথেই লেখক সমানতালে খোলাসা করতে থাকেন গুপ্ত সংগঠন ইলুমিনাতির গোপন ক্রিয়া-কর্ম, সংগ্রাম, ষড়যন্ত্র, হত্যা এককথায় ঐতিহাসিক সব সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যান পাঠককে। রবার্ট ল্যাংডন চরিত্রটিই এই নিয়ে যাওয়ার কাজটি করে থাকে।

উপন্যাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল গুপ্ত সংগঠন ইলুমিনাতির গোপন কার্যকলাপ আর তাদের সংগ্রামের ইতিহাস সিম্বলের মাধ্যমে পাঠকের সামনে ধাপে ধাপে উন্মোচনের ব্যাপারটি। তাছাড়া বইয়ের শুরুর দিকেই লেখক পদার্থবিজ্ঞানের জটিল কিছু বিষয় অত্যন্ত সুন্দর ও সাবলীলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যা বইটির আকর্ষণ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

আর ভ্যাটিকান সিটির এক একটি অভিযানে কোডের ছড়াছড়ি, হত্যা আর সিম্বলিক জটে পড়ে যেনো পাঠকও দিশেহারা হয়ে যাবে। তবে শেষ কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার আগ পর্যন্ত পাঠক কোনোভাবেই আন্দাজ করতে পারবে না সত্যিই কি হতে যাচ্ছে! ঘুরে ফিরে চরম নাটকীয়তার পর শেষের দিকে যে অংশ পড়ে মনে হবে এটাই ফিনিশিং টাচ সেখান থেকেই আসলে মূল টুইস্টের শুরু।

ড্যান ব্রাউন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে ভালো লাগে সেসব ভিলেন, যারা ভুল কোনো আদর্শে সঠিক কাজ করে অথবা এর বিপরীতটি। ভালো ও খারাপের মাঝের ধোঁয়াটে-ধূসর অংশই আমার প্রিয়’। এই বইয়ের ভিলেনদের ক্ষেত্রেও তাঁর এই কথার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।

তাঁর লেখায় অনবরত মূল চরিত্রদের সঙ্গে আড়ালের কিছু চরিত্রের আপাত সংঘাতপূর্ণ খেলা চলতে থাকে। লিখতে গিয়ে ব্রাউন যেন ধর্ম আর বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব জগত নিয়ে মেতে ওঠেন। আর সেই জগতের জাদুতে পাঠককেও মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। বাস্তবতার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার এক চমৎকার মেলবন্ধনে তাঁর লেখাগুলো হয়ে ওঠে অনন্য।

ধর্মতত্ত্ব আর ইতিহাসের মারপ্যাঁচ সাথে বিজ্ঞানের যোগসূত্র, সব মিলিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া পাঠককে অবশেষে রবার্ট ল্যাংডন উদ্ধার করেন কোডব্রেকিং আর সিম্বলিক জট খোলার মধ্যে দিয়ে। এরকম লেখনীকেই হয়ত বলা যায় শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলার।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence