‘তোরাই আন্দোলন করে নেত্রীকে দেশ ছাড়া করেছিস’—কী ঘটেছিল জুবায়েরের সঙ্গে?
উদ্ভাস কোচিংয়ে ক্লাস নিতে গাজীপুর থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে গত ২০ অক্টোবর অপহরণের শিকার হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী এস এম আল জুবায়ের। এ সময় বিকাশ ও নগদসহ মানিব্যাগে থাকা অর্থ হাতিয়ে নেয় অপহরণকারীরা। ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হয়েছেন তিনি।
অপহরণের দু’দিন পর গতকাল বুধবার (২২ অক্টোবর) রাত ১২টায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঢাবি শিক্ষার্থীদের গ্রুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদে এক ভিডিও বার্তায় অপহরণের ঘটনা বর্ণনা দিয়েছেন জুবায়ের। তবে ঢাবি শিক্ষার্থী পরিচয় পাওয়ার পর ‘নেত্রীকে দেশ ছাড়া’ করায় ক্ষুব্ধ অপহরণকারীরা নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। একই সাথে ঘটনার দু’দিন গড়িয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা ছাত্র সংসদের নেতাদের পক্ষ থেকে সাড়া পাননি বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী এই শিক্ষার্থী।
ভিডিও বার্তায় জুবায়ের বলেন, ‘গত ২০ অক্টোবর আমি অপহরণের শিকার হয়েছি। আমি গাজীপুর থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে গাজীপুর বাইপাসের সামনে দাড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় একজন মাঝবয়সি লোক এসে আমার সঙ্গে বিভিন্ন আলাপ করতে থাকে। একপর্যায়ে আমি একটা গন্ধ পাই, তারপর আমার মাথা আর কাজ করে না। এরপর সেখানে একটা মাইক্রোবাস আসলে তিনি উঠে যান এবং আমাকে ডেকে বলেন, তুমি তো টাঙ্গাইল যাবে। তিনি এটা বলার পর আমি উঠলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমার আর কোন সেন্স কাজ করেনি। তাই আমি তাদের কারো মুখ মনে করতে পারছি না।’
অপহরণকারী চক্রে তিন থেকে চারজন ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মাইক্রোবাসে উঠার কিছুক্ষণ পর তারা আমার হাত, পা ও চোখ বেঁধে ফেলে এবং চড় থাপ্পড় মারতে থাকে। তারপর আমার মোবাইল ও ম্যানিব্যাগ কেড়ে নেয়। একে একে আমার নগদ, বিকাশ ও এটিএম কার্ডের পিন জানতে চায়। আমার বিকাশে ৯০০ এবং নগদে সাড়ে ৬ হাজার টাকা ছিল, সেটা তারা নিজেদের একাউন্টে ট্রান্সফার করে নেয়। আমার ব্যাগে সাত-আট হাজারের মত টাকা ছিল, সেটাও তারা নিয়ে নেয়। একই সাথে তারা আমার এটিএম কার্ডে কত টাকা আছে জানতে চায়। কিন্তু যখন আমি বলতে চাচ্ছিলাম না তখন তারা আমাকে আবার নির্যাতন শুরু করে।’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পরিচয় পেয়ে তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় বলে জানান জুবায়ের। এ সময় অকথ্য ভাষায় নানা হুমকিও দিতে থাকে তারা। জুবায়ের বলেন, ‘অপহরণকারীরা আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জানতে পেরে বলে, তোরা আন্দোলন করে আমাদের নেত্রীকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিস এবং তোদের জন্য আজকে দেশের এই অবস্থা, তোদের আন্দোলন তোদের * দিব। তারপর আবার আমাকে নির্যাতন শুরু করে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একটা পর্যায়ে এটিএম কার্ডের পাসওয়ার্ড বলতে বাধ্য হই। পাসওয়ার্ড জানতে পেরে একাউন্টে যে এক লাখ চৌদ্দ হাজার টাকা ছিল, তারা সে টাকাগুলো ট্রান্সফারের চেষ্টা করে। করতে পেরেছে কি না আমি জানি না।’
তিনি বলেন, ‘আমি সন্ধ্যা ৬টা বা সাড়ে ৬টার দিকে অপহরণ হই, তারপর রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার দিকে অপহরণকারীরা আমার আব্বুকে ফোন দিয়ে জানায়, আপনার ছেলে আমাদের পাঁচ-ছয় লাখ টাকা ক্ষতি করেছে, আপনি আমাদের এক লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দিব। আব্বু এক লাখ টাকা দিতে অস্বীকার করে এবং একপর্যায়ে পাঁচ হাজার টাকা দিতে রাজি হয়। তারপর অপহরণকারীরা আমাকে বলে, তুই যদি বাড়ি থেকে বা যেভাবে হোক ত্রিশ হাজার টাকা এনে দিতে পারিস তাহলে তোকে ছেড়ে দিব, নয়তো তোকে মেরে ফেলব। অপহরণকারীরা আমাকে ছুরি বের করে আমার গায়ে ধরে রাখে। একপর্যায়ে ভয় পেয়ে আমি রাজি হয়ে যাই। তারপর আমি আমার কাকাকে ফোন দেই এবং টাকা পাঠাতে বলি। ১০ টার পর কাকা টাকা পাঠিয়ে দেয়, টাকা পাওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা দিয়েছিল। কিন্তু পাঁচ-দশ মিনিট করতে করতে প্রায় দেড় ঘন্টা আটকিয়ে রাখে। এরপর গাজীপুর চন্দ্রার থেকে সাভার আসার একটি ইউটার্নে হাত, মুখ ও চোখ বেধে আমাকে ফেলে দেয়।’
সেখান থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির সহযোগিতায় ঢাকায় ফিরে আসেন জুবায়ের। বলেন, ‘ঢাকায় আসার পর আমার বন্ধুরা আমাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে প্রথমিক চিকিৎসা করায়। আমার শরীরে ও হাতে, পায়ে আঘাতের কারনে হাতের আঙ্গুল ভেঙে যায়। আমার মত আরো অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় কোচিং করায় তাদের নিরাপত্তা টা কোথায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শুনলে মনে হয় আরও বেশি মারে। দুই দিন হয়েছে হলে এসেছি, হল প্রসাশন, হলসংসদ বা ডাকসুর কোনো প্রতিনিধি কেউ আমার সঙ্গে দেখা করেনি। এখন আমার যে আইনি সহায়তা প্রয়োজন তারও কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি আমি নিজেই অনেক অসহায় বোধ করছি, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে যেখানে আমি নিরাপদ না সেখানে সাধারণ মানুষের কি অবস্থা?’