০২ নভেম্বর ২০২৫, ২২:২৭

১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি: বিএনপির সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা

মাহবুব নাহিদ  © টিডিসি সম্পাদিত

বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির যাত্রাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে বিএনপি একটি সাহসী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে, যার লক্ষ্য ২০৩৪ সালের মধ্যে দেশকে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত করা, যা একটি উন্নত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ার সুসংহত রোডম্যাপ। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতি আজ পরিবর্তিত যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে বিএনপি একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ ও স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, যেখানে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ ও আস্থাশীল পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সহকারে কাজ করতে পারবেন। বিএনপি যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, তখনকার সফল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বিএনপি আগামীতেও মুক্ত, বাজারভিত্তিক, নিয়মনিষ্ঠ ও ব্যাবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার চমৎকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছে, যা কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বহুমুখী উৎপাদন এবং জাতীয় আয়ের টেকসই বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।

বিনিয়োগভিত্তিক অর্থনৈতিক রূপান্তরের লক্ষ্যে বিএনপি এক বহুমাত্রিক ভিশন ঘোষণা করেছে, যাতে ফার্মাসিউটিক্যাল ও API(এপিআই) উৎপাদনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে স্বনির্ভরতা অর্জনের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ব্যাটারি উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়িয়ে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। সৃজনশীল শিল্প— চলচ্চিত্র, সংগীত, ডিজাইন— নতুন অর্থনৈতিক খাত হিসেবে গড়ে তোলা হবে, যাতে কর্মসংস্থান বাড়ে এবং সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ ও শিল্পভিত্তিক উৎপাদনে বিদেশি অংশীদারিত্বে নতুন খাত গড়ে তোলাও এই রূপরেখার একটি বিশেষ অংশ।

যুবসমাজকে কেন্দ্র করে, বিশেষত জেন-জেড(Gen Z)-এর জন্য, আইটি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও কারিগরি প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি করা হবে, যাতে তারা আধুনিক শ্রমবাজারে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। স্টার্ট-আপ সম্প্রসারণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে, অনলাইন নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করে প্রথম বছরেই অন্তত ১০ লক্ষ নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে উৎসাহ দেওয়া হবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ডেটা অবকাঠামো, সফ্‌টওয়্যার ও ইন্টারনেট ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তোলা হবে।

বিএনপি জিডিপিতে এফডিআই(FDI)-এর অংশ ০.৪৫% থেকে ২.৫%-এ উন্নীত করার বৃহৎ অথবা বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই লক্ষ্যে কর ও আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ও সহজতা আনা হবে, যাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিমুক্তভাবে কাজ করতে পারেন। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে "প্লাগ অ্যান্ড প্লে" পদ্ধতি চালু করে দ্রুত উৎপাদন শুরু করার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে।

লাভ প্রেরণ, ভ্যাট ও কাস্টমস রিফান্ড ডিজিটালাইজেশন, দ্বৈত কর নিরসন চুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে বৈদেশিক লেনদেন সহজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি শক্তিশালী করতে রোডশো আয়োজন করা, দূতাবাস কেন্দ্রিক প্রচার প্রচারণা বাড়ানো এবং ডেটাভিত্তিক ব্র্যান্ডিং কৌশল বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা আছে বিএনপির।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা ও সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে নতুন বিনিয়োগকারী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা, ১০ দিনের মধ্যে ভিসা ও পারমিট প্রদান করা, ৫ বছরের মাল্টিপল এন্ট্রি ইনভেস্টর ভিসা পদ্ধতি চালু করতে তাঁরা। সালিশ ও বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গঠিত হবে “বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালত”নামে নতুন প্রতিষ্ঠান।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা, আধুনিক বন্দর ও লজিস্টিক হাব তৈরি করা, উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বড়ো আকারের বিনিয়োগ করা হবে। প্রশাসনিক জটিলতা দূর করতে বিডার অধীনে কার্যকর ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা হবে, যার মাধ্যমে কোম্পানি নিবন্ধন ৪৮ ঘণ্টায় সম্পন্ন করা ও ওয়ার্ক পারমিট ৭ দিনের মধ্যে প্রদান করা সম্পন্ন হবে। এতে ঘুস ও অনিয়মের সুযোগ একদমই কমে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা/BIDA)-কে সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী হিসেবে ক্ষমতায়িত করা হবে এবং প্রতিটি প্রকল্পে একজন "এফডিআই(FDI) ক্যাপ্টেন” নিয়োগ দেওয়া হবে, যিনি বিনিয়োগের পুরো প্রক্রিয়ায় সহায়তা করবেন। দক্ষ জনবল গঠনে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যৌথভাবে ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা, বেতন, ভর্তুকি ও স্থানীয় নিয়োগে প্রণোদনা চালু করা হবে।

বিএনপি বিশ্বাস করে— বাংলাদেশকে একটি প্রতিযোগিতামূলক, নিরাপদ ও ভবিষ্যৎ-নির্ভর বিনিয়োগ গন্তব্যে রূপান্তরিত করা আসলেই সম্ভব। বিএনপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ক্ষমতায় আসার প্রথম ১৮ মাসে ১ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্যতম চালিকা শক্তি। এটি বাস্তবায়নে কৃষি, শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি ও সেবা খাতে প্রণোদনা দিলে অল্প সময়ে বিপুল কর্মসংস্থান সম্ভব, যা তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

বিনিয়োগকারীদের অভিজ্ঞতা উন্নত করতে ২৪x৭ অনলাইন হেল্পডেস্ক সার্ভিস চালু করা, তথ্য পোর্টাল ও দ্রুত সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হবে। লভ্যাংশ নিজ দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ ও স্বয়ংক্রিয় করা হবে। নির্দিষ্ট শিল্পখাতে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে তুলে স্থানীয় দক্ষ জনবল তৈরি করা হবে, যা বিদেশি কোম্পানিকে সহজে শ্রমিক সরবরাহ করবে এবং বেকারত্বও হ্রাস পাবে।

নিরাপত্তা নিশ্চিতে পৃথক বিনিয়োগ নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা, অর্থনৈতিক অঞ্চলে উন্নত রোড নির্মাণ, বিদ্যুৎ, ওয়াই-ফাই, নিরাপত্তা ক্যাম্প গড়ে তোলা হবে। একইসাথে, তথ্যপ্রযুক্তি, ভাষা, ব্যবস্থাপনা ও আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম চালু হবে। বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সরকার-পর্যায়ে নতুন চুক্তি, প্রশিক্ষণ ও প্লেসমেন্ট সাপোর্ট নিশ্চিত করা হবে।
কর আহরণে বলপ্রয়োগ একদমই গ্রহণযোগ্য নয়, যদিও করদাতার সম্মান ও আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে করজাল সম্প্রসারণ, অনলাইন ট্যাক্স ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও কর নীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে বিএনপির নীতি। এতে করে রাজস্ব বাড়বে, ব্যাবসার পরিবেশও হবে আরও অনুকূল।

বিনিয়োগবান্ধব ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে তারেক রহমান অতীতের সফল নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা খুব ভালো করেই জানি, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই ছিলেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথিকৃৎ, যাঁর শাসনামলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) আকৃষ্ট করতে প্রথম আইন প্রণয়ন করা হয়। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশের গার্মেন্টস খাতের ভিত্তি স্থাপনা হয়, যা পরবর্তীতে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের পরিচিতি তৈরি করে। একই ধারাবাহিকতায়, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার এবং বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ দিয়ে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলে। বিদেশ শ্রমবাজারেও বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় হয় এই সময়েই। এই ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে ধারণ করেই তারেক রহমান আগামীতে একটি উন্নয়নশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যেখানে বিনিয়োগ হবে উন্নয়নের চালিকাশক্তি এবং জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের প্রধান মাধ্যম।

বিএনপির শাসনামলে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও টেকসই অগ্রগতি সাধিত হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে (১৯৭৮-১৯৮১) যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয় "১৯-দফা কর্মসূচি", যেখানে স্বনির্ভরতা, গ্রামীণ উন্নয়ন, বিকেন্দ্রীকরণ ও মুক্তবাজার অর্থনীতির ওপর জোর দেওয়া হয়। এ সময় জিডিপি ১৩.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০.২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয় (৫২% বৃদ্ধি), জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.০৭% থেকে ৭.২৩%, মাথাপিছু আয় ১৫৮.৩২ ডলার থেকে ২২২.২৪ ডলারে (৪১.৬% বৃদ্ধি), এবং শিল্পখাতে মূল্য সংযোজন ১.৯০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪.০১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় (১১১% বৃদ্ধি)। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদে (১৯৯১-১৯৯৬) সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংস্কার ও বেসরকারি খাতের বিকাশের ফলে জিডিপি ৩০.৯৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৬.৪৪ বিলিয়ন ডলারে (৪৯.৯% বৃদ্ধি), মাথাপিছু জিডিপি ২৭১.০৬ ডলার থেকে ৩৭১.৯২ ডলারে (৩৬.৬% বৃদ্ধি), শিল্পখাতে মূল্য সংযোজন ৬.৫৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০.০৭ বিলিয়ন ডলারে (৫৪% বৃদ্ধি), এবং বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ১.৩৯ মিলিয়ন ডলার থেকে ১৩.৫৩ মিলিয়ন ডলারে (৮৭৩% বৃদ্ধি) উন্নীত হয়। ২০০১-২০০৬ সালে শিল্প ও বিনিয়োগ খাতে অগ্রগতি অব্যাহত ছিল, যদিও মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছিল। এই ধারাবাহিক উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেয় এবং বিএনপি ভবিষ্যতেও এই প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখে নতুন প্রজন্মকে একটি কর্মমুখী, অর্থনৈতিকভাবে নিরাপদ ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ উপহার দিতে বদ্ধপরিকর।

‘‘ঐক্যই ভবিষ্যৎ’’—এই বার্তাটিই হচ্ছে বিএনপি ওয়ান ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি অর্জনের বড়ো এক শক্তি। এটি একটি গভীর অর্থনৈতিক দর্শন, যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সহনশীলতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, এই তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। বিএনপি বিশ্বাস করে, জাতীয় ঐক্যের ভেতর থেকেই অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়ানো যায়, যা সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে নিয়ে যাবে। তাদের প্রস্তাবিত পরিকল্পনা কোনো সাধারণ রাজনৈতিক প্রচারণা নয়, এটি একটি সুপরিকল্পিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভবিষ্যৎমুখী অর্থনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন। যদি এই পরিকল্পনার বাস্তবায়নে যথাযথ রূপরেখা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ২০৩৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত করা শুধু সম্ভবই নয়, এটি হবে একটি নতুন যুগের অসামান্য বাস্তবতা।

লেখক: সাবেক ছাত্রদল নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক