প্রতি বছর একই সময় কেন পেঁয়াজের দাম বাড়ে?

পেঁয়াজ
পেঁয়াজ   © ফাইল ছবি

ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের খবরে হঠাৎ বাংলাদেশে দাম বেড়ে যাওয়ার মত ঘটনা গত কয়েক বছরে একাধিকবার ঘটেছে। দিন তিনেক আগে ৮ ডিসেম্বরেই এর উদাহরণ দেখা যায় দেশের পেঁয়াজের বাজারে। ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিক্রেতারা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেন প্রায় দ্বিগুণ।

সেদিন সকালেও যে পেঁয়াজ ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করছিলেন তারা, সন্ধ্যায় সেই একই পেঁয়াজ কেজিতে ২০০ থেকে ২২০, কোথাও কোথাও কেজি আড়াইশো টাকাও হাঁকতে শুরু করেন বিক্রেতারা।

বছরের এই সময়ে পেঁয়াজের বাজারে এরকম পরিস্থিতি ২০১৯ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছরই হয়ে আসছে বাংলাদেশে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে বাংলাদেশের বাজারে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম, যা নভেম্বর মাসে কেজি প্রতি আড়াইশো টাকা ছাড়িয়ে যায়। আবার ভারত থেকে আমদানি শুরু হলে দাম কমতে থাকে।

ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের পরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ব্যবসায়ীদের সাথে একটি আলোচনায় বলেছেন, কালোবাজারি করে একটি চক্র বাজার অস্থিতিশীল করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।

গত কয়েকদিনও পেঁয়াজ গুদামজাত করা ও অবৈধভাবে মজুদ করার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসায়ী, আড়তদারদের জরিমানা করেছে। বাজার বিশ্লেষক ও পেঁয়াজ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে দেখা গেছে প্রতি বছরের এই নির্দিষ্ট সময়ে ভারতের রপ্তানি বন্ধ করার সুযোগকে কাজে লাগায় পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের একটি অংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে নতুন পেঁয়াজ না ওঠা আর পুরনো পেঁয়াজের সরবরাহ কম থাকায় ব্যবসায়ীদের একটি অংশ পেঁয়াজ মজুদ করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়। এরকম সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সহ বিভিন্ন সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা দাম কমানোর পদক্ষেপ নেয়।

যেসব এলাকায় কর্তৃপক্ষ অভিযান চালায় সেখানে সাময়িকভাবে দামও কমে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হতে দেখা যায় না। প্রতি বছর একই সমস্যার উদ্ভব হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা যে কারণে
বাংলাদেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ পেঁয়াজের চাহিদা থাকে, তার সিংহভাগই দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ হয়। বছরে যে ৫ থেকে ৬ লক্ষ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয় তার অধিকাংশই আসে ভারত থেকে। ভারত ছাড়াও মিয়ানমার, মিশর, তুরস্ক, চীন থেকে বাংলাদেশে অল্প পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি হয়ে থাকে।

তবে ভারত থেকে সড়ক পথে পেঁয়াজ আনা সহজ হওয়া ও আমদানি খরচ কম থাকার কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ আমদানি কারক ভারত থেকে পেঁয়াজ আনেন বলে বলছিলেন ঢাকার শ্যামবাজারের একজন ব্যবসায়ী ও আমদানি কারক গোকুল কৃষ্ণ মানিক।

তিনি বলছিলেন, “ভারত থেকে পেঁয়াজ আসে স্থলপথে, ট্রাক দিয়ে। কিন্তু সেই পেঁয়াজ যদি মিসর বা তুরস্ক থেকে আনি তাহলে আনতে হয় জাহাজে। তখন খরচও বেড়ে যায় বেশ কয়েকগুণ, আর অনেকদিন জাহাজে থাকার ফলে পেঁয়াজ নষ্টও হয় বেশি পরিমাণ।”

এ কারণেই পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ভারত নিষেধাজ্ঞা দিলে বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দামে বড় ধরনের তারতম্য দেখা দেয় বলে বলছিলেন তিনি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পেঁয়াজ আমদানি না করে উৎপাদনে সমন্বয় করে ও বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশীয় পেঁয়াজ দিয়েই বাংলাদেশের পেঁয়াজের চাহিদা মেটানো সম্ভব।

প্রতি বছর কেন দাম বাড়ে?
বাংলাদেশে পেঁয়াজের উৎপাদনের বিষয়টি নিয়ে কাজ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মসলা গবেষণা কেন্দ্র। এই সংস্থার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার পেঁয়াজ চাষ সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখেন।

তিনি বলছিলেন, “বাংলাদেশে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টাতে সাধারণত পেঁয়াজের ঘাটতি থাকে, যে সুযোগ কাজে লাগিয়ে মজুদদাররা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করে।”

তিনি বলছিলেন, “দেশীয় উৎপাদনের বড় অংশ হয় বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে। সেসময় মোট দেশীয় উৎপাদনের ৮০ ভাগ পেঁয়াজ কৃষক ঘরে তোলে। তাই পেঁয়াজের দাম মার্চ-এপ্রিলের দিকে সবচেয়ে কম থাকে।”

মার্চ-এপ্রিলে হওয়া এই পেঁয়াজই বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রধান পেঁয়াজ। এটি ছাড়াও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে হওয়া মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও জুন-জুলাইয়ে অল্প পরিমাণ গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ হয়ে থাকে বাংলাদেশে। সেপ্টেম্বরের পর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজের ফলন হওয়ার আগের এই সময়টায় বাজারে পেঁয়াজের কিছুটা ঘাটতি থাকে বে বলছিলেন মি. মজুমদার।

“নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে দেখা যায় অধিকাংশ কৃষকের কাছে পেঁয়াজের মজুদ থাকে না। কিন্তু মজুদদারদের কাছে পেঁয়াজ থাকে তখন। এই সময়ে তারা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার ও দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে।”

দেশীয় উৎপাদন ও চাহিদার সমন্বয়
বাংলাদেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৭-২৮ লাখ টন, যার পুরোটাই বাংলাদেশের দেশীয় উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়েই পূরণ করা সম্ভব বলে মনে করেন শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার। তাম মতে, বছর জুড়ে পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলে কৃষক সঠিক দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে। আর তাহলে বাংলাদেশেই বছরে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

তিনি উদাহরণ দিচ্ছিলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদার প্রায় পুরোটা উৎপাদন করা হয়েছিল। কিন্তু ঝুঁকি এড়াতে সে বছরও ছয় লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। ফলে পেঁয়াজের যোগান হয়ে যায় চাহিদার চেয়ে বেশি। আর এর কারণে বিপুল পরিমাণ দেশীয় ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়।

সেবছর কৃষকরা দেশীয় পেঁয়াজের দাম কম পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন অনেক কৃষক। যার ফলে পরের বছর অনেক কৃষক পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, ফলস্বরূপ পরের অর্থবছরে (২০২২-২৩) পেঁয়াজের উৎপাদনও কমে যায়।

“বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পেঁয়াজের দাম যদি নির্ধারণ করে দেয়া যায় - যেমন মার্চ-এপ্রিলে ৫০ টাকা, জুন-জুলাইয়ে ৬০ টাকা ও বছরের শেষদিকে ৭০ টাকা - তাহলেই কৃষক নির্দিষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ ফলাতে উৎসাহিত হবে।”

ড. মজুমদার মনে করেন, কৃষকের চাষাবাদের খরচ বিবেচনায় রেখে মিয়ানমারের মতোও পেঁয়াজের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ একটি দাম নির্ধারণ করে দেয়া উচিত, যাতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। লাভজনক হলে প্রতিবছরই কৃষকরা পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হবেন, ঘাটতিও কমে আসবে।

এর পাশাপাশি পেঁয়াজ সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতির ব্যবস্থা করা, কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া, অন্য ফসলের সাথে পেঁয়াজ চাষ করতে কৃষকদের উৎসাহ দেয়া, কৃষকদের জন্য ভালো ও উন্নত বীজ সরবরাহ করা গেলে পেঁয়াজে কয়েক বছরের মধ্যেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে বাংলাদেশ।

দাম নিয়ন্ত্রণে তাগিদ
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ-ক্যাব এর মতে বাজারে সরকারের নজরদারি বাড়ানো গেলে ও ব্যবসায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেলে পেঁয়াজের দাম নিয়ে প্রতি বছর এই পরিস্থিতি তৈরি হবে না।

ক্যাবের সহ সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, “আমরা বারবার বলেছি সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটা বার্ষিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। কখন আমদানি করবে আর কখন দেশীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা পূরণ হবে, এরকম উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।” [সূত্র: বিবিসি বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ