নিজের আয় দিয়ে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন ছিল রিয়াদের
২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল সারা বাংলাদেশ। ‘যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ চাই’—এই দাবিতে রাজপথে নেমেছিল হাজারো তরুণ, ছাত্র, স্বপ্নবাজ প্রাণ। তাদেরই একজন ছিলেন ১৯ বছরের শিক্ষার্থী রেদোয়ান শরীফ রিয়াদ। কিন্তু একটি বুলেট এসে থামিয়ে দেয় তার জীবন, তার স্বপ্ন, তার পরিবারের ভবিষ্যৎ।
নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে জন্ম রিয়াদের। বাবা আহম্মদ উল্লাহ বাদল ও মা রুপালী আক্তারের একমাত্র ছেলে ছিল সে। তার ছিল একটি মাত্র বড় বোন—সিমু আহম্মেদ। আজও কাঁদতে কাঁদতে বোন বলেন, ‘রিয়াদ ছোট থেকেই খুব ম্যাচিউরড ছিল। বাবা-মায়ের সামর্থ্যের বাইরে কিছু চাইত না। এখন সব স্বপ্ন এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে।’
গ্রামের ছেলে রিয়াদ ভর্তি হয় ঢাকার টঙ্গী সরকারি কলেজে। ইংরেজি বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছিলেন। সংসারের সীমিত উপার্জনের মধ্যে মা-বাবা ছেলেকে শহরে নিয়ে আসেন, ভাড়া বাসা নেন উত্তরা এলাকায়। তাদের বিশ্বাস ছিল, ছেলে একদিন কিছু করে দেখাবে।
আরও পড়ুন: ‘স্বৈরাচার হাসিনা আমার সুখের সংসারটা তছনছ করে দিছে—আমি তার ফাঁসি চাই’
রিয়াদের দিন কাটতো ক্লাস, খাতা আর ক্রিকেটে। যে যন্ত্রণা সে দেখে বড় হয়েছে, তা দূর করার স্বপ্নে জ্বলছিল চোখ। প্রায়ই বলত— লেখাপড়া শেষ করেই একটা চাকরি পাবো, মা-বাবার কষ্ট আমি কমাবো।
কিন্তু সেই পথচলা থেমে যায় ১৯ জুলাই ২০২৪, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে। ঢাকার একটি আন্দোলনে বন্ধুদের সঙ্গে অংশ নিতে যায় রিয়াদ। সে রাজনীতি করতো না, কিন্তু মেধাভিত্তিক সমাজ গড়ার স্বপ্নে পাশে দাঁড়িয়েছিল সহপাঠীদের। হঠাৎ পুলিশের গুলি—একটি সরাসরি এসে লাগে তার মাথায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রিয়াদের।
তার মা বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে উঠে রিয়াদের বিছানার দিকে তাকাই। জানি ও নেই, কিন্তু মন মানে না। বই, জামা, ব্যাগ সব আগের মতোই পড়ে আছে। আমি শুধু ওর গায়ের গন্ধ খুঁজে বেড়াই। যেন আবার এসে ডাক দেবে—‘মা, খাইনি এখনো।’
আরও পড়ুন: গুলি করে হত্যার পর দ্রুত লাশ দাফন করতে ছাত্রলীগ-প্রশাসনের হুমকি
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।