১০ নভেম্বর ২০২৫, ১৯:৩৮

সোনার দাম যেভাবে ঠিক হয়

সোনার বার  © সংগৃহীত

মানবসভ্যতার ইতিহাসে সোনা কেবল একটি ধাতু নয়—এটি আস্থা, মূল্য ও মর্যাদার প্রতীক। যুগ যুগ ধরে রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সোনা ব্যবহার করেছে সম্পদ সংরক্ষণ ও সামাজিক মর্যাদা প্রদর্শনের উপায় হিসেবে। কিন্তু আজকের দিনে আমরা যেভাবে প্রতিদিন খবরের কাগজে ‘স্বর্ণের দাম বেড়েছে’ বা ‘সোনার বাজারে ধস’ দেখি, সেই দামের পেছনে আসলে কীভাবে হিসাব কাজ করে? কে বা কারা ঠিক করে প্রতিগ্রাম বা প্রতি ভরির দাম? জেনে নেওয়া যাক সোনার দামের নির্ধারণ প্রক্রিয়া।

আন্তর্জাতিক বাজারে শুরু হয় সোনার মূল দাম
সোনার দাম নির্ধারিত হয় আন্তর্জাতিক বাজারে, বিশেষ করে লন্ডন বুলিয়ন মার্কেট অ্যাসোসিয়েশন (LBMA) এবং কমেক্স (COMEX) নামের দুটি বড় স্বর্ণবাজারে। প্রতিদিন এই বাজারগুলোতে লেনদেন হয় টনকে টন সোনার, এবং সেই দরই সারা বিশ্বের জন্য মূল নির্দেশক হিসেবে কাজ করে।

লন্ডন ফিক্সিং সিস্টেম নামে একটি প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন দুইবার, বাংলাদেশ সময় বিকেল ও রাতের দিকে—বিশ্বব্যাপী সোনার দাম নির্ধারণ করা হয়। এই দামে আন্তর্জাতিক লেনদেন, আমদানি, রিজার্ভ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রয়-বিক্রয় পরিচালিত হয়।

ডলারের মান ও সোনার দাম
স্বর্ণের আন্তর্জাতিক দাম নির্ধারণের মূল মুদ্রা হলো মার্কিন ডলার। তাই ডলারের মান কমলে সোনার দাম সাধারণত বেড়ে যায়, আর ডলার শক্তিশালী হলে সোনার দাম কিছুটা পড়ে যায়। কারণ, ডলারের মান কমে গেলে বিনিয়োগকারীরা বিকল্প নিরাপদ সম্পদ হিসেবে স্বর্ণের দিকে ঝোঁকে।

চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য
যেকোনো পণ্যের মতই স্বর্ণের দাম নির্ভর করে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। উৎসব, বিয়ের মৌসুম বা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় স্বর্ণ কেনাবেচা বেড়ে যায়, ফলে দাম বাড়ে। আবার, যখন বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বাজার বা বন্ডে বেশি ঝুঁকে পড়ে, তখন স্বর্ণের চাহিদা কমে, দামও কমে। নতুন খনি আবিষ্কার বা উৎপাদন বৃদ্ধিও বাজারে সোনার সরবরাহ বাড়িয়ে দাম কিছুটা নামিয়ে দিতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি
বিশ্বের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিপুল পরিমাণ সোনা মজুত রাখে। তারা যদি হঠাৎ করে সোনা বিক্রি শুরু করে বা বিপরীতে আরও কিনে নেয়, তবে বাজারে দামের বড় প্রভাব পড়ে। আবার যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সময় বিনিয়োগকারীরা সোনা কেনে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে। এই পরিস্থিতিতে স্বর্ণের দাম দ্রুত বেড়ে যায়।

বাংলাদেশে সোনার দাম যেভাব ঠিক হয়
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) স্থানীয় দাম নির্ধারণ করে। প্রতিবার যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ে বা ডলার ও আমদানি খরচ বৃদ্ধি পায়, তখন বাজুস সেই অনুযায়ী ভরিপ্রতি দাম সমন্বয় করে ঘোষণা দেয়।
দামের এই পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে-
আন্তর্জাতিক স্বর্ণমূল্য
ডলারের বিনিময় হার
আমদানি শুল্ক ও ট্যাক্স
স্থানীয় চাহিদা ও সরবরাহ

সোনার দাম আসলে এক জটিল সমীকরণের ফল। আন্তর্জাতিক বাজার, ডলারের মান, বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্ব, এমনকি যুদ্ধ বা রাজনৈতিক টানাপোড়েন—সবকিছুই এই এক টুকরো ধাতুর দামে প্রভাব ফেলে। তবুও, হাজার বছরের পুরনো এই ধাতুটি এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ও স্থিতিশীল বিনিয়োগ হিসেবে মানুষের বিশ্বাস ধরে রেখেছে। সোনার ঝলক তাই কেবল অলঙ্কারে নয়, অর্থনীতির প্রতিটি স্তরেই আজও সমান উজ্জ্বল।