আমিও ছাত্রী, ‘টাকায় নিয়োগ দেওয়া লেবার’ নই

একজন লিখেছেন, ‘টিউশনি নিরীহ পেশাদারদের কাজ। এদেরকে অপমান করলেও সইতে হয়। কারণ যদি টিউশনিটা চলে যায়। কখনো স্টুডেন্টের বাবা মা, কখনো পরিবারের অন্য কারো যেকোন কথা মুখ বুজে সইতে হয়।’

ছাত্র জীবনে টিউশনি করানোর এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। অভিজ্ঞতাগুলো কখনো তিক্ত, কখনো মজার। তবে বেশির ভাগ সময় তিক্ত গল্পগুলোই আমাদের কানে আসে। এই যেমন ছাত্রের বাবার বক্তব্য- ‘আরেকটু বেশি সময় দেয়া যায় ক-না? কিংবা বড়টার পাশাপাশি ছোট টাকেও একটু দেখিয়ে দেয়া যায়? তারপরও টিউশনি অনেকে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার মাধ্যম। কারো বা তিনবেলা ভাত খাওয়ার অবলম্বন। এমনই দুটো দুঃখ ও সুখস্মৃতির গল্পের সমন্বয়ে এই প্রতিবেদন।

প্রথমেই সুমি আক্তারের এমনই টিউশনির অভিজ্ঞতার গল্প তুলে ধরা হলো দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য। তিনি বলছেন, ‘সদ্য ছেড়ে দেওয়া টিউশনের আন্টিকে নিচের দীর্ঘ মেসেজটি পাঠিয়েছি।’

‘আন্টি ও আংকেল,
আসসালামু আলাইকুম। বুকভরা কষ্ট নিয়ে আপনাদের লিখছি। আগামী ১৩-১৫ তারিখ আমার ডিপার্টমেন্টের বাধ্যতামূলক ফিল্ড ট্যুরের কারণে আমি মাত্র ৩টা দিন পড়াতে আসতে পারবো না বলায় (আন্টি) আপনি যে রিয়েক্ট করেছেন; তাতে আমি প্রচন্ড অবাক হয়েছি। কাল থেকে স্বপ্ন'র থার্ড মডেল টেস্ট বলে আপনি বলে বসলেন পরীক্ষা চলাকালীন কোন গ্যাপ দেওয়া যাবে না, আসতেই হবে। না হয় আপনি অন্য ব্যবস্থা নিবেন!

সত্যি বলতে কি, এতদিন আংকেলের এই টাইপের ঝালমিশ্রিত তিক্ত কথাগুলো চুপ হয়ে শুনতাম। উনি হজ্বে গেলেন, কিন্তু আপনি এবার দৃশ্যপটে এসে হাজির হলেন একই রুপ নিয়ে।

আরে! একটা জিনিস বুঝলেন না যে, আমিও তো স্টুডেন্ট! পরীক্ষা আমারও তো হয়। তবুও কোনদিনও তো বাদ দিইনি। শত কষ্ট হলেও এসেছি। এটা ফাইনাল এক্সাম হলে এক কথা ছিলো, জাস্ট মডেল টেস্ট! ভাবতেই পারছি না পিএসসি এক্সামের সময় একটা দিন কোন কারণে আসতে না পারলে কী করবেন, কী কী বলে ফেলবেন আমায়!

আমি যখন প্রথম আপনাদের বাসায় টিউশনে যোগ দিই; তখন আমার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিলো খুবই নাজুক। একটা মাত্র টিউশনের টাকা দিয়ে আমি ভালোমতো চলতে পারছিলাম না। তাই সপ্তাহে ৫দিন, মিনিমাম দু’ঘন্টা পড়ানো, অথচ বেতন ৪৫০০ টাকার অদ্ভুত শর্তে আমি সম্মত হয়েছিলাম।

একই সাথে আমি ক্লাস ফাইভ থেকে অন্য যে টিউশনটা পড়িয়ে আসছি ওটায় বেতন দিতো ৪দিনে ৪৫০০/-, সময় ১ঘন্টা,টাইমিংইচ্ছেমতো। আলহামদুলিল্লাহ, আমার স্টুডেন্ট পিএসসিতে গোল্ডেন পেয়েছিলো, যেটা তার ফ্যামিলির প্রত্যাশাতীত।

ফলস্বরুপ আমি সিক্স শেষে সেভেনেও পড়াচ্ছি ওকে। বেতন বেড়ে ৫হাজা ৫০০ টাকা এখন। যেতে হয় তিন দিন, পড়াই ৪ সাবজেক্ট মাত্র। তবে আমি সেই তিন দিনে এমনভাবে পড়াই, যাতে স্টুডেন্টের সব পড়া কাভার হয়ে যায়। কারণ আমি উনাদের আচরণে প্রচন্ড সন্তুষ্ট। উনারা আমার উপর আস্থা রেখেছিলেন, কখনো প্রেসার ক্রিয়েট করেননি। আমিও তাই মনপ্রাণ উজাড় করে বুঝাই, পড়াই।

সে যাই হোক, ভার্সিটিতে সারাদিন ক্লাস করে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়েও আপনাদের সুবিধামতো সময়ে সপ্তাহে ৫দিন,২ঘন্টা করে স্বপ্নকে পড়ানো কন্টিনিউ করেছি। আমি জানি না, এত অল্প টাকায় চিটাগাং ইউনিভার্সিটির অন্য কোন স্টুডেন্ট এমন আজব শর্তে ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট পড়ায় কি না। এই টিউশনের বেতন ও টাইমিং কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেও লজ্জা হতো। বাধ্য হয়েই কন্টিনিউ করছিলাম, কারণ আমার হাতে অন্য টিউশন নেই।

কন্টিনিউ করার পেছনে আরেকটা কারণ হলো স্বপ্ন ছেলেটা খুবই নম্র, ভদ্র ও মেধাবী। তাকে পড়াতে আমার খুবই ভাল লাগতো। যা পড়াই, পড়তো, বুঝতো। যা শিখতে দিতাম, শিখে ফেলতো। সেজন্যই ওর এত অল্প সময়ে এত ইমপ্রুভমেন্ট। আমি যখন ওকে প্রথম পড়াতে গেছিলাম তখন দেখি টাইম টেবলও জানে না ভালমতো, পারতো না গুণ, ভাগ। এমনকি যোগ-বিয়োগও ভুল করতো অনেক সময়। বাংলা তো রিডিংই পড়তে পারতো না ভাল করে।

আলহামদুলিল্লাহ। সে এখন সব পারে, খুব ভালমতোই পারে। পিএসসির সিলেবাস ওকে শেষ করাই দিছি। এখন জাস্ট নতুন স্যারের কাছে আমি যা পড়াইছি তা একটু রিভাইজ করে পড়লেই হবে। আমার আর আসার প্রয়োজন হবে না আশা করি। সে নিশ্চয়ই ভাল রেজাল্ট করবে। এটা আমার প্রত্যাশা। আমার দোয়া থাকবে তার জন্য। খুব প্রিয় একটা স্টুডেন্ট ছিলো সে। খুব মিস করবো তাকে।

আপনারা ভাল থাকবেন। আর হ্যাঁ, বাসার টিচারদের একটু কম প্রেশার দিবেন। ‘ঠিক এই এই সময় আসতেই হবে, না আসলে হবে না,পরীক্ষার সময় প্রতিদিন আসতে হবে’ টাইপ কথা বলিয়েন না প্লিজ। কোন টিচারই ইচ্ছে করে ফাঁকি দিতে চায় না। ওদেরও সুখ-দুঃখ আছে,ব্যস্ততা আছে, আছে নিজের পড়াশোনা। অর্থ সংকটে পড়ে টিউশন করা স্টুডেন্টদের সাথে ‘টাকায় নিয়োগ দেওয়া লেবার’ হিসেবে বিহেভ করবেন না দয়া করে। এতে আমাদের খুব কষ্ট হয়, খুব বেশি।

টিউশনির সুখস্মৃতি
‘তুই তো আমার ছেলের মতো, তোর মাঝেই হারিয়ে যাওয়া রাজুকে খুঁজে পাই’

যশোর এম এম সরকারি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া ছাত্র মো. আল-আমিন রাব্বী। তিনি লিখেছেন, ‘আজ সকালে ছাত্রীকে পড়াতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি উনি রেডি হয়ে বসে আছেন। আমি বললাম কী ব্যাপার পড়বা না আজ? কোথাও যাবে না-কি? ম্যাডাম বললেন, জি স্যার; ক’দিন পরে তো ঈদ। আমার তো কিছুই কেনা হয়নি। আমি বললাম পড়ে যাও। তা উনি না-কি আজ পড়বেন না। আমার খুব রাগ হলো। রোজার মাসে ৫ কি:মি সাইকেল চালিয়ে আসলাম। আমি তাকে বললাম, একবার ফোন দিলে আসতাম না। ও কিছু না বলে হাসতে শুরু করলো।

বলে রাখি- ওর সাথে আমার অনেক ভাল সম্পর্ক। ওর হাসি দেখে আমার খুব রাগ হলো। একটু বকাও দিলাম। বকা দিতেই আঙ্কেল চলে আসল; উনিও মজা নিচ্ছেন। বললেন- কি বাবা ও আজও পড়া পরেনি? বলেই কি অট্ট হাসি বাবা-মেয়ের। আন্টিও চলে আসলেন; তিনিও হাসা শুরু করলেন। মনে মনে ভাবলাম আমি হয়তো পাগলাগারদে আছি। যত সব পাগল। আন্টি বললেন- বাবা সাইকেলটা গ্যারেজে উঠিয়ে দাও।

এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। কেন আন্টি? উত্তর আমার পন্ডিত ছাত্রী দিল। আপনিও যাচ্ছেন আমাদের সাথে। আন্টি বললেন- আমাদের একটা ছেলে আছে ওর জন্য কিছু কিনব। আমরা তো আর তেমন বুঝব না। তুমি একটু চলো। কী আর করা; চললাম। আন্টি আঙ্কেল আর পন্ডিত পিছনে বসল। আমি সামনে ড্রাইভারের পাশে। রাগ হচ্ছিল খুব। ফালতু সময় নষ্ট। কিন্তু কিছু করারও নেই। উনাদের টাকায় আমার সংসার চলে। বলে রাখি আমি সংসারে একা। যশোর এর বড় শপিং কমপ্লেক্স সিটিতে নিয়ে গেলেন। উনাদের জন্য অনেক কিছুই কিনলেন। বড় লোকের এলাহি কারবার।

সব শেষে উনার ছেলের জন্য কেনার পালা। অনেক ঘুরে দুইটা শার্ট আর একটা প্যান্ট পছন্দ করলাম। শার্ট শেষ পর্যন্ত একটা সিলেক্ট করলাম। আর একটা প্যান্ট। শেষে জুতা কেনার পালা। বললো জুতা কোথা থেকে নেওয়া যায়? বললাল আ্যাপেক্সে চলুন। ওখানে অনেকবার গিয়েছি। জুতা পছন্দও করা ছিলো। টিউশনে টাকা পেলে ওটা নিতে চেয়েছিলাম। কি আর করা ওটাই নিলাম ওই ছেলের জন্য। উনারাও অবাক, গিয়েই কোনার ওই জুতাটা কেন নিলাম? আমি বললাম আগেও এসে দেখেছি জুতাটা। বলেও ফেললাম ওটা আমিও নিব। উনারা খুশি হয়ে ওই জুতাটাই উনার ছেলের জন্য নিলেন। অবশেষে ফিরে এলাম ছাত্রীর বাসায়।

ওনার ছেলের অনেক ছবি দেখেছি। তবে সব ছোট বেলার ছবি। আবার আমাকে ৫ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হবে। খুব কষ্ট হচ্ছিল। সাইকেল নিতে যাব; এমন সময় ছাত্রী পিছনে এসে দাঁড়াল। বললো আপনাকে ডাকে আম্মু। অগত্যা যেতে হলো। গিয়ে দেখি আন্টি কান্নাকাটি করতেছে। আমারও মন খারাপ হয়ে গেল।

আন্টি বললো- বাবারে আজ আমার ছেলে থাকলে তোমার মতো বড় হত। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। ওই দিন জানতে পারলাম উনার ছেলে ১২বছর বয়সে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এবার আন্টি তিনটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আরও জোরে কাঁদতে লাগল। এটা তোর জন্য কিনেছি। তুই তো আমার ছেলের মতো। তোর মাঝে আমি রাজুকে খুঁজে পায়। বলে আবার কাঁদতে লাগল। আমি নির্বাক। আসার আগে হাতে বেতনের খামটা ধরিয়ে দিল।

আমি রাস্তাতে চলে আসলাম। আর ভাবতে লাগলাম শুধু শুধু নিজেকে ছোট ভাবি। ৫ কিলোমিটার যে কখন চলে আসলাম। রুমে এসে খামটা খুলে টাকাটা বের করে আগে গুনলাম। এমনি আমার বেতন দেয় ৬ হাজার ৫০০ টাকা। এবার একটু বেশি দিয়েছে বোনাসসহ ১০হাজার টাকা। আমি নিজে খুব খুশি হলাম। কিন্তু মনটা পড়ে রইলো আন্টির কাছে। কত বিচিত্র এই পৃথিবী। কত বড় লোক কিন্তু কত কষ্ট তাদের! আমার হয়তো কিছু নেই; কিন্তু আমার জগতে আমিই সবচেয়ে সুখী মানুষ।

পড়ুন: বুয়েট ছাত্রদলের ভিপি ছিলেন বালিশ মাসুদুল: প্রধানমন্ত্রী


সর্বশেষ সংবাদ