মাসুম এখন দুই বিসিএসের ক্যাডার
- সিয়াম হাসান
- প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ PM , আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:২০ PM
৪৩তম বিসিএসে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জহিরুল ইসলাম মাসুম। পড়াশুনা শেষ করার পরও তার কোনও পরিকল্পনা ছিল না বিসিএসের জন্য। টিউশন করানোর ব্যস্ত জীবন থেকে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন বিসিএস দেবেন। কোনও কোচিং না করে নিজের মতো করে প্রস্তুতি নেন। একপর্যায়ে হয়ে যায় জনতা ব্যাংকে চাকরি। ৪১তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করে ক্যাডার হন। আর ৪৩তম বিসিএসে হলেন পুলিশ ক্যাডার।
মাসুমের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার নন্দের ছটি গ্রামে। বাবা আব্দুল খালেক পেশায় কৃষক। মায়ের নাম মোমেনা খাতুন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। মাসুম কলসিন্দুর হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক ময়মনসিংহের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে পাস করেন। ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়বেন। সে আশায় কোচিংয়ে ভর্তি হন। ভর্তি পরীক্ষায় শুধু বুয়েট, কুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন।
বুয়েটে চান্স না পাওয়ায় হতাশ হয়েছিলেন। তবে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে ২০১৩-১৪ সেশনে ভর্তি হন কুয়েটে। পড়াশুনা শেষ করে ব্যস্ত হয়ে পড়েন টিউশনির নেশায়। ২০২০ সালে এসে সিদ্ধান্ত নেন বিসিএস দিবেন। কোনও কোচিং না করে নিজেই প্রস্তুতি নেন। প্রস্তুতি নেওয়াকালীন চাকরি হয় জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে। ৪১তম বিসিএসে প্রথম অংশগ্রহণ করে পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। আর ৪৩তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হন পুলিশ ক্যাডারে।
মাসুম বলছিলেন, স্কুল জীবনের প্রথম অর্জন ছিল পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া। সন্তান হিসেবে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলাম। সবার দোয়ায় জিপিএ-৫ নিয়ে মাধ্যমিক পাস করি। আর জীবনের বড় ডিসিশনটা নিয়েছিলাম তখনি। অনেক ইচ্ছা আর বাসনা ছিল, গ্রাম ছেড়ে শহরের ভালো কোনো কলেজে ভর্তি হব। ময়মনসিংহের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজে ভর্তি হই। এবারও জিপিএ-৫ পেয়ে যাই। জীবন যুদ্ধটাকে কোন দিকে নিয়ে যাব, সেটাই চিন্তা করছিলাম।
অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আশায় কোচিংয়ে ভর্তি হন জানিয়ে তিনি বলেন, মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট, কুয়েট ও ঢাবি) আবেদন করি। যখন বুয়েটের পরীক্ষায় আমার রোল ছিল না, তখন অনেক মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু আত্মবিশ্বাস ঠিকই ছিল। তাই আল্লাহ আমাকে হতাশ করেনি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্নটাকে বাস্তবায়ন করতে ভর্তি হয়ে যাই কুয়েটে।
২০২০ সালে এসে সিদ্ধান্ত নেন বিসিএস দিবেন। কোনও কোচিং না করে নিজেই প্রস্তুতি নেন। প্রস্তুতি নেওয়াকালীন চাকরি হয় জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে। ৪১তম বিসিএসে প্রথম অংশগ্রহণ করে পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। আর ৪৩তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হন পুলিশ ক্যাডারে।
পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশনির বিষয়ে মাসুম বলেন, ২০১৪ সালে শুরু হয় আমার টিউশন লাইফ। দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হতো। একটা সময় পরিবারকেও সাপোর্ট করা শুরু করি। দেখতে দেখতে ভার্সিটি লাইফও শেষ হয়ে গেল। ২০১৮ সাল। পকেটে মাত্র ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে খুলনা থেকে ময়মনসিংহে আসি। এখন চাকরিতে যোগদান করার পালা। অনেক ফ্যাক্টরি ও কোম্পানিতে সিভি ড্রপ করি। বাট কোনো রেসপন্স পাইনি। এইভাবে কেটে যায় ৪-৫ মাস। হাত সম্পূর্ণ খালি।
একরাশ হতাশা কাজ করছিল জানিয়ে তিনি তিনি বলেন, পরিচিত একজনের মাধ্যমে ময়মনসিংহ শহরেই প্রথম একটা টিউশনি পাই। আমি তখন অনেক খুশি হয়েছিলাম। একই মাসে আরও একটা ব্যাচ পেয়ে যাই। আর পেছনে তাকাতে হইনি আমাকে। ভার্সিটি শেষ করে সবাই যেখানে জব প্রিপারেশন নিচ্ছিল, আমি সেখানে টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত। টিউশনিটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। দিনে ১৩-১৪ ব্যাচ পড়াতাম। স্টুডেন্ট ছিল মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের।
বিসিএস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ২০২০ সালে করোনা সময়ে সব লকডাউন হয়ে গেল। সব ব্যাচ বন্ধ করে দিয়ে ৪-৫টি ব্যাচ অনলাইনে চালু রাখেন। সারাদিন ঘরে বসে যখন বোরিং সময় পার করছিলাম, ঠিক তখনি বিসিএস দেওয়ার ইচ্ছা জাগে জানিয়ে মাসুম বলেন, করোনার সময়ে শুরু করি জব প্রিপারেশন। বিসিএস টার্গেট নিয়ে পড়া শুরু করি। কোনো কোচিংয়ে ভর্তি না হয়ে সম্পূর্ণ টাইম নিজেই নিজের মতো গুছিয়ে নিয়ে পড়েছি।
৪১ ও ৪৩তম বিসিএসের প্রিলি ও রিটেন দেওয়ার পর ২০২২ সালে জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জব হয় মাসুমের। চাকরিরত অবস্থায় দুই বিসিএসের ভাইভা দেন। ৪১তম বিসিএসের রিটেনের জন্য খুব ভালো প্রিপারেশন নিতে পারেননি। তারপরও ৪১তম বিসিএসে ফ্যামেলি প্ল্যানিং ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। কয়েক মাস পরই ৪৩তমতে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
তিনি বলেন,আসলে কোনো একটা জিনিস মন থেকে চাইলে এবং সে লক্ষ্যে ঠিকভাবে পরিশ্রম করলে সফলতা ধরা দেয়। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসেছি। আমার গ্রামের আমিই প্রথম বিসিএস ক্যাডার। আমার বাবা-মা সবসময় আমার মেন্টর ও স্ট্রং সাপোর্টার ছিলেন। যখন হতাশা কাজ করতো, তখন বাবা পাশে থাকতেন। সব সময় ফোন করে খোঁজ নিতেন। ৪৩তম বিসিএসে আমার জীবনের সেরা কষ্টটাই আমি করেছিলাম।
মাসুম বলেন, ভালো পরীক্ষা দিয়েছিলাম বলে বাবা ৪৫তম বিসিএসের রিটেন দিতে বারণ করে দিয়েছিল। কারণ আমার থেকে আমার বাবার কনফিডেন্ট বেশি ছিল। ছোট থেকেই তারা আমার জন্য যা করছেন, সে ঋণ কখনোই শোধ হবেনা। তাদের দোয়া আর বিশ্বাসের জোরেই হয়তো আল্লাহ আমাকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন।
আরো পড়ুন: স্নাতকের পর এবার স্নাতকোত্তরেও স্বর্ণপদক পাচ্ছেন ইস্ট ওয়েস্টের সুমনা ইয়াছমিন
তিনি আরও বলেন, আমার স্ত্রীর সাবিকুন নাহার বিসিএস জার্নির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার সাথেই ছিল। যদি কেউ আমার সম্পর্কে ভালো বলতে পারে, সেটা আমার স্ত্রী।জব প্রিপারেশনের সময় আমার সবচেয়ে প্লাস পয়েন্ট ছিল, পড়াশোনা করার জন্য অনুকূল পরিবেশ। যেখানে আমার স্ত্রীর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। ঘরে বাইরে দু’দিক সমানভাবে পরিচালনা করেছিল। বিশেষ করে পরীক্ষার ১/২ মাস আগে থেকে সাংসারিক কোনো চাপ আমাকে নিতে হয়নি।
বিসিএসের মতো লং জার্নিতে প্রিলি, রিটেন, ভাইভা প্রস্তুতির সময় সার্বক্ষণিক সহায়ক শক্তি স্ত্রী পাশে থেকেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকে চাকরিরত অবস্থায় আমি ৪১ আর ৪৩তম বিসিএসের ভাইভা দিই। ঢাকায় গিয়ে মক ভাইভা দেওয়ার সময় ছিল না বিধায় আমার স্ত্রীর কাছেই ভাইভার প্র্যাক্টিস করি।
বিসিএস প্রত্যাশীদের জন্য মাসুমের পরামর্শ, বিসিএসের প্রশ্ন ভালোভাবে এনালাইসিস করতে হবে। অনেকে প্রশ্নের প্যাটার্ন ভালো করে না বুঝেই প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করে। এতে তার সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই হবে না।