র্যাংকিং-ট্রাস্ট-রাজনীতি-সেমিস্টার ইস্যুতে সরগরম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
বছরজুড়ে দেশের শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনে বহু ঘটনার সাক্ষী হয়ে বিদায়ের পথে ২০২২ সাল। এ বছর নানা কারণে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ট্রাস্টি বোর্ডে জামায়াত সংশ্লিষ্টতা ও দুর্নীতির অভিযোগে বছরজুড়ে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির পরিবর্তন করেছে সরকার। অন্যদিকে, ট্রাস্টি বোর্ডের ওপর এমন হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের এসব বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় আসে দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয়গুলো। এছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা করে নেওয়া, সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাই-সেমিস্টার চালু করতে ইউজিসির নির্দেশনা, অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতির অনুসরণ, স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে নির্দেশনাসহ নানা ইস্যুতে আলোচনায় ছিল বেসরকারি শিক্ষায়তনগুলো। এছাড়া টাইমস হায়ারসহ নানা প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক র্যাংকিংও ছিলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে কেটেছে ২০২২ সাল। প্রত্যাশা-প্রাপ্তির মেলবন্ধনে হিসেবের খেরো-খাতায় কেমন হবে বিদায়ী বছরের মূল্যায়ন?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ:
বছরের শুরুর দিকে গত ১ মার্চ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) বোর্ড অব ট্রাস্টির পরিবর্তন করে ২১ সদস্যের নতুন বোর্ডের অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন বোর্ডের সদস্যরা সবাই সরকারি দল আওয়ামী লীগ ঘরানার। বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাংসদ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরায় অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক সাংসদ আ ন ম শামসুল ইসলাম। ওই বোর্ডের ১২ সদস্যের প্রায় সবাই জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও সমর্থক।
গত আগস্টে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ভেঙে দিয়ে ১২ সদস্যের নতুন বোর্ড পুনর্গঠন করে দেয় সরকার। পুরোনো ট্রাস্টি বোর্ডের সাতজনকে নতুন বোর্ডে রাখা হয়নি। এদের মধ্যে চারজন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় তখন কারাগারে ছিলেন। ‘দুর্নীতি, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতার’ অভিযোগে ১৬ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দেয় সরকার। সে সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠনের বিষয়ে আদেশ জারি করেছিল।
পুনর্গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডে বাদ পড়েছিলেন বিদায়ী বোর্ডের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদ এবং সদস্য বেনজির আহমেদ, আজিজ আল কায়সার, এম এ কাশেম, রেহানা রহমান, মোহাম্মদ শাহজাহান ও নুরুল এইচ খান। এর মধ্যে বেনজির আহমেদ, এম এ কাশেম, রেহানা রহমান ও মোহাম্মদ শাহজাহান আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের মামলায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে তখন কারাগারে ছিলেন। দুদকের ওই মামলায় ওই চারজনসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়, যাঁদের মধ্যে আজিম উদ্দিনও রয়েছেন। বাকি সদস্যদের কী কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশে তা উল্লেখ করা হয়নি।
আরও পড়ুন: বুদ্ধিবৃত্তির পঞ্চাশ বছর কি কেবলই পিছিয়ে যাওয়ার?
এর আগে গত মে মাসের শেষের দিকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জমি কেনা বাবদ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ট্রাস্টিকে (এম এ কাশেম, বেনজীর আহমেদ, রেহানা রহমান ও মোহাম্মদ শাহজাহান) কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন শর্তে তারা জামিনে বের হয়েছিল।
গত ৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে মানারাত ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন করে দেয়। পুনর্গঠিত বোর্ডে চেয়ারম্যান করা হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৬ (১০) ধারার ‘সুস্পষ্ট লংঘন’ করায় ট্রাস্টি বোর্ড পুর্নগঠন করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন করে দেন বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল। মানারাত ট্রাস্ট ১৯৭৯ সালে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করে, যা পরে কলেজ পর্যন্ত উন্নীত হয়। এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও। ইসলামী ব্যাংকের মতো এই প্রতিষ্ঠানগুলো জামায়াতে ইসলামী সংশ্লিষ্টদের নেতৃত্বে পরিচালিত হত বলে অভিযোগ রয়েছে। মানারাত স্কুল ও কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যক্ষ ছিলেন যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী শামসুন্নাহার নিজামী।
এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডে সরকারি দলের নগ্ন হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে সাবেক শিক্ষার্থীরা গত ৩ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করেছিলেনন। সেই সঙ্গে নতুন ট্রাস্টি বোর্ডকে প্রত্যাখ্যান করে আগের বোর্ডের কাছে দায়িত্ব ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছিল তারা।
ছাত্র-রাজনীতির টানা-পোড়ন
‘সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা’ নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ২০১২ সালের নভেম্বরে শুরুর কথা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হলেও ২০২২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন করে কমিটি ঘোষণার পর আলোচনায় আসে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতির বিষয়টি। সংগঠনটির সদ্যবিদায়ী কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে নতুন কমিটির অনুমোদনের কথা জানানো হয় এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি। সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সভাপতি করা হয়েছিল জাহিদ হোসেন পারভেজকে ও সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল আজিজুল হাকিম সম্রাটকে।
মূলত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটির পর নর্থ-সাউথ, ব্র্যাক, ড্যাফোডিল, ইস্ট ওয়েস্ট, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনালসহ দেশের প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কারণেই বেশি আলোচনায় আসে বিষয়টি। যদিও সংগঠনটির নেতারা বলছেন, তারা মূল ধারায় চলমান রাজনীতি নয় বরং শিক্ষা ও গবেষণাসহ নানামুখী শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচিতে ফোকাস করছেন। যেখানে পাওয়ার পলিটিক্সের পরিবর্তে গুরুত্ব পাচ্ছে রিসার্চ পলিটিক্স এবং এতে তাদের কার্যক্রমে কোন ভাটা পড়বে না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি, রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কমিটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই ১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করার কথা জানায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও। বিগত ৫ অক্টোবর ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানায়। যদিও দেশের সামগ্রিক রাজনীতির হালচাল বিবেচনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কোণঠাসা অবস্থা তাদের।
ইউজিসির কঠোরতা
স্থায়ী-ক্যাম্পাস: দেশের উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ১২ বছর পূর্ণ হওয়ার পরও স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে ব্যর্থ হওয়া ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে চিঠি দেয় গত এপ্রিলে। ওই চিঠিতে ইউজিসি জানিয়েছে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইন না মানলে কঠোর হবে তারা। সেজন্য চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে সম্পূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করতে হবে দেশের ২২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সময়সীমাও জানায় প্রতিষ্ঠানটি। যদিও এরই মধ্যে আংশিক কাজ সম্পন্ন হওয়া, ডেকোরেশন(সাজ-সজ্জা) বাকী থাকাসহ নানা কারণে ১২টি বিশ্ববিদ্যালকে নতুন স্বল্প (৬ মাস-১ বছর) বর্ধিত সময় দেয়া হতে পারে বলে জানানো হয়েছে গত ১২ ডিসেম্বর। ইউজিসি বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে সম্পূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যর্থ হলে ভর্তি বন্ধ, কোর্সের অনুমতি বাতিল ও লাল তালিকাভুক্তি(রেডমার্ক) সহ নানা কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তারা। নতুন বছরে তারা কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আরও পড়ুন: অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা: মেধা আর অর্থ দুটোরই অপচয়
স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইন না মানায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নতুন করে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে সম্পূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করতে হবে দেশের ২২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে। তা না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধসহ আইনি পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে (ইউজিসি)। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের এক সমন্বয় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ৩৫ (৭) ধারা অনুযায়ী, কোনো কারণে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা দেখা দিলে কিংবা উহার স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত ও শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে, উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখিবার স্বার্থে, চ্যান্সেলর, কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে, প্রয়োজনীয় আদেশ ও নির্দেশ দিতে পারিবেন এবং এতদবিষয়ে চ্যান্সেলরের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গণ্য হইবে।
আইনের এ ধারার ব্যাখ্যায় ইউজিসি সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এক্ষেত্রে ইউজিসি চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে প্রশাসক বসিয়ে দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে ট্রাস্টি বোর্ডের হাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি হবে। এছাড়া আরো অনেক কঠোর সিদ্ধান্তও নেয়া হতে পারে।
বাই-সেমিস্টার: দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আগামী ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে দুই সেমিস্টারের (বাই-সেমিস্টার) শিক্ষাবর্ষ বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুসরণ করে কমিশন থেকে এ সংক্রান্ত একটি একটি চিঠি বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রেজিস্ট্রারদের পাঠানো হয় গত ২৮ নভেম্বর। ইউজিসির ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, কমিশনের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাই-সেমিস্টার পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং কিছুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সুনামের সঙ্গে বাই-সেমিস্টার পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে।
আরও পড়ুন: এশিয়ার শীর্ষ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আধিপত্য চীনের
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ২৪(৩) এবং ৩৫(১) ধারা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রোগ্রাম ও কোর্স অনুমোদনের অন্যতম শর্ত হলো ‘প্রোগ্রামটি অবশ্যই ডুয়াল সেমিস্টার ভিত্তিতে পরিচালনা করতে হবে।’বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের চাহিদা অনুযায়ী কমিশন প্রণীত আউটকাম বেজড এডুকেশন (ওবিই) টেমপ্লেট অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সব প্রোগ্রাম বাই-সেমিস্টার পদ্ধতিতে পরিচালনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তদুপরি বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল আইন, ২০১৭-এর ১৫ ধারার আওতায় প্রণীত বাংলাদেশ ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশনস ফ্রেমওয়ার্কেও (বিএনকিউএফ) অনুরূপ বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
চিঠিতে আরও জানানো হয়েছিল, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করছে। বর্ণিতাবস্থায় দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি (বাই-সেমিস্টার) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিশন প্রণীত নির্দেশনা অনুসরণপূর্বক বাই-সেমিস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম আবশ্যিকভাবে পরিচালনা করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হলো।
এর আগেও ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে তিন সেমিস্টার পদ্ধতির লাগাম টানার উদ্যোগ নিয়েও অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে। কমিশন দুই সেমিস্টার পদ্ধতির নির্দেশনা দিয়ে এর আগে কয়েক দফা সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল। তবে এবার কমিশন এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে জানিয়েছে তারা। যদিও যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাই-সেমিস্টার চালু করতে করতে পারেনি তারা বলছে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে তাদের আরও সময় লাগবে। আর এ সিদ্ধান্ত মানবে না বলে জানিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি। ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানও দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা খাতের আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম বিষয় ছিল বিদায়ী বছরে।
অভিন্ন গ্রেডিং: দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতিও ছিল অন্যতম একটি। উচ্চশিক্ষা তদারক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষায় তাদের মর্জিমতো গ্রেড দেওয়ার প্রেক্ষিতে কঠোর হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। কমিশনের প্রণীত গ্রেডিং অনুযায়ী অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি অনুসরণের নির্দেশনা দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠিতে জানায় ইউজিসি। চিঠিতে জানানো হয়েছে, উচ্চশিক্ষায় ৮০ বা এর বেশি নম্বর পেলে একজন শিক্ষার্থীকে ‘এ-প্লাস’ বা সিজিপিএ-৪ দিতে হবে। ৭৫ থেকে ৭৯ নম্বর পেলে তা ‘এ রেগুলার’ বা সিজিপিএ-৩ দশমিক ৭৫ এবং ৭০ থেকে ৭৪ পেলে ‘এ মাইনাস’ বা সিজিপিএ-৩ দশমিক ৫ পাবেন শিক্ষার্থীরা। ৬৫ থেকে ৬৯ এর জন্য ‘বি প্লাস’ বা সিজিপিএ-৩ দশমিক ২৫, ৬০ থেকে ৬৪ এর কম পেলে তা ‘বি রেগুলার’ বা সিজিপিএ-৩ হিসাবে শনাক্ত করা হবে।
এরপর ৫৫ থেকে ৫৯ এর জন্য ‘বি মাইনাস’ বা সিজিপিএ-২ দশমিক ৭৫; ৫০ থেকে ৫৪-এর জন্য এ ‘সি প্লাস’ বা সিজিপিএ-২ দশমিক ৫ দেওয়া হবে। ব্যক্তি পরীক্ষায় ৪৫ থেকে ৪৯ পেলে তা ‘সি রেগুলার’ বা সিজিপিএ-২ দশমিক ২৫; ৪০ থেকে ৪৪ পেলে ‘ডি’ বা সিজিপিএ-২ অধিকারী হবেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা অনুযায়ী ৪০-এর কম হলে ‘এফ’ বা অকৃতকার্য দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে।
যদিও ইউজিসির নির্দেশনার বিপরীতে নিজেদের তৈরি পদ্ধতি অনুযায়ী ইচ্ছামতো গ্রেডিং ও লেটার গ্রেড প্রদান করছে দেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তথ্য বলছে, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এনএসইউ) একজন শিক্ষার্থী বি-মাইনাস পায়। এনএসইউতে পাশ নম্বর ৬০। কোনো শিক্ষার্থী ৫৯ পেলে তাকে ফেল বা অকৃতকার্য ধরা হয়। আর সিজিপিএ-৪ পেতে হলে সর্বনিম্ন পেতে হয় ৯৩ নম্বর। বিপরীতে, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে (এআইইউবি) একজন শিক্ষার্থী ৯০ নম্বর পেলেই সিজিপিএ-৪ অর্জন করতে পারে। ইউজিসির নীতিমালার বাইরে গিয়ে নিজেদের তৈরি পদ্ধতি মানছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিও।
আরও পড়ুন: ৫১-বছরে বাংলাদেশ: বেড়েছে শিক্ষার পরিমাণ, কমেছে গুণগত মান
আরেক বেসরকারি উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির এ প্লাসকে বলা হয় ‘এক্সিলেন্স’ আর লেটার গ্রেডে ‘এ’। কিন্তু কত নম্বর পেলে এ গ্রেড দেওয়া হয় সেটি অস্পষ্ট। এই প্রতিষ্ঠানটি ফল তৈরিতে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২১টি স্তর অনুসরণ করে। এরমধ্যে শূন্য গ্রেডেই আছে বিভিন্ন নামে ১০টি স্তর। সর্বনিম্ন সিজিপিএ-১ এরজন্য লেটার গ্রেড হচ্ছে ডি, যেটিকে ব্যাখ্যা করে বলা হয় ‘ডেফিসিয়েন্ট পাসিং। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) ৯০ পেলে এ গ্রেড বা সিজিপিএ ৪ দেয়। কোনো এ প্লাস নেই। পাশ নম্বর ৬০।
ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতেও এ প্লাস পেতে হলে এনএসইউর মতো পেতে হবে ৯৭ নম্বর। তাদেরও পাশ নম্বর ৬০। অন্যদিকে, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) সিজিপিএ ৪ কে তারা ‘আউটস্ট্যান্ডিং বললেও লেটার গ্রেডে এ প্লাস ও সিজিপিএ ৪ কত নম্বরে সেটি জানায় না। তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ৮০ শতাংশ নম্বর পেলে এ প্লাস বা সিজিপিএ ৪ দিয়ে থাকে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠানটিতে পাশ নম্বর ৪০ শতাংশ, কিন্তু এটাকে লেটার গ্রেডে ডি আর সিজিপিএ ২ হিসাবে উল্লেখ তারা। এছাড়া আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইচ্ছামতো গ্রেডিং পদ্ধতি ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) যদিও বলছে, পরীক্ষায় মূল্যায়নে এভাবে ভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি অনুসরণ করায় বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজার কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছেন; বিষয়টি সুরাহার জন্য অনেকেই ইউজিসিতে আবেদন করছে। এরই প্রেক্ষিতে কমিশন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও সরব ছিলেন দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিন্ন গ্রেডিং নিয়ে।
বিশ্ব র্যাংকিংয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
চলতি বছরের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে আরও একটি অন্যতম বিষয় ছিল টাইমস হায়ার, কিউএসসহ নানা প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়ন র্যাংকিং। বিশেষ করে গত অক্টোবরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) প্রতিবছরের মতো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা প্রকাশ করে। তালিকায় বিশ্বের সেরা ৬০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অবস্থান করতে পারেনি দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়।
এবারের তালিকায় বিশ্বের শীর্ষ ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় শীর্ষ অবস্থান করছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্তরাজ্যের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি টানা ছয় বছর ধরে শীর্ষস্থানে রয়েছে। মূলত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাদান (টিচিং), গবেষণা (রিসার্চ), গবেষণা-উদ্ধৃতি (সাইটেশন), আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি (ইন্টারন্যাশনাল আউটলুক) এবং ইন্ডাস্ট্রি ইনকামের (শিল্পের সঙ্গে জ্ঞানের বিনিময়) ওপর ভিত্তি করে এ তালিকা করে সংস্থাটি। বিশ্বের ১০৪টি দেশের ১ হাজার ৭৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়নের ভিত্তিতে এ র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে তারা।
তালিকায় ৬০১ থেকে ৮০০ এর মধ্যে অবস্থান করে বাংলাদেশের হয়ে প্রথমে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের ১ হাজার ৭৯৯টি উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশের মাত্র ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তালিকায় দেশের হয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বেসরকারি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি(গবেষণায় প্রথম)। আর তৃতীয় অবস্থানে ছিল ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
এছাড়াও চতুর্থ অবস্থানে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। তবে, দেশের হয়ে তালিকায় থাকা বাকী প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকার শেষের ১২০১ থেকে ১৫০০ এর মাঝে কোনোরকম অবস্থান টিকিয়ে রেখেছে। আর বাংলাদেশের অন্য ১০টি উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নাম থাকলেও তাদের কেনো আন্তর্জাতিক অবস্থান ছিলনা ঐ তালিকায়। এছাড়াও র্যাংকিং প্রকাশ করে কিউএসসহ অন্যান্য মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানও। এসব র্যাংকিংয়ের ফলে গবেষণাসহ নানা কারণে আলোচনায় ছিল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং।