বিসিএস ততক্ষণ ভালো, যতক্ষণ না তা লোভে পরিণত হয়

আঁখি মনি
আঁখি মনি  © টিডিসি ফটো

আঁখি মনি। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা এই ছাত্রী তৃতীয়বারের চেষ্টায় বিসিএসে সাফল্য পেয়েছেন। মায়ের অনুপ্রেরণা কাজে লাগিয়ে ৪৩ তম বিসিএসে ট্যাক্স (কর) ক্যাডারে হয়েছেন সুপারিশপ্রাপ্ত। 

আঁখি জানান, বলতে গেলে এই বিসিএস হওয়াটা আমার জীবনে সাফল্যের পূর্ণতা এনে দিয়েছে। যা শুরু হয়েছিল পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার মধ্য দিয়ে। এই ধারাবাহিকতায় অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি, এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া এবং সবশেষে বিসিএসে স্বপ্নের ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া— এসবই আমার ঝুলিতে যোগ হওয়া একের পর এক অর্জন।

আঁখির বাড়ি বরিশাল জেলার উজিরপুর থানায়। চাকরি থেকে অবসর নেওয়া বাবা মো. আফজাল হোসেন মৃধা ও গৃহিণী মা মোছা. তানজিলা বেগম দম্পতি পরিবারের তিন বোনের মধ্যে মেজো আঁখি মনি। 

বাবার সরকারি চাকরির সুবাধে অনেকবার স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছে আঁখিকে। বরিশালের আগৈলঝাড়া এস.এম. গার্লস হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর এইচএসসি পরীক্ষা দেন উজিরপুর বি.এন খান কলেজ থেকে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরস অব ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগে। এরপর ফার্মাকোলজি  বিভাগ থেকে করেন স্নাতকোত্তর তিনি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে আঁখি জানান, আমার অনুপ্রেরণা হচ্ছে মা। তার উৎসাহেই ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করি। আমার প্রথম বিসিএস ছিল ৪০তম। তখন আমি বিসিএস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। শুধু তাই নয়, এটা নিয়ে তেমন আগ্রহও ছিল না। দুর্ভাগ্যবশত ৪১তম বিসিএসেও আমার হয়নি। এরপর অনেক ভেবেচিন্তে ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএস দুটো লক করেছিলাম। বিশ্বাস ছিল এমন—  হলে এই দুটো বিসিএস থেকেই হবে; না হলে বিসিএস আমার তাকদিরে নেই। প্ল্যান বি বাস্তবায়ন করতে হবে।

May be an image of 1 person, scarf, turban, headscarf, sarong, bamboo and outdoors

আঁখির ভাষ্য, মা সব সময় তার মেয়েদের প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইতেন। আমাদের জীবনে তার অবদানও অনেক বেশি। তিনি যেভাবে আমার পরিবার বিশেষ করে ছোট বোন ও আমাকে সাপোর্ট করেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তা প্রকাশ করার মতো ভাষা নেই। 

তিনি জানান, আল্লাহর রহমতে ৪৩তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। ৪৪তম বিসিএসের লিখিত দিয়েছি। এরপর আর কোনো বিসিএসে চেষ্টা করিনি। চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য মোটামুটি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময়ে আল্লাহ আমাকে ঠিক তাই দান করলেন; যা আমার জন্য অতি উত্তম।

আঁখির শৈশব কেটেছে প্রচণ্ড দুরন্তপনায়। বাবার সরকারি চাকরি করার সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে তার। সে হিসেবে শৈশবে একঘেয়েমিতা আসার সুযোগ ছিল না। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই সাঁতার কাটতে খুব পছন্দ করতাম।  পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতে সাঁতার কাটার নেশায় টানা দুই-তিন ঘণ্টা খালে গোসল করেছিলাম। এরপর যা হওয়ার তা-ই হলো; টাইফয়েড। ডাক্তার আমার বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে বেঁচে ফিরে সেই ক্লাসে বৃত্তি পাওয়াটা ছিল আমার জীবনের প্রথম সাফল্য। মধুর অর্জন, শ্রেষ্ঠ স্মৃতি ছিল সেটা।

বিসিএস প্রস্তুতিতে কোন বিষয়েগুলো এগিয়ে রেখেছিলেন জানতে চাইলে আঁখি মনি জানান, ছোটবেলা থেকেই গল্প ও অ্যাকাডেমিক বইয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল। ফলে বেসিক মোটামুটি ভালো ছিল। প্রচুর ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করতাম, ভিডিও দেখতাম। পেপার পড়তে, নিউজ ও টকশো দেখতেও খুব ভালোবাসি। মোটাদাগে এসব বিষয়গুলোই আমাকে বিসিএসের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় সাহায্য করেছে। এর বাইরে ভাইভার কিছুদিন আগে আইইএলটিএস দিয়েছিলাম; যেটা আমার সব ভয় দূর করতে ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে। বিষয়টি ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথা বলতেও অনেক সাহায্য করেছে।

আঁখি জানান, প্রস্তুতির সময়টা আমার জন্য অ্যাসিড টেস্ট ছিল। কারণ, শুধু বিসিএস পড়ার জন্য বাসা ছেড়ে বাইরে একা থাকতাম। লাইব্রেরিতে পড়তে পাড়তাম না, গ্রুপ স্টাডির অভ্যাস নেই, তাই জীবনকে শুধু কোচিং আর বাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছিলাম। এর ওপরে বাজার করে রান্না করা। সবমিলিয়ে দিন-রাত কখন শুরু হত; কখন শেষ হত— বোঝার সময় পেতাম না।

আঁখি জানান, এটা আমার প্রথম চাকরি। বিসিএসে চান্স না পেলে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তাই তার অন্য কোন চাকরির প্রতি তেমন আগ্রহ তৈরি হয়নি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সর্ম্পকে জানান, আল্লাহ আমাকে যে দায়িত্বের জন্য যোগ্য মনে করেছেন; তা যেন শতভাগ ন্যায়, সততা ও একাগ্রতার সাথে পালন করতে পারি— আপাতত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এটাই।

চাকরিপ্রার্থীদের বিসিএসকে একমাত্র লক্ষ্য বানানো উচিত কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে আঁখি জানান, আমি সবসময় বিশ্বাস করি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিসিএস নিঃসন্দেহে সম্মানজনক চাকরি। এর প্রতি প্যাশন থাকা ভালো, যতক্ষণ না তা লোভে রূপান্তরিত হয়। জীবনে ভিন্ন পরিকল্পনা থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে এইগুলোকে বাস্তবায়ন করার জন্য সময়, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং সৃষ্টিকর্তার উপর অগাধ বিশ্বাস থাকাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।


সর্বশেষ সংবাদ