কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেশি ভাঙচুর জাবিতে, কম শেকৃবিতে

কোটা সংস্কারের দাবিতে চলা আন্দোলনে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। রাজধানীর একটি এলাকা থেকে তোলা।
কোটা সংস্কারের দাবিতে চলা আন্দোলনে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। রাজধানীর একটি এলাকা থেকে তোলা।  © ফাইল ছবি

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মোট ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ক্ষতির বিবরণ চেয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষ থেকে দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থাটির কাছে যে ক্ষতির পরিমাণ জানানো হয়েছে, তাতে এখন পর্যন্ত দেশের মোট ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষয়-ক্ষতির তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর বাইরে, ৪টি উচ্চশিক্ষালয়ে কোনো আর্থিক ক্ষতি না হলেও তাদের শিক্ষার্থী এবং অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা হতাহত হয়েছে। 

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য বলছে, দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট আর্থিক ক্ষতি ২৮ কোটি ৭৯ লাখ ১১ হাজার ১৬০ টাকা। বিপরীতে চারটি বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ক্ষতির পরিমাণ ৩ কোটি ৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সবচেয়ে বেশি ক্ষতি এবং শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) সবচেয়ে কম ক্ষতি হয়েছে।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তাদের ক্ষতির তথ্য পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ক্ষতির পরিমাণ জানিয়েছে। আমরা সে অনুযায়ী তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো।ড. ফেরদৌস জামান, সচিব, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি)। উচ্চশিক্ষালয়টির ১০টি হলের ২২৬টি কক্ষের আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ভিসি ভবনের ২টি গেইট, ৩টি এসি, জানালার গ্লাস, প্রশাসনিক ভবনসহ অন্য কয়েকটি ভবনের ৫৬টি সিসি ক্যামেরা, জানালার গ্লাস, ২টি ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন মোট ৮টি গাড়ির গ্লাসসহ ভাংচুরে মোট ক্ষতি ১৫ কোটি টাকা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশনে অর্থ চেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। তারা কমিশনকে জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে শিক্ষার্থীদের কক্ষ, প্রশাসনিক ভবনসমূহের দরজা, জানালা, গেট, বৈদ্যুতিক পাখা, সুইচ বোর্ডসহ বেশ কিছু কক্ষে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। এতে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪ কোটা ৯২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

আরও পড়ুন: কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত বেড়ে ২১০

এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ১০টি হল (শের-ই- বাংলা ফজলুল হক হল, শাহ মখদুম হল, মবাব আব্দুল লতিফ হল, সৈয়দ আমীর আলী হল, শহীদ হাবিবুর রহমান হল, মতিহার হল, মাদার বখশ হল, শহীদ জিয়াউর রহমান হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল) এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসন ভবনের আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামে ক্ষতির পরিমাণ ৪ কোটি ৪ লাখ ৫ হাজার ৫০০টাকা।

এর বাইরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) আর্থিক ক্ষতি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে উচ্চশিক্ষালয়টির শাহপরাণ হলের ১৩টি কক্ষের আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ১টি মাইক্রোবাসের বডি ও গ্লাস, প্রধান ফটকের সাইনবোর্ড, বৈদ্যুতিক ফিটিংস ভাঙচুর করা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মূল ক্যাম্পাসে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

এখন পর্যন্ত দেশের মোট ১১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষয়-ক্ষতির তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর বাইরে, ৪টি উচ্চশিক্ষালয়ে কোনো আর্থিক ক্ষতি না হলেও তাদের শিক্ষার্থী এবং অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা হতাহত হয়েছে। এছাড়াও চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে ইউজিসিকে।

এছাড়াও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) ২টি এলইডি স্ক্রিন, ২টি সিসি ক্যামেরা, কয়েকটি ভবনের জানালার গ্লাস ও ফ্রেম ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির ৫৪ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একইসাথে দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি ২ লাখ টাকা, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে দেশে প্রথম নিহত হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এরপরই সেখানে তীব্র আন্দোলন এবং পরবর্তীতে সহিসংতার ঘটনা ঘটে। এতে বেরোবির ১০টি এয়ারকুলার, ভিসি অফিস ও বাসভবন, ৫০টি সিসি ক্যামেরা, ০৫টি গেইট, লাইটপোস্ট, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন বিল্ডিং, অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং, গার্ডরুম, সিকিউরিটি রুম, কয়েকটি গাড়িসহ বেশকিছু ক্ষতি হয়। যার আর্থিক পরিমাণ ৩ কোটি ১৯ লাখ ৬৬০ টাকা।

আরও পড়ুন: কারফিউ না দিলে ‘শ্রীলঙ্কা স্টাইলে’ গণভবন দখলের ষড়যন্ত্র ছিল: ওবায়দুল কাদের

এছাড়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) ৪টি হল, অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ভিসি বাংলো, মেডিকেল সেন্টারসহ বিভিন্ন সিসি ক্যামেরা,ছয় দফা স্তম্ভ এবং আসবাবপত্র ভাংচুরের ঘটনায় ৫০ লাখ, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইআবি) ২টি বিলবোর্ড ও ৪টি সিসি ক্যামেরা ভাংচুরের ঘটনায় ৫০ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। একই পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুকৃবি) ইন্টারনেট সংযোগের রাউটার ভাঙচুরের ঘটনায়।

এর বাইরে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে দেশের মোট চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে রয়েছে—বেসরকারি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক ইসলামী ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে জানানো হয়েছে ইউজিসিকে।

আরও পড়ুন: ঢালাওভাবে মামলা-গ্রেপ্তার বন্ধ এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি সুজনের

আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে—সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে মোট ৩ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে তারা কমিশনকে অবহিত করেছে। এছাড়াও চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী ইউনিভার্সিটির ২ লাখ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি ১ লক্ষ টাকা ক্ষতির কথা জানিয়েছে। তবে ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণের লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে ইউজিসিকে জানিয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। ফলে তাদের ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হয়নি।

সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে কথা হয় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামানের সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তাদের ক্ষতির তথ্য পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ক্ষতির পরিমাণ জানিয়েছে। আমরা সে অনুযায়ী তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের জনগণের ওপর সহিংসতায় হতবাক কানাডা: হাইকমিশনের বিবৃতি

কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশে এখন পর্যন্ত ২১০ জনেরও বেশি আন্দোলনকারী এবং শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের দাবি—এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনকারী ও সাধারণ মানুষ আহত হয়েছে। পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সদস্য ও সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ এবং তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের হামলায় এসব আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলেও দাবি তাদের।

এর আগে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার বাতিল চেয়ে আন্দোলনে নামে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরপর আন্দোলন তীব্র হতে থাকলে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকার সমর্থকরা। এতে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটে। 

পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সদস্যরা শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে মামলা হয়। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে।


সর্বশেষ সংবাদ