আমাদের দেশে কারিকুলাম নেই, আছে সিলেবাস

হাসান তৌসিফ ইকবাল
হাসান তৌসিফ ইকবাল  © সংগৃহীত

শিক্ষার উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে আমরা Behavioral Change-কে অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমরা প্রত্যাশা করি যে, শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির Attitude এবং Practice এ পরিবর্তন আসবে। নলেজ ক্রিয়েশন ও ডিসসেমিনেট ছাড়াও শিক্ষার মাধ্যমে এই জিনিসগুলো যে কোন ইন্ডিভিজুয়াল এর মধ্যে গ্রথিত হয়। আর এর Impact পড়ে পুরো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে। নলেজ থেকে প্রোডাকশন এবং Behaviaral change এর একটি ইতিবাচক সমন্বয়ের ফলে KBS (Knowledge Based Society) এবং KBE (Knowledge Based Economy) এর ধারণা আসে। ফলত:  ব্যক্তি,সমাজ ও রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদে এর  সুফল পায়।

শিক্ষার চারটি Component এর মূল দুটি হলো শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। তারা যেটি নিয়ে খেলা করে সেগুলো হলো কারিকুলাম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঠামো। ইনফরমেশন-নলেজ- স্কিল এই তিনটির উপর জোর দিয়ে কারিকুলাম প্রণীত হয়। আমাদের দেশে  সত্যিকার অর্থে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা-স্তর পর্যন্ত; কোন পর্যায়েই কারিকুলাম নেই। যেটির অস্তিত্ব বিদ্যমান ওটার নাম সিলেবাস। আর এই সিলেবাস শেষ করার জন্যেই হন্তদন্ত হয়ে একদম ৪-২৪ বছর বয়েস পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ছুটেচলা। এর মধ্যে তাদের উপর ভারি চাপরাশি ছেড়ে দেয় শিক্ষকগণ আর অভিভাবকবৃন্দ।

সুতরাং বলা যায় হারাধনের চারটি ছেলের একটি আমাদের একেবারেই নেই। শুধু ঝাপসার উপর দিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখানে অনেক। পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবয়ব ও কলেবরও বেড়েছে। উন্নত হয়েছে। ক্লাসরুমে এসি এসেছে,ইন্টারনেট এসেছে,মাল্টিমিডিয়া এসেছে। আগে যেখানে গাছতলায় শিক্ষা নিতে হতো সেখানে অনেক বড় বড় দালানকোঠা এসেছে শুধু হারিয়ে গেছে মূল্যবোধ আর নৈতিকতা। আর এগুলো সেখানোর সবচেয়ে বড় দায় থাকে শিক্ষকদের উপরে। সেজন্যেই চারটি কম্পোনেন্ট এর সবচেয়ে গুরুত্ববাহী কম্পোনেন্ট বলা হয়ে থাকে শিক্ষককে। শিক্ষার ড্রাইভার বা চালক বলা যায় এটিকে।

শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে তাকে কম্পিটেন্ট করে গড়ে তোলা এগুলোর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আমরা কন্টেম্পোরারি ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল পারসপেক্টিভে সবচেয়ে তলানিতে। না পারি নিয়োগে সঠিক লোককে ঠিক করতে। না পারি তাকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে।তাই ট্রিটমেন্টও সেরকম।আমাদের দেশের বুনিয়াদি, প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক একেবারে নেই বললেই চলে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে কিছু যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক থাকলেও বেসরকারিগুলোর অবস্থা খুব করুণ। ইদানিং এনটিআরসির মাধ্যমে নিয়োগদান একটি কার্যকর পদক্ষেপ।

আরও পড়ুন: 'শিক্ষকদের শিক্ষক' প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক

এদেশে শিক্ষার দিকও নানামুখী। এতো রকমারি শিক্ষার ধারা পৃথিবীতে কোথাও নাই। এগুলো নিয়ে কাজ করার অভিপ্রায় হয়তো রেগুলেটরি অথরিটির নেই অথবা তারা সে বিষয়গুলো জানেও না যে কিভাবে এগুলো দূর করা যায়। একজন শিক্ষক ২০ বছর ধরে শিক্ষকতা করার পরেও দেখা যায় যে সে ঠিকমত টিচিং লার্নিং প্রসেসগুলোর সাথেই পরিচিত না।

আমাদের আরেকটি বড় অসামঞ্জস্যতা হচ্ছে পেডাগজি লার্নিং এর কগনিটিভ ম্যাপিং নেই। অর্থাৎ কত বছরের বাচ্চাদের কোন ধরনের লার্নিং লাগবে,কী হবে লার্নিং  ম্যাটারিয়াল আর কী হবে শেখানোর পদ্ধতি এটি নিয়ে কোন গবেষণা ও এর প্রয়োগ নেই। দেখা যায় আর্টস এর শিক্ষক ফিজিক্স পড়াচ্ছেন। আর ক্লাসে এসে বলে যে মুখস্থ লিখে জমা দাও। সময় ২০ মিনিট। এভাবে অনেক কিছুই হারিয়ে যায় আমাদের জীবন থেকে। আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়না সেসময়ে। ধীরে ধীরে আমরা বুঝতে পারি যে একটি অসম্পূর্ণ ছাত্রজীবন কাটিয়ে এসেছি অতীতে। আর এর খেসারত দিতে হয় আমৃত্যু। আবার বর্গা শিক্ষকের প্রচলনও আমাদের দেশে তীব্র।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের মনিটরিং যে এজেন্সি আছে সেখানে যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয় তাদেরও রয়েছে অধিকরকমের ঘাটতি। টিচিং লার্নিং নিয়ে তাদের কোন পড়াশোনা নেই।ক্যা পাসিটিভ ডেভেলপম্যান্টও নেই। ট্রেনিং এর কনসেপ্ট যেটুকু আছে সেটা ইটিং,সিটিং এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।

অর্থাৎ একটা দূরুহ, জটিল এবং অনুর্বর শিক্ষা কাঠামোর মধ্য দিয়ে প্রায় ৩০-৪০ বছরেরও অধিকসময় ধরে আমরা যাচ্ছি।

যারা ভাল করছে, একেবারেই ব্যক্তিগতভাবে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা আর পরিশ্রম একটা পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের। আর অন্ধকারেও ডুবে থাকা কিছু তারা পথ দেখাচ্ছে অনেক কিছুর ভিতরে। যাদের অবদানের ফলে সম্মান আর শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে যায়নি সমাজ থেকে।

প্রতিষ্ঠানের বাইরেও আমরা এমন কিছু শিক্ষকের দেখা পাই যারা সকল নিয়মের ব্যতিরেকে গেঁথে যান হৃদয়ে। জয় করে নেন অনন্য আকুলতা। শ্রেণীকক্ষে পাঠ না দিয়েও শিক্ষার্থীর কাছে হয়ে উঠেন দেবতা-তুল্য।

পুরাণ মতে, একজন শিক্ষককে তখনই সফল বলা যায় যখন তিনি গুরু হয়ে উঠেন। গুরু হতে হলে অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হয় যেখানে শিখনের প্রক্রিয়ায়ও আনতে হয় অনেক বড় সংস্কার। সেখানে শিখনের শেষ ধাপে জ্ঞানের প্রায়োগিক বিশ্লেষণ সম্পন্ন হয়। পুরানের ধাপ: প্রফেসর- উপাধ্যায়- আচার্য- পণ্ডিত- দ্রষ্টা- গুরু।

ভারতবর্ষে শিক্ষার যাত্রাটা এরকম নয়। অনেকটা স্বসূত্রেই আমাদের শিখন শিক্ষণ পরিচালিত হতো। গুরুত্ব ছিল ইনসাইট-ফোরসাইট- উইসডম এর প্রতি।

খরস্রোতা নদীর মত ধীরে বহমান শিক্ষাব্যবস্থাও পরিবর্তন হবে একদিন। পরিবর্তনকে মেনে নিবে শিক্ষাসমাজ। ফোরসাইট বা উইসডমকে কেন্দ্রে রেখে শিক্ষা পরিকল্পনা হবে। সৃষ্টি হবে হাজারো সফল শিক্ষকের গল্প। অসংখ্য গুরুর গল্প। পৃথিবীর সকল শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। প্রত্যেকটি দিনই আপনাদের হোক।

অন্ধকারে ডুবে যাওয়া সেই তারাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

অত্যাচারিতের শিক্ষা হতে মুক্ত হোক প্রাণীকুল।

লেখক: সরকারি কর্মকর্তা।


সর্বশেষ সংবাদ