বাংলা সনের জন্ম কৃষকের ঘামে, কিন্তু উৎসবে নেই তাদের নাম

বাঙালীদের ঐতিহ্য হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে বাংলা নওরোজ
বাঙালীদের ঐতিহ্য হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে বাংলা নওরোজ  © সংগৃহীত

যুগ যুগ ধরে বাঙালীদের ঐতিহ্য হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে বাংলা নওরোজ। পনেরো শতকের শেষের দিকে শুরু হওয়া বাংলা সনের প্রথম দিন থেকে দিবসটি শাহ-ই-বাঙ্গালায় উদযাপিত হচ্ছে। চন্দ্র-সূর্যের আবর্তনকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া এই বাংলা বর্ষপুঞ্জের অন্যতম অংশীদার ছিলো কৃষকরা।

অর্ধ-সহস্র বছর আগে বাংলার শাসক সম্রাট আকবর এই বঙ্গ শাসন করেছিলেন। তিনি তার রাজ্যের সকল কার্যক্রম তখন হিজরি সন অনুযায়ী পরিচালনা করতেন। কিন্তু আবহমান বাংলার ঋতুবৈচিত্রের কারণে ফসল উত্তোলনের সময়ের সাথে হিজরি সনের তেমন সামঞ্জস্যতা ছিলো না। রাজ্য পরিচালনার জন্য প্রজাদের থেকে বাৎসরিক খাজনা আদায় করা ছিলো রাজকার্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। 

সম্রাট আকবরের রাজসভার সদস্য আবুল ফজল তার ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। পনেরো শতকের শেষের দিকে ফসল উৎপাদন ও চন্দ্র-সূর্যের আবর্তনের উপর ভিত্তি করে একটি নতুন বর্ষপঞ্জি চালু করা হয়। সেই বর্ষপঞ্জিকে বলা হতো ফসলি সন। এই সন অনুযায়ী তখন রাজপ্রশাসন ও জমিদারেরা প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করতো। কৃষক প্রজারা যখন খাজনা পরিশোধ করতো তখন প্রশাসন ও জমিদারদের পক্ষ থেকে মিষ্টি, সুগন্ধি-আতর এবং মাঝেমাঝে নতুন কাপড় বিতরণ করা হতো। এটাকে তখন নওরোজ বলা হতো। কৃষকেরাও নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দে নিজেরা উৎসব করতো- মেয়েকে নাইওর আনা হতো, নতুন চালের পিঠা ও নবান্ন উৎসব হতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের সময় পর্যন্তও ফসলি সনকে ঘরোয়াআসরে উদযাপন করা হতো।

কিন্তু, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক শিশির ভট্টাচার্য, রফিকুন্নবী ও মোস্তফা মনোয়ারের নেতৃত্বে ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষকে লোক-সংস্কৃতিতে রুপ দিয়ে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু করা হয়৷ তখনকার শোভাযাত্রার উদ্দেশ্য ছিলো সামরিক শাসকের আধিপত্য প্রতিরোধে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। সেই থেকেই আজ পর্যন্ত রাজধানীতে পালিত হচ্ছে আনন্দ শোভাযাত্রা নতুন নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে।

কিন্তু এই তথাকথিত নববর্ষ উদযাপনের নামে গ্রাম-বাংলার কৃষকদের ফসল উৎপাদনের আবর্তে চালু হওয়া ফসলি সনকে করে ফেলা হয় একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উৎসবে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে ছিলো না কৃষকদের কোনো ঐতিহ্য, উপকরণ এবং ফসল ও শ্রমের প্রতীক। শুধু রাজধানীতে এই উৎসব উদযাপিত হওয়ার কারণে এটা শহুরে এলিট শ্রেণীর উৎসবে পরিণত হয়েছে। সেখানে কৃষকরা শুধুই ফিকশন।

আধুনিক বিশ্বের যুগেও আবহমান বাংলার কৃষকরা আজ অবহেলিত। মহাজনদের থেকে ঋন ও ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে জমি চাষ করে হাড়ভাঙা খাটুনির মধ্য দিয়ে ফসল উৎপাদন করেও তারা ফসলের ন্যায্য দাম পায় না, সমাজে নিচুশ্রেণী হিসবে বিবেচিত হচ্ছে, পরিবারের যথাযথ ভরনপোষণ করতে পারে না, দারিদ্র্যের চরম সীমায় বাস করতে হয়। মাঝেমাঝে আর্থিক দুষ্প্রাপ্যতা, সামাজিক মর্যাদার স্খলন ও মনস্তাত্ত্বিক দূর্বলতার কারণে নিজের আত্মাহুতি দিতে হয়।

বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রধান খাত হচ্ছে কৃষি। এই দেশকে বলা হয় কৃষি নির্ভর দেশ। কৃষকদের এই চরম দুর্দিনে বাংলা নববর্ষ হতে পারতো তাদের অধিকার আদায়, সামাজিক মর্যাদা রক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তার সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। অথচ, যাদেরকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে বাংলা সন আজ তাঁরা সেখানে শুধুই তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয়বস্তু। 

বাংলা নববর্ষ হোক কৃষকের জীবনের সমৃদ্ধির পাথেয়। বাংলা নববর্ষ হোক কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ।


সর্বশেষ সংবাদ