আমরা শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:২২ AM , আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৫, ১২:১৩ AM

২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের হয়। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর ওই বছরের ২৭ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৩০তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন পুরো বিশ্ববিদ্যালয় অচল ছিল, ক্লাস-পরীক্ষা ছিল টানা বন্ধ ছিল; ঢাবি প্রশাসন ছিল অভিভাবকহীন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে সবকিছু যেন শূন্য থেকে শুরু করেন। তার ভাষ্য, ‘ঢাবির প্রশাসনের প্রত্যেকটা কাজ প্রথম থেকে শুরু করতে হয়েছে।’
বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের ৬ মাস পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। এতে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, ডাকসু সচল নিয়ে প্রশাসনের অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। পাশাপাশি তুলে ধরেন তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আজ শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হেড অব নিউজ ইরফান এইচ সায়েম—
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ভিন্ন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর ৬ মাস পূর্ণ হয়েছে। শুরুর অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: প্রথমত আমি কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেইনি। একটা গণঅভ্যুত্থানের পর এই দায়িত্বটা নিয়েছি। তাই প্রেক্ষাপটটি খুবই ভিন্ন। সচরাচর তো এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। দায়িত্ব নেওয়ার পর অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ অচল ছিল। আবাসিক হলগুলো একটা ভাঙচুর অবস্থার মধ্যে ছিল। আমাদের প্রথম দায়িত্ব ছিল অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালু করা, সেটা আমরা মোটামুটি মাসখানেকের মধ্যেই সবার সহযোগিতায় চালু করতে পেরেছি। তারপর আমরা হল পর্যায়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করেছি এবং পরিদর্শন করেছি। শিক্ষকদের বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করেছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: প্রায় প্রতিনিয়তই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ও বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন হয়ে থাকে। এগুলো মোকাবিলায় কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন কিনা?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: প্রতিনিয়ত আমাদের বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ছাত্ররা আমরা কাছে আসলে সেগুলো পূরণের চেষ্টা করি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাহিরের বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাস-কেন্দ্রিক উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। এগুলোও আমরা প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করছি। তাতে একটা অসুবিধা হচ্ছে যে, আমাদের একটা বড় সময় চলে যাচ্ছে এ ধরনের কার্যক্রম মোকাবেলা করতে গিয়ে। এসময়টা অ্যাকাডেমিক কাজে দিতে পারলে আমার জন্য আরও স্বস্তিকর হতো। এছাড়া সম্প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারির আয়োজনও আমরা নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি। একটা বড় রকম নিরাপত্তা হুমকির মধ্য দিয়ে গিয়েও আমরা সেটা করতে পেরেছি। এখানেও বিভিন্ন মহলের সহযোগিতা আমরা পেয়েছি।
অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঢাবিতে আবাসন সংকট চরমে, বিশেষ করে ছাত্রীদের। আন্দোলনেও নেমেছিলেন তারা। আবাসন সংকট নিরসনে কী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: ছেলে-মেয়ে সব মিলিয়ে আমাদের সাতটি হল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। ২ হাজার ৮৪১ কোটি টাকার একটা বিশেষ বরাদ্দ আমরা পেয়েছি, সেটা এখন পর্যালোচনার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এটা হয়ে গেলে আমাদের আবাসন সংকট নিয়ে আর বড় কোনো সমস্যা থাকবে না।
আরও পড়ুন: ছাত্রীদের আবাসনে ঢাবিতে নতুন তিনটি হল, ৩টি বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা
আমাদের যে আবাসনের ব্যবস্থা, সেখানে মেয়েদের আবাসনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাজেট না থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত বাজেট জোগাড় করে কিছু তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ছাত্রী হলে ৫০০-এর ওপর ‘বাঙ্ক’ বেড তৈরি করা হয়েছে। কিছু স্থানে পরিবর্তন এনে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা চীন সরকারের সহযোগিতায় একটি হল নির্মাণ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছি। চীন সরকার কয়েক দিন আগে আমাদের একটি চিঠি দিয়ে বলেছে, তারা প্রস্তুত আছে। সরকারের ইকোনমিক রিলেশন ডিভিশন (ইআরডি) থেকে প্রস্তাব গেলেই তারা সাড়া দেবে। চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার তিনবার কথা হয়েছে এ বিষয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের মেধার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ দিচ্ছি। তাছাড়া মেয়েদের ক্ষেত্রে যাদের সরাসরি সিটের ব্যবস্থা করতে পারছি না, তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা এটা দাবি করছি না যে, এই অর্থ তাদের জন্য পর্যাপ্ত বা হলে থাকার বিনিময়ে দিচ্ছি। এটা শুধু আর্থিক সহযোগিতা করা। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব উদ্যোগে করা হচ্ছে এবং আন্তরিকভাবেই আবাসন সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। খাবারের মানের ব্যাপারে সবসময় একটা চিন্তা থাকে, আমরা চেষ্টা করছি। বিভিন্ন হলগুলোতে আমরা নিয়মিত পরিদর্শনের চেষ্টা করছি এবং খরচ যেহেতু আমরা কম রাখি তাই মান এবং খরচের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা কঠিন। সে জন্য নিয়মিত পরিদর্শন করা হয় হলগুলোতে। আমি নিজেও কয়েক জায়গায় গিয়ে খেয়েছি।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ৬ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কার কতটুকু হয়েছে?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: কিছু অভ্যন্তরীণ সংস্কার করা হয়েছে। যেহেতু আমার সময় এবং সম্পদ দুটোই সীমিত, অতএব আমি সবগুলো একসঙ্গে করছি না। আমার স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে সিলেক্টিভলি কিছু কিছু জায়গায় হাত দেওয়া এবং সেটাকে ধীরে ধীরে বাড়ানো ও একটি উদাহরণ তৈরি করা। নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং সেন্টারগুলোতে সায়েন্টিফিক পদ্ধতি ফলো করে একটি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছি। এই কমিটিতে বেশির ভাগ অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র অধ্যাপক রয়েছেন। একইভাবে এটা আমরা আমাদের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও করতে পারি। তবে আমি যদি প্রথমেই শিক্ষক নিয়োগে হাত দেই বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেটি এই মুহূর্তে মোকাবিলা করা কঠিন হবে। তাই আমি চাচ্ছি ভালো উদাহরণগুলো তৈরি করে একটা জনসমর্থন তৈরি হোক। এভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু উপাচার্য বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে আমরা যদি সায়েন্টিফিক উপায়ে একটি নিরপেক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে করি, তখন এটা ভালো ফল দেবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঢাবির প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে উপাচার্যের ক্ষমতা কমছে বলা যায়?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: আমরা উপাচার্যের ক্ষমতা কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করছি। ক্ষমতা কমিয়ে অংশীজনের ভিত্তিতে কাজ করার জন্য প্রশাসনে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিম (এসএমটি) তৈরি করা হয়েছে। সিন্ডিকেট থেকে এটি অনুমোদন করা হয়েছে যেন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধক্ষ্যসহ অপরাপর সদস্যরা মিলে কাজ করবেন এবং যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবেন। এখানে একটি অংশীদারিত্ব ভিত্তিক প্রশাসন পরিচালনার যে গণতান্ত্রিক মত তৈরি করা দরকার সেটা আমরা করেছি এবং সিন্ডিকেটে সেটা অনুমোদন করা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে আমরা একটা নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করছি। ফলে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না।
অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল সিন্ডিকেট ফ্যাসিস্ট মুক্ত করা। সেটা কতটুকু করা সম্ভব হয়েছে?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: ছাত্রদের দাবির প্রেক্ষিতে এবং সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সিন্ডিকেটের পূর্বের কিছু সদস্যদের বাদ দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সরকার থেকে এ নিয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে। ছাত্রদের দাবিকে সম্মান জানিয়ে এবং আমাদের আইনি বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এটা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: ঢাবির সিন্ডিকেটের আওয়ামীপন্থী ৯ সদস্যের সদস্যপদ চালিয়ে না যাওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সম্মতি
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ডাকসু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে কী ভাবছে প্রশাসন?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: আমরা ডাকসু নির্বাচন করতে চাই। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জুলাই স্পিরিটের প্রতি আমাদের কমিটমেন্ট থেকে এটা করতে চাই। কোন রাজনৈতিক দল কি বললো, সেটা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না। আমরা একটি গণতান্ত্রিক, ছাত্রদের অধিকার নির্ভর যে পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে সেটা চালু করতে চাই।
কথা বলছেন অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান
আরও পড়ুন: ডাকসু নির্বাচন করতে চাই, এতে কোনো সন্দেহ নেই: ঢাবি ভিসি
এটি আমাকে একটি বৃহত্তর সমঝোতার ভিত্তিতে করতে হবে। এজন্য তিনটি কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করছে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। তাদের মতামতের ভিত্তিতে প্রক্রিয়া শেষ হলে ডাকসু নির্বাচন কখন হবে, কীভাবে হবে সেটি নির্ধারণ হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাইদের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পর্ক কেমন?
ড. নিয়াজ আহমদ খান: অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনকে রিভাইভ করার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে সাড়ে ১৭ হাজার অ্যালামনাইয়ের একটি লিস্ট তৈরি করা হয়েছে। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এখন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সক্রিয়। বর্তমান প্রশাসনের সঙ্গে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনয়ের তুলনামূলক সম্পর্ক ভালো। তারা বেশকিছু উদ্যোগও নিয়েছে। আমি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনয়ের যেকোনো অনুষ্ঠানে থাকার চেষ্টা করি। তারাও আমাদের বেশ কিছু উদ্যোগে সহযোগিতা করছে।