ইবিতে বছরজুড়ে ঘটে যাওয়া আলোচিত-সমালোচিত যত ঘটনা

ইবি
ইবি  © টিডিসি সম্পাদিত

শেষ হতে চলেছে ২০২৪ সাল। শোনা যাচ্ছে নতুন বছরের পদধ্বনি। দেশের প্রতিটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও ইতিবাচক-নেতিবাচক উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা ঘটেছে যা নিয়ে সরগরম ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ। সেসব আলোচিত ঘটনার কথা তুলে ধরেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস প্রতিনিধি ওয়াসিফ আল আবরার। 

ককটেল উদ্ধার 
বছরের শুরুতেই ৭ জানুয়ারীর সংসদ নির্বাচনের পর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান থেকে একে একে উদ্ধার করা হয় ককটেলসদৃশ ছয়টি বস্তু। ১১ জানুয়ারি দিবাগত রাত ও ১২ জানুয়ারি সকালে ক্যাম্পাসের পৃথক চারটি স্থান থেকে এসকল ককটেলসদৃশ বস্তু উদ্ধার করে পুলিশ। সংসদ নির্বাচনের পরপরই এমন ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। বছরের শুরুতেই এমন ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাহিরে আলোচনা সমালোচনার জন্ম দেয়। 

নেকাব না খোলায় নেওয়া হলো না ভাইভা
নেকাব না খোলায় হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের এক ছাত্রীর সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার ভাইভা (মৌখিক পরীক্ষা) না নেওয়ার ঘটনা ঘটে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর বাকি ছাত্রীদের ভাইভা নিলেও পুরুষ শিক্ষকদের সামনে নেকাব খুলতে অস্বীকৃতি জানালে তার ভাইভা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসলে টক অব দ্যা টাউনে পরিণত হয় এটি। নানা মহলের সমালোচনা ও বাহ্যিক চাপের পরে অবশেষে নেকাব পড়েই ভাইভা দেয় ওই শিক্ষার্থী। 

র‍্যাগিং ও ভাংচুরের ঘটনায় বহিষ্কার 
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্র ভাঙচুরের ঘটনায় এক শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে এবং নবীন শিক্ষার্থীদের র‍্যাগিংয়ের ঘটনায় পাঁচ শিক্ষার্থীকে এক সেমিস্টারের জন্য বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। মেডিক্যাল ভাঙচুরের ঘটনায় আইন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের রেজওয়ান সিদ্দিক কাব্যকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া র‍্যাগিংয়ের ঘটনায় হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হিশাম নাজির শুভ, মিজানুর রহমান ইমন, শাহরিয়ার পুলক, শেখ সালাউদ্দিন সাকিব ও সাদমান সাকিবের প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

নির্মাণকাজে অনুমোদনহীন রডের ব্যবহার 
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩৭ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্পের অধীনে চলমান নির্মাণ কাজে অনুমোদনহীন রড ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। লেকের পাশের ১০ তলাবিশিষ্ট অ্যাকাডেমিক ভবন, ছাত্র হল-২ এবং শেখ রাসেল হলের দ্বিতীয় ব্লকের নির্মাণ কাজে অনুমোদনহীন রড ব্যবহার করা হলে এর পরপরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান 'মাইশা কনস্ট্রাকশন' কে নির্মাণ কাজ বন্ধের নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী। বিএসআরএম, আনোয়ার ইস্পাত, জিপিএইচ ইস্পাত, আকিজ গ্রুপের মেগনাম, এসসিআরএম, এসএস টাইগার ও পূর্বাচল স্টিলের অনুমোদন থাকলেও তালিকার বাইরে গিয়ে 'হাইটেক' নামের রড পিলারের রিং তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরী হয় যা নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

ফুল ছিড়লে সিট বাতিল
শীতে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় হরেক রকমের ফুলে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বছরের অন্যান্য সময় থেকে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ফুল দেখলেই ছবি তোলা এবং কখনো কখনো ছিড়ে নিয়েও যেত শিক্ষার্থীরা। তবে হঠাৎই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলে ‘ফুল ছিঁড়লেই হলের সিট বাতিল করা হবে’— এমন সতর্কবার্তা সম্বলিত পোস্টার টানানো হয়; যা নিয়ে হলের শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাসে দেখা গিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। হঠাৎ করে হুমকিস্বরূপ এমন পোস্টারে হতভম্ব হয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। পরে সমালোচনার মুখে ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে হল প্রশাসন।

শিক্ষার্থীকে কাকতাড়ুয়া সাজিয়ে র‍্যাগিং 
বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের গণরুমে আল ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের নবীন শিক্ষার্থীকে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত নগ্ন করে বেদম প্রহার ও টেবিলের ওপর কাকতাড়ুয়া সাজিয়ে র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ ওঠে ইমিডিয়েট সিনিয়র ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। এসময় হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিষয়টি মীমাংসা করে দিলে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী কোন লিখিত অভিযোগ না দিলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রশাসন। পরে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থীর প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন। 

নির্মাণকাজের বিল নিয়ে নয়ছয়
বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ৫৩৭ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্পের অধীন ১০তলা বিশিষ্ট দ্বিতীয় প্রশাসন ভবন নির্মাণে দুটি আইটেমে ভুয়া বিল প্রদান করে ৬ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা উত্তোলন ও ভাগবাটোয়ারা করে আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী, প্রকল্প পরিচালক, ঠিকাদারসহ একাধিক কর্মকর্তা ও কয়েকজন সাবেক-বর্তমান ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে এ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক সমিতি, বিভিন্ন দপ্তর ও সাংবাদিক সংগঠনের কাছে একটি বেনামি উড়ো চিঠি আসে যার প্রেক্ষিতে তদন্তে নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ১৯ মে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন খোলা হয়। এতে অনিয়মের সত্যতা পেলেও প্রতিবেদনে জড়িতদের শাস্তির সুপারিশে নির্ধারিত ধারা উল্লেখ না থাকায় সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সিন্ডিকেট।

গুচ্ছে থাকা না থাকার নাটক
বছরের শুরুতেই নানা অব্যবস্থাপনার কারণে গুচ্ছে না থাকার পক্ষে মত দেয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। তারই প্রেক্ষিতে বরাবর একাধিক স্মারকলিপি এবং আলাপ আলোচনার প্রেক্ষিতে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২৩ মার্চ সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ১৫ সদস্যের কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক ছাড়া অন্যদের সাতজন গুচ্ছে না যাওয়ার পক্ষে এবং ছয়জন গুচ্ছের পক্ষে মত দেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গুচ্ছে না যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হলে আগ্রহী পক্ষের ছয়জন ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করেন। শেষ পর্যন্ত সরকারের ওপর মহলের অভিপ্রায়ে বিশ্ববিদ্যালয় ফের গুচ্ছে অংশ নিলে জরুরি সাধারণ সভা করে ভর্তি পরীক্ষার মাত্র একদিন আগে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে শিক্ষক সমিতি।

‘যে যত পলিটিক্যালি অ্যাক্টিভ, সে ততো ভালো সিট পাবে ইবির হলে’
২৪ এপ্রিল আইন বিভাগের ২০১৮-১৯ (স্নাতক) শিক্ষাবর্ষের লালন শাহ্ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আরমান হোসেনের বিছানাপত্র হলের বৈধ সিট থেকে নামিয়ে দেয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। লালন শাহ্ হল প্রশাসনের অনুমতিক্রমে ৪৩০ নম্বর কক্ষে আবাসিকতা পরিবর্তন করলেও তার তোশক, বালিশসহ সকল জিনিসপত্র নামিয়ে দিয়ে রাসেল ও অনিক (সমাজকল্যাণ বিভাগ, ২০১৯-২০) বন্ধুদের সহযোগে উক্ত কক্ষ জোর করে দখল করে অবস্থান নেয় এবং ভুক্তভোগী আরমানকে ‘যে যত পলিটিক্যালি অ্যাক্টিভ, সে ততো ভালো সিট পাবে' বলে জানায়। তারা দুজনেই শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের অনুসারী ছিল। গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশের পরে হল প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বৈধ সিট ফিরে পান আরমান। 

সহ-সভাপতি পদ নিয়ে দুই সিরাজের টানাটানি 
দীর্ঘ ৮ বছর পর এবছরের ১০ মে ইবি ছাত্রলীগের ১৯৯ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে ৭১ জন সহ-সভাপতি পদের মধ্যে ৬৬নং সহ-সভাপতি পদ নিয়ে শুরু হয় দুই নেতার টানাটানি। সহ-সভাপতি দাবিদারদের একজন হলেন বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সিরাজুল ইসলাম সিরাজ। অপরজন হলেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সিরাজুল ইসলাম। দুজনেই নিজেদের সহ-সভাপতি দাবি করে ফেসবুকে পোস্ট দেন। উভয়কেই শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনে ভাসিয়ে দেয় নেতাকর্মীরা। পরবর্তীতে ৬৬নং সহ-সভাপতি পদটি বায়োটেকনোলজির সিরাজের বলে নিশ্চিত করে ছাত্রলীগের নেতারা।

ভিসিকে মিষ্টির অফার
চাকরি পেতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালামকে মিষ্টি খেতে ১০ লাখ টাকার অফার দেয় মিথি নামের এক তরুণী। ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাওয়া ক্ষুদে বার্তায় বলা হয়, ‘স্যার ১০ লাখ মিষ্টি খেতে নেন। এটা আপনি আর আমি ছাড়া কেউ জানবে না। আমার সত্যিই ওখানে কেউ নেই, প্লিজ স্যার চাকরিটা খুব দরকার।’ পরে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এইচ এম আলী হাসান।

রেজিস্ট্রারের অশ্লীল ভিডিও ফাঁস
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এইচ এম আলী হাসানের চেহারা সদৃশ একটি অশ্লীল ভিডিও রেকর্ড ফেসবুকে ভাইরাল হয়। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ওই নারীর সঙ্গে রেজিস্ট্রার অশ্লীল কর্মকাণ্ড করেছেন বলে পোস্টের ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়। ১ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডের ভিডিওটি ফাঁস হলে ক্যাম্পাসজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষকদের সংগঠন ‘শাপলা ফোরাম’, রেজিস্ট্রারকে সাময়িকভাবে অব্যাহতির দাবিও জানায় তারা। তবে হেনস্তা করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি পক্ষ এআই দিয়ে এডিট করেছে বলে দাবি করেন রেজিস্ট্রার। আর উড়ো জিনিসের উপর ভিত্তি করে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না,  কারো কাছে শক্তিশালী প্রমাণ থাকে উপস্থাপনের আহ্বান জানান উপাচার্য।

খালেদা জিয়া হলে দফায় দফায় আগুন 
দফায় দফায় আগুন লাগার ঘটনায় বছর জুড়েই আলোচনায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের খালেদা জিয়া হল। ১৯ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে ৫টার দিকে হলের ডাইনিংয়ে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর আগে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে হলটির পুরাতন ব্লকে বেশ কয়েকবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। গত ৭ জুলাই আনুমানিক রাত ১০ টার সময় হলে শর্ট সার্কিটের কারণে আগুন লাগে। পুরো ২ ঘণ্টা ধরে কাজ করে তারা সমাধান দিয়ে যান ও আর কোনো সমস্যা হবে না বলে জানান তারা। ঠিক তার পরের দিন সকাল সাড়ে ৬ টায় আবারও ভয়াবহ আগুন লাগে হলে। এরপর গত ১০ জুলাই আবারও সমস্যা সৃষ্টি হয়। গত ২ সেপ্টেম্বর আবারও হলে শর্ট সার্কিট এর সমস্যা এবং পোড়া গন্ধ পাওয়া গেলে অনুসন্ধান করে জানা যায় তার লুজ রেখেই চলে গিয়েছিল। ফলে গত ৫ সেপ্টেম্বর আবার একই সমস্যা দেখা দেয় হলে। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন 
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উত্তপ্ত ছিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। ২ জুলাই সর্বপ্রথম মিছিল করে ছাত্র ইউনিয়ন। এরপরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার দাবিতে একইসাথে মানববন্ধন করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কাউন্সিল। এরপর ক্রমেই বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। শুরু হয় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ ও বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি। ১১ জুলাই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ক্যাম্পাসের মেইন গেটের বাইরে বিক্ষোভ করতে থাকে বৈষম্যবিরোধীরা, ভেতরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ। দুপক্ষের মাঝে অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের জেরে রাজাকার রাজাকার স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পরদিন ক্যাম্পাসে পাল্টা বিক্ষোভ করে ছাত্রলীগ। আন্দোলনে যাওয়ায় ইবি শিক্ষার্থী মাহফুজকে মারধর করে ছাত্রলীগ নেতা হাফিজ। এরপর ১৭ জুলাই হঠাৎ বন্ধ ঘোষণা করা হয় ইবি, দুপুর ১ টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় প্রশাসন। ওইদিনই সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর বিক্ষোভ হয় ক্যাম্পাসে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও থেমে থাকেনি আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাপ দিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় কুষ্টিয়া শহর থেকে ১৮ শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ, মধ্যরাতে তাদের ছাড়িয়ে আনেন শিক্ষকরা। সরকার পতনের ১দফার পক্ষে ৩রা আগস্ট মাথায় লাল কাপড় বেঁধে একত্রিত হয়ে রাজপথে নামেন ইবি শিক্ষকবৃন্দ, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান স্থানীয় জনতা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ৫ আগস্ট পতন ঘটে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের। 

হল থেকে অস্ত্র উদ্ধার 
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের ছাত্রলীগের নেতাদের রুমে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র, মদের বোতল ও নেশাজাত দ্রব্য উদ্ধার করা হয়। এ সময় বিভিন্ন রুম থেকে ১০ টি রামদা, ৫ টি চাপাতি, ৫০ পিস রড, দুটি হকিস্টিক, একটি চাইনিজ কুড়াল, দুটি হ্যান্ড স্টিক, ২০০ গ্রাম পেট্রোল, একটি দেশীয় অস্ত্র, ছয়টি বুলেট ও একটি হ্যান্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও ২০টি মদের বোতল, ৯টি ইয়াবা স্টিক, প্রায় ৫০০ গ্রাম গান পাউডার, দুই বোতল ফেনসিডিল ও জন্ম নিরোধক দ্রব্য পাওয়া যায়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করলে তারা এসে উদ্ধারকৃত দ্রব্যাদি নিয়ে যায়।

ভিসি নিয়োগ আন্দোলন 
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পরে ৮ আগস্ট একযোগে পদত্যাগ করেন ইবির ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ হলেও ইবিতে না হওয়ায় ভিসি নিয়োগের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের বাধ্যবাধকতা থাকায় জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক নিয়োগ হলেও ক্লাস-পরীক্ষা শুরু করতে না পারায় অনশনও করে দুই শিক্ষার্থী। ফলে ভিসি নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতার প্রতিবাদে ২০ সেপ্টেম্বর বিকেলে থেকে টানা ৪দিন কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ইবি শিক্ষার্থীরা। 

শিবিরের আত্মপ্রকাশ 
ঢাবি, চবি ও জবির পর ২৮ অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবির৷ সংগঠনটির পল্টন ট্র্যাজেডি দিবস উপলক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টের মাধ্যমে দুইজনের পরিচয় প্রকাশ করা হয়। ইবি ছাত্রশিবিরের সভাপতির নাম এইচ এম আবু মুসা ও সম্পাদক মাহমুদুল হাসান। সভাপতি আবু মুসা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের এবং সম্পাদক মাহমুদুল হাসান ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে প্রশাসনের নিকট ১১০ দফা প্রস্তাবনা দেয় সংগঠনটি। 

ফের র‍্যাগিং; মামলায় আটক ৫
বছরের শুরুর ন্যায় শেষের দিকেও ঘটে নবীন শিক্ষার্থীদের র‍্যাগিংয়ের ঘটনা। এবারেও দৃশ্যপটে সেই লালন শাহ হলের গণরুম।  মধ্যরাতে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের র‍্যাগিংয়ের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ৫ শিক্ষার্থীকে হাতেনাতে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে হলের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা। এসময় একজনকে পাঁচ রকমের হাসি, একজনকে সিনিয়র ভাইকে কল দিয়ে বাজে ভাষায় কথা বলতে এবং আরেকজনকে নাচতে বলা হয়। এর আগেও ভুক্তভোগীদের পর্ণ তারকাদের নাম জিজ্ঞাসা ও তাদের রোল প্লে করতে বলা এবং অশ্লীল কবিতা পাঠ করানো হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা থানায় মামলা দায়ের করলে অভিযুক্ত ৫ শিক্ষার্থীকে কোর্টে চালান দেওয়া হয়। পরেরদিন জামিনে ছাড়া পায় তারা।

সিট বরাদ্দে বৈষম্যের অভিযোগ 
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর রহমান হলের অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের আবাসিকতা প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘোষণায় সমালোচনার ঝড় উঠে ক্যাম্পাসজুড়ে। প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি ও জিয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. এ বি এম শেখ জাকির হোসেনের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায় শিক্ষার্থীরা। পরে অবশ্য টাইপিং মিস্টেকের দোহাই দিয়ে বিজ্ঞপ্তিটি বাতিল করে পুনরায় বিজ্ঞপ্তি দেয় হল প্রশাসন। 

হলে প্রবেশের সময়সীমা নির্ধারণ; সমালোচনার ঝড়
আবাসিক শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশের সময়সীমা নির্ধারণ করে তুমুল সমালোচনার জন্ম দেয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রশাসন। মেয়েদের মাগরিবের আজানের ১৫ মিনিট এবং ছেলেদের রাত ১১টার মধ্যে হলে প্রবেশের নির্দেশনা দিলে সর্বমহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। চতুর্মুখী সমালোচনা ও নেটিজেনদের ট্রলে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরা নির্দেশনা বাতিলের জোড়ালো দাবি জানালে শীতকালীন ছুটি শেষ হওয়া পর্যন্তই এই সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকবে বলে জানায় প্রভোস্ট কাউন্সিল।


সর্বশেষ সংবাদ