রাজনৈতিক দলগুলোর বিজ্ঞপ্তিতে অসংগতি ও ভুল বানানের ছড়াছড়ি

টিডিসি সম্পাদিত
টিডিসি সম্পাদিত

রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তি বা বিবৃতি দিয়ে থাকে। এসব বিজ্ঞপ্তি বা বিবৃতি জনগণের কাছে দলের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তবে এসব বিবৃতিতে অসংগতি ও ভুল বানানের ছড়াছড়ি লক্ষ করা যায়, যা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। বিজ্ঞপ্তিতে যেসব ভুলগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, সেগুলোর শুদ্ধীকরণ নিয়ে থাকছে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের আজকের এই পর্ব।

বিসমিল্লায় গলদ
অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বিজ্ঞপ্তির শুরুতে ‘বিসমিল্লাহীর রাহমান রাহীম’ দিয়ে শুরু করে। অথচ তিনটা শব্দ নিয়ে গঠিত এই বাক্যের তিনটি শব্দই অশুদ্ধ। আমরা জানি, বিদেশি শব্দে ঈ-কার পরিহার্য। উপর্যুক্ত বাক্যটি আরবি শব্দ। তাই ঈ-কার পরিহার্য। বাক্যটির শুদ্ধরূপ হলো ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’। [বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ৯৯৪ ও ১১৬৯]

বিসর্গ ও কোলন নিয়ে তালগোল
সবচেয়ে বেশি যে ভুল দেখা যায়, তা হলো কোলনের (:) জায়গায় বিসর্গ (‌ঃ) বসানো। যেমন তারিখঃ, ফোনঃ, ফ্যাক্সঃ, সূত্রঃ, ই-মেইলঃ, ওয়েবসাইটঃ প্রভৃতি। এগুলো সবই অশুদ্ধ। শুদ্ধরূপ হলো তারিখ:, ফোন:, ফ্যাক্স:, সূত্র:, ই-মেইল:, ওয়েবসাইট:।

আরও পড়ুন: ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নতুন তারিখ ঘোষণা

কারণ বিসর্গ (ঃ) কোনো যতিচিহ্ন নয়, এটি বাংলা বর্ণমালার একটি স্বাধীন বর্ণ। এর নিজস্ব উচ্চারণ আছে। পদান্তে অবস্থিত বিসর্গ বর্ণের উচ্চারণ—হ্। যেমন আঃ (আহ্), উঃ (উহ্), ওঃ (ওহ্), ছিঃ (ছিহ্), বাঃ (বাহ্) প্রভৃতি। আবার বিসর্গের স্থলে কোলন ব্যবহার করা যাবে না। যেমন: দু:খ (দুঃখ), আ: (আঃ)। সুতরাং যতিচিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত কোলন (:) বা সংক্ষেপণ চিহ্নের (.) স্থলে বিসর্গ বিধেয় নয়।

গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিকে ইংরেজি বর্ষপঞ্জি হিসেবে দেখা
অধিকাংশ বিজ্ঞপ্তিতে এই ভুল দেখা যায়। যেমন: ২৩-০২-২০২৫ ইং। এটা একটা মারাত্মক ভুল। কারণ ‘ইং’ বা ‘ইংরেজি’ নামের কোনো বর্ষপঞ্জি নেই। এর নাম গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি। বাংলায় খ্রিষ্টাব্দ, সংক্ষেপে: খ্রি.। তাই ‘২৩-০২-২০২৫ ইং’ না হয়ে ‘২৩-০২-২০২৫ খ্রি.’ হবে।

-এর, এর, য়ের
‘এর’ ষষ্ঠী বিভক্তি। এটি সাধারণত ‘র’ ধ্বনি হয়ে পূর্ববর্তী পদের সঙ্গে সেঁটে বসে। যেমন: বাংলাদেশ এর, সম্মেলন এর, মার্চ এর, অন্যায় এর প্রভৃতি না হয়ে বাংলাদেশের, সম্মেলনের, মার্চের, অন্যায়ের হবে। তবে ‘র’ ধ্বনিকে ‘এর’ বানানে মূল পদ থেকে পৃথক রাখতে হলে অবশ্যই হাইফেন (-) দিতে হবে। নইলে ‘এর’ অর্থ হয়ে যায় তাহার, তার, ইহার, এটির। যেমন: বাংলাদেশ-এর, সম্মেলন-এর, মার্চ-এর, অন্যায়-এর প্রভৃতিও শুদ্ধরূপ। তেমনি ‘সার্চলাইট এ’ না লিখে, ‘সার্চলাইটে’ অথবা ‘সার্চলাইট-এ’ লিখতে হবে।

পরবর্তী ও পরবর্তীতে
অধিকাংশ বিজ্ঞপ্তিতে ‘পরবর্তীতে’ শব্দটি লেখা থাকে। তবে এটা ভুল প্রয়োগ। ‘পরবর্তী’ মানে পরের সময়, কাল, বস্তু, ধারণা বা অন্য যেকোনো কিছু হতে পারে।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘ইসরায়েল ব্যতীত’ শর্ত যুক্ত করল সরকার

‘পরবর্তী’ সম্পূর্ণ স্বাধীন কোনো শব্দ নয়। এর সঙ্গে অন্য কোনো শব্দ বা শব্দাংশ যুক্ত হলেই কেবল অর্থ দেয়। যেমন: পরবর্তী বছর, পরবর্তী সময়, পরবর্তী যুগ, পরবর্তী মানুষ, পরবর্তী শ্রেণি প্রভৃতি। তাই কোনো অসম্পূর্ণ শব্দে ‘বিভক্তি’ যুক্ত করা সমীচীন নয়। এমনটা করলে শব্দটি আরও অর্থহীন ও অসম্পূর্ণ হয়ে যায়। তাই ‘পরবর্তী সময়’ বা ‘পরবর্তী কাল’ প্রকাশের জন্য ‘পরবর্তীতে’ শব্দের ব্যবহার সমীচীন নয়।

ন্যক্কারজনক, পন্থি, পন্থী
‘ন্যাক্কারজনক’ শব্দটি অশুদ্ধ। এর প্রমিতরূপ ন্যক্কারজনক। যার অর্থ অত্যন্ত নিন্দনীয়, ঘৃণ্য। যেমন: এটা খুবই ন্যক্কারজনক কাজ। [সূত্র: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ৭৬৩]

অন্যদিকে ‘পন্থি’হিন্দি উৎসের শব্দ। তাই ঈ-কার পরিহার্য। যেমন: বিএনপিপন্থি, জামায়াতপন্থি, আওয়ামীপন্থি প্রভৃতি। [সূত্র: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ৭৮১]

প্রেক্ষিতে, পরিপ্রেক্ষিতে
দুটোই শব্দই সঠিক। তবে এদের অর্থ ও প্রয়োগ আলাদা। বাক্যে সাধারণত বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অর্থ: পটভূমি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, প্রেক্ষাপট, দৃশ্যপট। তাই এমন অর্থ প্রকাশ করতে ‘প্রেক্ষিতে’ না লিখে লিখতে হবে ‘পরিপ্রেক্ষিতে’। যেমন: গতকাল দুপক্ষের মারামারির পরিপ্রেক্ষিতে (প্রেক্ষিতে নয়) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সূত্র: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ৭৯১]

আরও পড়ুন: ২০০৯ থেকে ২৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে ঢাবির কমিটি

অন্যদিকে বাক্যে সাধারণত বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ‘প্রেক্ষিত’ অর্থ দর্শন করা হয়েছে এমন, দেখা হয়েছে এমন, প্রেক্ষণ করা হয়েছে এমন। যেমন: সচিব কর্তৃক প্রেক্ষিতের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেক্ষিত স্থানে বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠার অনুমোদন পাওয়া গেল। [সূত্র: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ৮৮৬]

অনুষ্ঠিতব্য, অনুষ্ঠাতব্য
অনুষ্ঠিতব্য ভুল প্রয়োগ। বাংলা একাডেমি প্রণীত আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘অনুষ্ঠিতব্য’ বলে কোনো শব্দ নেই। শব্দটি ব্যাকরণগতভাবে অশুদ্ধ। শব্দটির সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় অনু+স্থা+তব্য=অনুষ্ঠাতব্য। তাই ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিত হবে অর্থে ‘অনুষ্ঠাতব্য’ অথবা ‘অনুষ্ঠেয়’ লিখতে হবে; ‘অনুষ্ঠিতব্য’ নয়। 
[সূত্র: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ৫১]

কোন, কোনো 
‘কোন’ শব্দটি যখন সর্বনাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন এর অর্থ কী, কে, কোনটি (কোন দিন, কোনটি চাই, কোন জন)। এটি কোনও বা কোনো শব্দের সমার্থক নয়। যেমন ‘আপনি কোন দেশে থাকেন’ বাক্যে একই অর্থ প্রকাশের জন্য ‘কোনও’ বা ‘কোনো’ পদ ব্যবহার করা যাবে না। বাক্যে সর্বনাম ও বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা ‘কোনো’ শব্দের অর্থ অনির্দিষ্ট বা অনির্ধারিত একজন লোক বিষয় বা বস্তু, কে বা কী (কোনো বিষয়), বহুর মধ্যে একটি বা একজন। যেমন ১. তুমি কোন কলমটি নেবে? ২. তুমি তো কোনো কাজই করো না।

ছিলো, ছিল/গেল,গেলো/কেন, কেনো
‘ছিল’ অর্থ থাকা। ‘ছিলো’ হলো ‘ছিলে ফেলা’। ১. আমার একটা টিয়া পাখি ছিল (থাকা)। ২. তুমি রসুনগুলো ছিলো (খোসা ছাড়ানো)।

অন্যদিকে ‘গেল’ অর্থ গিয়েছিল, কিন্তু ‘গেলো’ অর্থ গিলে ফেল। যেমন: ১. রহিম নানা বাড়ি গেল (গিয়েছিল)। ২. তাড়াতাড়ি ভাত গেলো (গলাধঃকরণ করা)।

আরও পড়ুন: ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম পরিবর্তনের কারণ জানানোর দাবি চারুকলার শিক্ষার্থীদের

‘কেন’ অর্থ কী জন্য, কীসের জন্য, কী কারণে। এটি প্রশ্নবোধক অব্যয়। যেমন: তুমি কেন এসেছ? তুমি তাকে কেন মেরেছ? অন্যদিকে ‘কেনো’ অর্থ ক্রয় করার অনুজ্ঞা, কিছু কেনার জন্য বলা। যেমন: মাছটি কেনো। তাড়াতাড়ি কেনো।

হল/হলো, মত/মতো
অধিকাংশ বিজ্ঞপ্তিতে হইল অর্থে ‘হল’ লিখেতে দেখা যায় হয়। যা ভুল। কারণ বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী, ‘হল’ মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাস। হইল অর্থে ‘হলো’ এবং আবাসিক স্থান বোঝাতে ‘হল’ লিখতে হবে। 
যেমন: আমি হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী হলে থাকি। তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা...। (রবীন্দ্রনাথ)

ইতোমধ্যে/ইতিমধ্যে, ইতোপূর্বে/ইতঃপূর্বে
সংস্কৃত ‘ইতঃ (ইতস্)’ একটি অব্যয়। এর অর্থ এই, এই স্থানে, এই স্থান থেকে প্রভৃতি। ‘ইতঃ’ শব্দের সঙ্গে ‘পূর্বে’ ও ‘মধ্যে’ শব্দের সন্ধি করলে সন্ধির নিয়মানুসারে ‘ইতঃপূর্বে (ইতঃ + পূর্বে)’ এবং ‘ইতোমধ্যে (ইতঃ+মধ্যে)’ শব্দ গঠিত হয়। এই কারণে অভিধানগুলোতে সাধারণত ‘ইতিপূর্বে’ ও ‘ইতিমধ্যে’ শব্দ দুটোকে অশুদ্ধ উল্লেখ করা হয়। সূত্র: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ১৮১]

দেওয়া/দেয়া, নেওয়া/নেয়া
অভিধানমতে, ‘দেয়া’ শব্দের অর্থ দেওয়া (give) নয়, ‘দেয়া’ শব্দের অর্থ মেঘ, মেঘের গর্জন, আকাশ, বৃষ্টি, বর্ষণ প্রভৃতি। যেমন: রিমি ঝিম রিমি ঝিম নামিল দেয়া শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া’/ ‘নদীতে নাই খেয়া যে, ডাকল দূরে দেয়া যে।’

আরও পড়ুন: ঢাবির ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা নতুন করে নিতে চায় কর্তৃপক্ষ: শিশির মনির

অন্যদিকে কোনো কিছু বহন করা বা গ্রহণ করা, ক্রয় করা প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে ‘নেওয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন: আমার কিছু বই নেওয়া দরকার। বিমানের টিকেট নেওয়া হলো। ‘নেয়া’ হচ্ছে ‘নেওয়া’ শব্দের আঞ্চলিক রূপ, যা প্রমিত রীতিতে ব্যবহার করা অসংগত। দেওয়া ও নেওয়া অর্থে যথাক্রমে দেয়া ও নেয়া বসানো অসংগত।

বহুবচনবাচক পদের সঙ্গে ‘-কে বিভক্তি’
এই ভুলটা অধিকাংশ বিজ্ঞপ্তি লক্ষ করা যায়। নিয়মটা হলো ‘র’-আছে এমন বহুবচনবাচক পদে ‘-কে বিভক্তি’ পরিহার্য। যেমন: তাদেরকে, আমাদেরকে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রভৃতি অশুদ্ধরূপ। শুদ্ধ হলো তাদের, আমাদের, মুক্তিযোদ্ধাদের। ‘তিনি আমাদেরকে পড়াতেন’ না লিখে লিখতে হবে ‘তিনি আমাদের পড়াতেন’।

সহ-সভাপতি না কি সহসভাপতি
সহ-সভাপতি>সহসভাপতি [সব সময় ‘সহ’ একসঙ্গে বসবে না। যেমন:
১. ‘সহ’ শব্দের আদিতে নিরেটভাবেই বসবে। যেমন: সহযোগী, সহকারী, সহপরিচালক, সহশিক্ষক। 
২. ‘সহ’ (সহনশীল) অর্থে শব্দের শেষে নিরেটভাবে বসবে। যেমন: ঘাতসহ।
৩. ‘সহ’ শব্দের শেষে (সহিত বা সঙ্গে) অর্থে হাইফেন দিয়ে বসবে। যেমন: মাল-সহ, ব্যাখ্যা-সহ, শ্রদ্ধা-সহ ইত্যাদি
সূত্র: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ১৩১০ ও ১৩১১।]


সর্বশেষ সংবাদ