প্রতারকের কারসাজি: আইনি জটিলতা ও সংশোধন

কামরুজ্জামান পলাশ
কামরুজ্জামান পলাশ  © টিডিসি ফটো

কাওসার আলম, কলেজের গণ্ডি পেরিয়েছে মাত্র। নিজেকে পরিচয় দেন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আর প্রেমের ফাঁদে ফেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে। সূত্রঃ দৈনিক সমকাল ২ আগস্ট ২০১৭। নাম তার শাহনুর রহমান সিক্ত, বলা যায় বিয়েই করা যার নেশা ও পেশা। নিজেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়েই করেছেন ১২ খানা। তাছাড়া চাকরি দেয়ার নাম করে হাতিয়েছে নগদ টাকা। সূত্রঃ দেশ রুপান্তর ৫ মার্চ ২০১৯

মমতাজ বেগম নামে এক নারির বিরুদ্ধে বিদেশ পাঠানোর কথা বলে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২। কুয়েত পাঠানোর নাম করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাইমুম ইসলাম রাকিব নামের এক প্রবাস ফেরত প্রতারককে গ্রেফতার করে র‍্যাব-৬। সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব ১২ নভেম্বর ২০২১।

এমন অজস্র রয়েছে প্রতারণার অভিযোগ। কিন্তু প্রশ্ন হলো অভিযুক্তরা কি আদৌ শাস্তি পাচ্ছে? এবং ভিকটিম অর্থাৎ ভুক্তভোগীরা কীভাবে প্রতিকার পাচ্ছেন?

আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী প্রতারনার শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে “দন্ডবিধি-১৮৬০” র ধারা ৪১৫ থেকে ধারা-৪২০ পর্যন্ত।

ধারা-৪১৫ তে প্রতারনার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে-

I. প্রতারক কতৃক কোন ব্যক্তি জালিয়াতি বা অসৎ উপায়ে প্রতারিত হবেন
II. যাতে করে উক্ত প্রতারণার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে কোন সম্পত্তি হস্তান্তর করে বা অবৈধভাবে রক্ষিত রাখবেন, বা
III. প্রতারক কতৃক প্রভাবিত হয়ে কোন কাজ করবেন বা কোন কাজ করা থকে বিরত রাখবেন, যা তিনি প্রতারিত না হলে করতেন না, বা
IV. এবং উক্ত কার্য সম্পাদন বা বিরত থাকার মাধ্যমে ওই ব্যক্তির শরীর, মন, খ্যাতি বা সম্পত্তির ক্ষতি বা ক্ষতির কারণ হতে পারে।

ধারা-৪১৭ এ বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ধারা-৪১৫ অনুযায়ী প্রতারণা করবেন, তিনি সর্বোচ্চ ১(এক) বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা প্রদান অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আরও পড়ুন: মদ্যপান বা মদ ঘরে রাখা বিষয়ে কী বলে দেশের আইন?

ধারা-৪১৬ এ “চিটিং বাই পারসোনেশন” বা পরিচিতি প্রতারণা’র কথা বলা হয়েছে। যেখানে, প্রতারক
I. প্ররারণার মাধ্যমে অন্য কোন ব্যক্তির পরিচয় ধারণ করার ভান(অনুকরন) করে
II. ইচ্ছাকৃতভাবে একজনের পরিবর্তে অন্যব্যাক্তির পরিচয় প্রতিস্থাপন করবেন বা
III. নিজেকে বা অন্য ব্যক্তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করবেন, যা বাস্তবে তারা তাই নয়।

ধারা-৪১৯ এ “চিটিং বাই পারসোনেশন” বা পরিচিতি প্রতারণার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। যা সর্বোচ্চ ৩(তিন) বছর কারাদণ্ডাদেশ বা জরিমানা প্রদান অথবা উভয় দণ্ড।

ধারা-৪২০ এ প্রতারণা ও বেআইনীভাবে সম্পত্তি হস্তান্তরে প্ররোচনার সংজ্ঞা ও শাস্তি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রতারক প্রতারনা ও অসৎভাবে

I. কোন সম্পত্তি অন্য কোন ব্যক্তিকে হস্তান্তরের জন্য প্ররোচিত করে, বা
II. কোন মূল্যবান সামগ্রী পুরো বা আংশিকভাবে পরিবর্তন বা ধ্বংস, বা
III. যেটি সাইন ও সীলমোহরযুক্ত, এবং
IV. যেটি অমূল্যবান সম্পত্তিতে রুপান্তরযোগ্য

তাহলে উক্ত প্রতারক, সর্বোচ্চ ৭(সাত) বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা প্রদান অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। উপরিউক্ত ধারায় আনিত অভিযোগগুলো জামিন যোগ্য অপরাধ। আর আইনের দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে প্রতারকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না।

এবার আসা যাক ভিকটিম অর্থাৎ ভুক্তভোগীরা আদৌ কি প্রতিকার পাচ্ছেন? আপাতদৃষ্টীতে তা বলা যাচ্ছে না। কেননা প্রতারকরা সহজেই জামিন নিয়ে নতুন ভাবে তাদের প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করে। আর এইদিকে বিদেশ যাওয়ার জন্য সর্বস্ব বিক্রি করে অসহায় হয়ে যাচ্ছে হাজারো বেকার যুবক।

এখন বলা যায় যে, তারা তাদের টাকা উদ্ধারের জন্য মানি স্যুট বা টাকা আদায়ের মামলা করতে পারে। কিন্তু এভাবে যদি সকল ভুক্তভোগী মামলা করে তাহলে আদালতের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ব্যহত হবে ও মামলা জট বেড়ে যাবে। যদিও আমাদের সকলেরই সিভিল বা দেওয়ানী মামলার ডিউরেশন বা সময়কাল সম্পর্কে ধারণা আছে।

অপরাধ প্রবনতা কমানোর জন্য আমরা এক্সেমপ্লারী পানিশমেন্ট বা অনুকরণীয় শাস্তির কথা ভাবতে পারি। যাতে করে অপরাধী শাস্তি পেয়ে নিজেকে শুধরিয়ে নেয় এবং তার সাজা দেখে সমাজের অন্যান্য অপরাধী নিজেকে অপরাধ ও অপরাধী থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

তাই প্রতারনার শাস্তি বাড়ানোর পাশাপাশি এমন কোন প্রভিশন বা আইন করা প্রয়োজন যাতে করে প্রতারণার মামলা চলাকালে ভিকটিম অর্থাৎ ভুক্তভোগীদের কথা মাথায় রেখে তাদের কাছ থেকে সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহন করে এক ট্রায়ালেই বা বিচারিক আদালতে প্রতারনার শাস্তি প্রদান ও ভুক্তভোগীদের আত্মসাৎকৃত টাকা ফিরিয়ে দেয়ার আদেশ দেয়ার মাধ্যমে মাল্টিপ্লিসিটি অফ স্যুট বা বহু মামলা কমার পাশাপাশি বিচার লাভে কম সময় ব্যয় হবে। তাহলেই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি


সর্বশেষ সংবাদ