চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম অর্থবছরে ১১ অনিয়ম

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চাঁবিপ্রবি) প্রতিষ্ঠার প্রথম অর্থবছরেই বড় ধরনের ১১টি অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বাজেট পর্যালোচনায় উচ্চশিক্ষালয়টির এসব অনিয়ম ধরা পড়েছে। নিয়োগ ও বেতন-ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে অনিয়ম, রাজস্ব ক্ষতি, স্থায়ী সম্পদের রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ না করা, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট কমিটি গঠন না করাসহ মোটাদাগে এসব অনিয়মের বিষয়গুলো সামনে এসেছে।

কমিশনের একটি দল ২০২১ সালের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০২১-২২ অর্থ বছরের সংশোধিত ও ২০২২-২৩ অর্থ বছরের মূল বাজেট পরীক্ষাকালে এসব আর্থিক অনিয়ম পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চাঁবিপ্রবিকে এসব নিয়মবহির্ভূত অবস্থান থেকে উত্তরণে বিষদ পরামর্শও দিয়েছে ইউজিসি। যদিও এসব অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার। তিনি এ দায়িত্ব পাওয়ার আগে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক ও সিএসই বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিজস্ব কোনো স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকায় চাঁদপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ওয়াপদা গেট সংলগ্ন খলিশাডুলীতে চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে একটি ভাড়া বাড়িতে পাঠদান চলছে। সেখানে পাঁচ তলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে ক্লাস করছেন সরকারি এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

এরইমধ্যে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছভুক্ত ‘এ’ ইউনিটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৩০, ‘বি’ ইউনিটে ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি বিভাগে ৩০ এবং ‘সি’ ইউনিটে ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগে ৩০ জনসহ মোট ৯০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. শাহ আলম স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে জানানো হয়েছে, কমিশনের বাজেট পর্যালোচনা দল চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেট পরীক্ষাকালীন সময় আর্থিক নানা অনিয়ম পরিলক্ষণ করেছে।

এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মের ব্যত্যয়, ক্রয় সংক্রান্ত ভাউচারে সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর না নেয়া, ভ্যাট ও আয়কর কর্তন করা হলেও বিলে তা প্রদর্শন না করা এবং সঠিকভাবে হিসেব সংরক্ষণ না করার বিষয়গুলো পরিলক্ষিত হয়েছে কমিশনের পর্যালোচনায়।

ইউজিসির অর্থ ও হিসাব বিভাগের একটি চিঠিতে জানানো হয়েছে, কমিশনের বাজেট পর্যালোচনা দল চাঁবিপ্রবির ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেট পরীক্ষাকালীন সময় আর্থিক নানা অনিয়ম পরিলক্ষণ করেছে।

এর বাইরে কমিশনের নজরে এসেছে, পর্যালোচিত সময়ে আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধিবদ্ধ কমিটি গঠন না করার বিষয়টিও। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে তখন সংবিধিবদ্ধ কমিটি না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, অর্থ কমিটি ও রিজেন্ট বোর্ড। ফলে ওই সময়ে কোনো কমিটি ছাড়াই পরিচালিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির সব কার্যক্রম।

এতে কোনো কমিটি ছাড়াই উচ্চশিক্ষালয়টির সব কার্যক্রম একাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার। ইউজিসি তখন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এসব কমিটি গঠন করে পাঠদানের সুপারিশও জানিয়েছিল একই চিঠিতে।

এর আগে ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১৯ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ সংক্রান্ত বিলটি জাতীয় সংসদে পাস হয় ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে। এরপর একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সরকারি গেজেটের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। তবে উচ্চশিক্ষালয়টির কোনোরকম অবকাঠামোগত উন্নয়ন না করেই গেল বছর পাঠদান শুরু করে।

২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে চাঁবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পান অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার। তার দায়িত্ব গ্রহণের পরই এসব অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে—পর্যালোচনায় এমনটিই জানিয়েছে ইউজিসি।

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের প্রস্তাবিত স্থান

যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধরনের আর্থিক কিংবা প্রশাসনিক অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার। তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেছেন, এগুলো গতানুগতিক এবং সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটে। এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। এ সময় উপাচার্য প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগের সত্যতা জানতে চান এবং যদি কোনো অনিয়ম হয়—তাহলে তার ব্যাখ্যা তিনি ইউজিসিকে দেবেন বলেও জানিয়েছেন। 

ইউজিসির পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থ ও হিসাব বিভাগের হিসাব কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামকে অনুমোদিত পদের বিপরীতে ছয় মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কোনো অনুমোদিত নথি এবং চুক্তির কপি পায়নি কমিশন। ফলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে জানিয়েছে কমিশন।

এছাড়াও সদ্য প্রতিষ্ঠিত এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞাপন বিলের ওপর আয়কর ৪ শতাংশ এবং সার্ভিস চার্জ ২ শতাংশ কর কর্তন না করে আর্থিক বিধির লঙ্ঘন ও সরকারের রাজস্ব ক্ষতি; বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সম্পত্তির রেজিস্টার সংরক্ষণ না করা; বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ দাপ্তরিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নেয়ার মতো অনিয়মগুলোও ধরা পড়েছে কমিশনের পর্যালোচনায়।

আরো পড়ুন: মাস্টার্সে আগ্রহ কমছে স্নাতকদের

একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ক্রয় সংক্রান্ত ভাউচারে সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর না নেয়া; ভ্যাট ও আয়কর কর্তন করা হলেও বিলে তা প্রদর্শন না করা; স্টক রেজিস্ট্রার, হাজিরা খাতা ও ছুটির রেজিস্ট্রার সংরক্ষক না করা; অগ্রিম রেজিস্টার, হিসাব যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করার মতো এসব অনিয়ম বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ জানিয়েছে ইউজিসি।

বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে একাধিকবার বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) অর্থ ও হিসাব শাখার বর্তমান পরিচালক আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে। তবে বিষয়টি নিয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে ইউজিসির এক শীর্ষ কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, পর্যালোচনায় যে অনিয়মগুলো এবং অসঙ্গতি উঠে এসেছে, সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তি করা হবে| বিশ্ববিদ্যালয় যথাযথভাবে পরিচালনা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য দোষীদের শাস্তি এবং নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিষয়ে আমরা জোর দিচ্ছি।


সর্বশেষ সংবাদ