কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় © লোগো
প্রতিষ্ঠকালীন পরবর্তী এই প্রথম বারের মতো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (কুকসু) নির্বাচনের লক্ষ্যে খসড়া প্রণয়ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই এই খসড়াতেও হল সংসদে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের প্রার্থিতা ও ভোটাধিকার প্রদান করা হয়েছে। তবে, আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের প্রার্থিতা ও ভোটাধিকারের বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
২৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে কুকসু গঠনতন্ত্রের খসড়া প্রকাশ করার পর থেকে হল শিক্ষার্থীদের একাংশের মাঝে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের প্রার্থিতার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায়। প্রতিবাদস্বরূপ কয়েকটি হলের শিক্ষার্থীদের একাংশ হল সংসদে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার বাতিল চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে।
গঠনতন্ত্রের খসড়া অনুযায়ী, অনুষ্ঠাতব্য হল সংসদ নির্বাচনে হল শিক্ষার্থী সংসদের নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট হলের আবাসিক, অনাবাসিক এবং সংযুক্ত প্রতিটি নিয়মিত শিক্ষার্থী কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষের পদ ব্যতীত অন্য যে-কোনো পদে প্রার্থী হতে পারবেন এবং ভোট প্রদান করতে পারবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬,৪৬১ জন। এর মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থী রয়েছে ১ হাজার ৪৭০ জন এবং অনাবাসিক শিক্ষার্থী প্রায় ৫ হাজার। যা মোট শিক্ষার্থীর ৭৪ শতাংশ।
হল প্রভোস্ট সূত্রে জানা যায়, কাজী নজরুল ইসলাম হলের সিট সংখ্যা ১৮০ টি এবং শিক্ষার্থীও থাকছে ধারণক্ষমতা অনুযায়ী। বিজয় ২৪ হলের সিট সংখ্যা ৪৬০ এবং শিক্ষার্থী থাকছে ৫২০ জন। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের সিট সংখ্যা ১৪৬ টি এবং শিক্ষার্থী থাকছে ১৭০ জন। সুনীতি-শান্তি হলের সিট সংখ্যা ৩৮৪ টি এবং শিক্ষার্থীও থাকছে ৩৮৪ জন। নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হলের সিট সংখ্যা ৩০০ টি এবং শিক্ষার্থীও থাকেন ৩০০ জন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ প্রতিটি শিক্ষার্থীকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি নির্দিষ্ট হলে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে আবাসন সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের শতভাগ আবাসিকতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল দাপ্তরিকের সব কাজের (সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার ফি, হল ফি, অ্যাকাডেমিক ফরমে প্রভোস্টের স্বাক্ষর, কিংবা সার্টিফিকেট সংগ্রহ) জন্য বরাদ্দকৃত হলের অধীনেই করতে হয়।
অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীই কঠোর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগ্যতার স্বীকৃতি অর্জন করে। তাই আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করা নৈতিক, শিক্ষাগত, আইনগত ও গণতান্ত্রিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। তাদের মতে, বর্তমানে মাত্র ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পেলেও অনাবাসিক শিক্ষার্থীরাও নিয়মিত ফি প্রদান করে, যা দিয়ে হলের রক্ষণাবেক্ষণ হয়। তাই ফি প্রদানকারী অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা অন্যায় ও অযৌক্তিক।
আরও পড়ুন: জকসু নির্বাচনে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক
এ বিষয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফারুক আল নাহিয়ান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষার্থীই কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আসে। এখানে কারও ভর্তি কোনো অনুগ্রহে নয়, বরং যোগ্যতার স্বীকৃতিতেই। তাই আবাসিক বা অনাবাসিক— দু’ধরনের শিক্ষার্থীর মধ্যকার কোনো বৈষম্য তৈরি করা নৈতিকভাবে, শিক্ষাগতভাবে, আইনগতভাবে ও গণতান্ত্রিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।’
এদিকে ভিন্ন কথা বলছেন কিছু আবাসিক শিক্ষার্থীরা, হল সংসদ শুধু হল শিক্ষার্থীদের জন্য। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের হল সম্পর্কে ধারণা নেই। তারা কীভাবে প্রার্থী নির্বাচন করবে? যারা হলে নিয়মিত থাকে না, তাদের হল সংসদে ভোট করা কিংবা দেওয়ার অধিকার নেই।
এ বিষয়ে বিজয় ২৪ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফরহাদ কাউসার বলেন, 'হলে যারা আবাসিক শিক্ষার্থী আছেন তারাই হলের নেতা নির্বাচন করবে। কারণ যারা হলে থাকে তারা হলের ভালো-মন্দ বুঝবে। তবে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য কেন্দ্রীয় সংসদে প্রশাসন একটি অনাবাসিক পদ সৃষ্টি করতে পারে।'
এ বিষয়ে আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) মো. আলী মুর্শেদ কাজেম বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীদের আবাসিকতার দেওয়ার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, আমাদের শিক্ষার্থীরা হলে ফি দিচ্ছে নিয়মিত, আমরা আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী কিছু শিক্ষার্থীদের হলে থাকতে দিয়েছি। পরবর্তীতে তারা উঠবে না এমন না। যে আজকে সিট পায়নি সে তো আগামীকাল সিট পেতে পারে। আমার বক্তব্য ক্লিয়ার, আমাদের শিক্ষার্থীরা আবাসিক হোক অনাবাসিক হোক সবাই ভোট দিতে পারবে। প্রার্থিতা নিয়ে বিবেচনা করা যায়।
অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার অস্বীকার করলে তাদের হল সংযুক্তির আর কোনো বৈধতা থাকে কিনা এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন‚ ‘এটা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। যার হলো সে কি মতামত দিতে পারবে না? তাদের আবাসিকতা দিতে পারছি না, এটা আমাদের সক্ষমতার বিষয়। কিন্তু তারা ভোট দিতে পারবে না এটা তো অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক ব্যাপার।’
আরও পড়ুন: ডাকসু নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়
খসড়া কমিটির আহ্বায়ক ড. সোহরাব উদ্দিন বলেন, ‘এই গঠনতন্ত্র আজকের জন্য নয়, এটি সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যেমন সব শিক্ষার্থী প্রার্থী হতে পারে এবং ভোট দিতে পারে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র এক হাজার শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক সিট বরাদ্দ রয়েছে। বাকি শিক্ষার্থীদের সিট দিতে না পারার মূল কারণ হলো সিট সংকট। যদি এমন হতো যে যাদের সিট দেওয়া হয়েছে, তারা নিয়মিত হলে থাকছে না, তাহলে সেটি আমরা অবশ্যই বিবেচনায় নিতাম।’
৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংসদে ভোট দিয়েছিল অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা
ইতোমধ্যে দেশের চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ডাকসু), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চাকসু), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাকসু) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাকসু)—ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল সংসদ নির্বাচনে আবাসিক শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অনাবাসিক শিক্ষার্থীরাও ভোট দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্রেও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট প্রদানে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। এ ছাড়াও সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্রাকসু) গঠনতন্ত্র পাশ হয়েছে। সেখানেও অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা প্রার্থিতা ও ভোটার হতে পারবেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. পাভেল আহমদ বলেন, 'ভোট একজন নাগরিকের বা শিক্ষার্থীর মৌলিক মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি মানুষ এই অধিকার ভোগ করার ক্ষমতা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে আবাসিক অনাবাসিক দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার থাকা উচিত। অনাবাসিকরা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তাই তাদের ও অধিকার আছে প্রতিনিধি বাছাই করার। আবাসিক শিক্ষার্থীদের অনাবাসিকদের বঞ্চিত করার মানসিকতা মোটেই গণতান্ত্রিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ নয়। সুষ্ঠু ছাত্ররাজনীতিতে সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি আবশ্যক।'
আরও পড়ুন: হল সংসদ নেতার উদ্যোগে ঢাবিতে প্রথমবারের মত স্টারলিংক চালু
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাদিম বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মানেই যোগ্যতার স্বীকৃতি পাওয়া। এখানে সবাই প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই আসে, তাই আবাসিক বা অনাবাসিক পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে ছোট করে দেখা বা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সম্পূর্ণ অন্যায় ও অযৌক্তিক। তিনি বলেন, দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই শতভাগ আবাসিক নয়, সুতরাং বাইরে থেকে যাতায়াত করা শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের ভোটাধিকার বা প্রতিনিধিত্বের সুযোগ কেড়ে নেওয়া মানে গণতন্ত্র ও ন্যায়ের মূলনীতি লঙ্ঘন করা।'
নাদিম আরও বলেন, 'প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার কারণে সবাইকে আবাসন সুবিধা দিতে না পারাটা শিক্ষার্থীদের দায় নয়, বরং প্রশাসনের ব্যর্থতা। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত হবে সবার জন্য সমান অধিকার ও অংশগ্রহণের পরিবেশ নিশ্চিত করা, যাতে কেউ নিজেকে প্রান্তিক মনে না করে।'
রাকসু কার্যনির্বাহী সদস্য প্রার্থী আব্দুল্লাহ মুনাওয়ার সিফাত ভুইঞা বলেন, 'একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়ে নিয়মিত অনার্স-মাস্টার্স করছে মানে সে ক্যাম্পাসের নিয়মিত শিক্ষার্থী এবং একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদের ভোটারও হয়। এটা স্পষ্টত শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। একজন অনাবাসিক শিক্ষার্থীও সেমিস্টার ফি, সেশন ফী দেওয়ার সময় যথাযথ হল ফি পরিশোধ করেই পরীক্ষায় বসেন। হল সংসদে কারা নির্বাচিত হবে, হলের কার্যক্রমে অবশ্যই তার হস্তক্ষেপের অধিকার আছে।'
চাকসু হল সংসদ প্রতিনিধি মো. তাজিম চৌধুরী বলেন, 'চাকসুতে আবাসিকদের পাশাপাশি অনাবাসিক শিক্ষার্থীরাও হল সংসদে ভোট দিয়েছে। এটি তাদের অধিকার। অধিকার রাখে। কারণ অনাবাসিক শিক্ষার্থীরাও বিভিন্নভাবে হলের কার্যক্রমের সাথে যুক্ত, তাঁরাও নানা কাজে হলে আসে এবং হলের বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করে। ফলে তারা হলের পরিবেশ ও যাবতীয় অনেক কিছু সম্পর্কে ধারণা রাখে। তাছাড়া হল সংসদ শুধু আবাসনের বিষয় নয়, এটি শিক্ষার্থীদের সংগঠিত অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব বিকাশ ও অধিকার রক্ষার একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষার্থী কোনো না কোনো হলে অ্যাকাডেমিকভাবে সংযুক্ত থাকে, তাই তাদের ভোটাধিকার অস্বীকার করা অন্যায় ও বৈষম্যমূলক।