চবির নতুন ভিসি, প্রো-ভিসি নিয়োগে আলোচনায় একাধিক শিক্ষকের নাম
- সুমন বাইজিদ, চবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৪, ০৬:৪০ PM , আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১০:৫৬ PM
চলতি মাসের শুরুতে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একের পর এক পদত্যাগে ভেঙে পড়েছে দেশের প্রশাসনিক কাঠামো। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কার্যত অচল হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও (চবি)। উপাচার্য (ভিসি) থেকে শুরু করে উপ-উপাচার্যসহ প্রক্টরিয়াল বডি এবং হল প্রভোস্টরাও পদত্যাগ করেছেন।
তবে এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগের কাজ শুরু করেছেন অন্তর্বর্তী সরকার। ঢাকা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইতোমধ্যে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রো-ভিসিসহ প্রশাসনের শীর্ষ পদে কারা নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন তা নিয়ে নানা মহলে চলছে আলোচনা।
আরও পড়ুন: ঢাবির দুই প্রো-ভিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন কেন আটকা?
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তাদের যৌক্তিক আন্দোলনে যারা সমর্থন জানাননি বরং স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন তাদের কোনো অধিকার নেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব পালন করার। আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল এবং একাডেমিকভাবে যোগ্য এমন ব্যক্তিদের শীর্ষ পদে দেখতে চান শিক্ষার্থীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদ ভিসি ও প্রো-ভিসি হওয়ার দৌড়ে বিভিন্ন মহলে সম্ভাব্য কিছু নামও ইতোমধ্যে শোনা যাচ্ছে। এতে আলোচনায় রয়েছেন লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আমির মুহাম্মদ নসরুল্লাহর নাম।
এছাড়া আলোচনায় জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খানের নাম।
এছাড়া আলোচনায় জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের মধ্যে আরও রয়েছেন প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাখাওয়াত হুসাইন প্রমুখ।
এদিকে, বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এস. এম নসরুল কদির, ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-আমীন।
এছাড়া জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল্-ফোরকান। এছাড়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করায় এবং একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতা থাকায় বিভিন্নভাবে আলোচনায় এসেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিনের নামও।
দেশের এই পরিস্থিতিতে কেমন ভিসি প্রয়োজন এ বিষয়ে জানতে চাইলে লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. খসরুল আলম কুদ্দুসী বলেন, আমাদের প্রত্যাশা হলো একাডেমিকভাবে যোগ্য এবং প্রশাসনিকভাবে দক্ষ একজন সৎ ব্যক্তি এই স্থানে আসুক যিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করবেন এবং সবাইকে নিয়ে ন্যায়নীতির ভিত্তিতে কাজ করবেন। ছাত্র সংসদ কার্যকর হলেই শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব কার্যকর হবে বলে মনে করি। সামনে এমন উপাচার্য আসবেন যিনি শিক্ষার্থীবান্ধব হবেন যিনি দল মত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে কাজ করার মানসিকতা রাখবেন।
দলীয় মনোভাব আছে এমন অনেক শিক্ষক ভিসি পদে আসার সম্ভাবনার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে এক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা তা জানতে চাইলে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল হক বলেন, ছাত্ররা চায় এমন মানুষ যে সামগ্রিকভাবে স্বৈরাচারের দোসর হবে না। সে অর্থে যদি নিরপেক্ষতা চায় তাহলে তো সেটা সম্ভব না। কারণ আমাদের সমাজটা দীর্ঘ ৫০ বছরে গড়ে উঠেছে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি এভাবে। নিরপেক্ষ পাওয়া অসম্ভব। আমাদের অন্ততপক্ষে এতটুকু নিশ্চিত হতে হবে যারা স্বৈরাচার না, খুনি না। তখন তো বিএনপি-জামায়াত বা অন্যান্য সংগঠন থেকে আসবে এটা অস্বীকার করার উপায় নাই।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চবির উপাচার্য কেমন হওয়া উচিৎ জানতে চাইলে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ. জি. এম নিয়াজ উদ্দিন বলেন, একাডেমিক দক্ষতার পাশাপাশি প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে সংস্কারের বিষয়ে সেটাকে যারা নৈতিকভাবে গ্রহণ করতে পারবেন তাদেরই এ জায়গায় আসা উচিৎ বলে মনে করছি। তিনি অবশ্যই মেধা, যোগ্যতা এবং দক্ষতা সম্পন্ন হবেন। ছাত্র আন্দোলনে যারা বিরোধিতা করেছিলেন তাদের কাউকেই এখন ছাত্ররা মেনে নিবে মনে হয় না। সুতরাং আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের নৈতিকভাবে সমর্থন করেছিলেন তাদের সুযোগ পাওয়া উচিৎ।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা কেমন উপাচার্য চান জানতে চাইলে চবির সমন্বয়ক আব্দুল আওয়াল আলাওল বলেন, তিনি যেন শিক্ষার্থীবান্ধব হন অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তাঁর চিন্তা, কাজ, দক্ষতার জায়গাটা ব্যবহার করবেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে যেন দলীয়ভাবে অন্ধ ব্যক্তি না আসে। ন্যায় নীতির ভিত্তিতে প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় চালাবে কিন্তু কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী হবেন না।
কিভাবে নিয়োগ পান উপাচার্য?
উপাচার্য নিয়োগের পদ্ধতি মূলত দুটি। প্রথমটি ৭৩ এর অধ্যাদেশ, আর দ্বিতীয়টি আচার্য কর্তৃক সরাসরি প্রজ্ঞাপন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দুজন উপাচার্য সিনেটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৮৫ সালে উপাচার্য হন অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী এবং ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। এরই মধ্যে ৩৬ বছর পার হলেও সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত উপাচার্য পায়নি আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ এ উচ্চশিক্ষলয়।
৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুসারে সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হলে একটা শক্ত ভিত্তি থাকে। এতে আত্মমর্যাদা জন্মায়। আর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কারও অনুকম্পায় উপাচার্য নিয়োগ হলে তা সংগত কারণেই থাকে না। গত ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারও দ্বিতীয় পথটাই বেশি পছন্দ করেছেন। প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হলে দলের লাভ হয় ঠিকই কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ৭৩-এর অধ্যাদেশের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ সম্ভব কিনা জানতে চাইলে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খ. আলী আর রাজী বলেন, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সিনেটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। এখনো সিনেট কার্যকর আছে তবে সিনেট যে সময়ে বা যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আবার সিনেটে যে ছাত্র প্রতিনিধি (চাকসু) থাকার বিষয়টি সেটা এখন নাই। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় তো আর ফাঁকা পড়ে থাকবে না কাউকে না কাউকে তো নিয়োগ দিবেই সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় ধাপটি অনুসরণ করে আচার্য ভিসি নিয়োগ দিবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলা উদ্দিন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয়ের ফসল হিসেবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন একাডেমিক্যালি ও নৈতিকভাবে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য জ্ঞান ও গবেষণা নির্ভর শিক্ষককে ভিসি হিসেবে দেখতে চাই, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষাবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন।
“যিনি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিমুক্ত ও নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করবেন- যাতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং সম্মানজনক জায়গায় যায়, এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এই ক্যাম্পাসকে সকলপ্রকার বৈষম্যমুক্ত (শাটল ট্রেন পরিবহণ, হলে সিট বণ্টন, খাওয়ার মান) পরিবেশ সৃষ্টি হয়। একইসাথে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার শিক্ষাবান্ধব সুসম্পর্ক সুনিশ্চিত করতে সচেষ্ট হবেন। অর্থাৎ যার কর্মতৎপরতায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল বার্তা তথা সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ক্যাম্পাসে ক্লাস, পরীক্ষাসহ সকল সেবার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। এ জন্য ছাত্র সংসদসহ সকল সংসদ/সিনেটের ইত্যাদির আশু নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। সাথে সাথে সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ম দূর করতে হবে।”