অদম্য জরিনা: সংগ্রাম থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার এক অনন্য গল্প

জরিনা বেগম
জরিনা বেগম  © টিডিসি ফটো

অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরে আসার গল্প শুধু গল্পের বইয়েই নয়, বাস্তব জীবনেও লেখা হয়। কেউ কেউ লড়াই করে নিজের ভাগ্য বদলে দেন, পরিণত হন অনুপ্রেরণার প্রতীকে। তেমনই একজন জরিনা বেগম—বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের রহিমাবাদ গ্রামের সংগ্রামী এই নারী চরম দারিদ্র্য, নির্যাতন ও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। একসময় অন্যের জমিতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন, আর আজ তিনি নিজেই একজন উদ্যোক্তা। কিন্তু এই সাফল্যের পথ সহজ ছিল না।

জরিনার জন্ম এক অভাবী কৃষক পরিবারে। ১২ ভাইবোনের সংসারে বাবার সামান্য আয়ে টিকে থাকাই ছিল কঠিন। যখন অন্য শিশুরা স্কুলে যেত, সাত বছরের জরিনা তখন বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করত। ধান কুড়ানো, মাছ ধরা—কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই তার শৈশব কেটেছে।  

১৯৮৫ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হলেও নতুন জীবনে শান্তি মেলেনি। স্বামীর মাদকাসক্তি ও নির্যাতনের শিকার হন তিনি। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সব সহ্য করেও শেষ রক্ষা হয়নি। একসময় নির্যাতন সইতে না পেরে তিন সন্তানকে নিয়ে পাড়ি জমান ঢাকায়, শুরু করেন গার্মেন্টসে কাজ। প্রতিদিন সন্তানদের রেখে কাজে যেতেন, তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য প্রাণপণে লড়াই করতেন।

0235

কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সামান্য স্বস্তি পেলেও দুঃখ তাকে ছাড়েনি। স্বামী একসময় অনুতপ্ত হয়ে ফিরে এলেও বেশিদিন টিকলেন না। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন জরিনা। জানা যায়, স্বামী ক্যান্সারে আক্রান্ত। যা কিছু সঞ্চয় করেছিলেন, সবটাই চিকিৎসায় ব্যয় হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। স্বামীর মৃত্যুর পর শূন্য হাতে সন্তানদের নিয়ে গ্রামে ফেরেন তিনি। জীবন বাঁচাতে আবারও দিনমজুরির কাজে নামতে হয়। মাটি কাটা, মাছ ধরা, রাজমিস্ত্রির সহকারী—যা কাজ পান, তা-ই করেন।  

অবশেষে ২০২৩ সালে ব্র্যাকের ইউপিজি কর্মসূচির মাধ্যমে একটি ষাঁড় গরু পান। এখান থেকেই তার জীবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। গরুটিকে যত্ন নিয়ে লালন-পালন করতে থাকেন। পরে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এ তার ঘর ভেঙে গেলে ব্র্যাক তাৎক্ষণিক সহায়তা দেয়, টিন ও বাঁশের ব্যবস্থা করে দেয়। তিনি নিজেই ঘর মেরামত করেন। পাশাপাশি হাঁস-মুরগির খামার, ছাগল পালন, জৈব সার বিক্রি এবং সবজি চাষ শুরু করেন। আজ জরিনা বেগমের গরুর খামার, হাঁস-মুরগির ব্যবসা ভালো আয় দিচ্ছে। কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। এখন আর তাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয় না। নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বী হয়েছেন। তিনি চান, তার মেয়েও আর ঢাকায় চাকরি না করে গ্রামে এসে ব্যবসায় সহায়তা করুক।

6986

স্থানীয় ময়না আক্তার বলেন, জরিনা আপার পরিশ্রম দেখে মনে হয়, একজন পুরুষের পরিশ্রমও হার মানবে। গাছে ওঠা থেকে শুরু করে ধান রোয়া—সবই পারেন তিনি। কিন্তু তার খোঁজ নেওয়ার মতো কেউ নেই। সরকার যদি একটু সহযোগিতা করত, তাহলে তিনি ভালোভাবে বাকি জীবন কাটাতে পারতেন।

জরিনার মেয়ে সুলতানা আক্তার বলেন, ছোটবেলায় দেখেছি, বাবা মাকে অনেক নির্যাতন করতেন, তবুও মা আমাদের নিয়ে সংসার চালিয়ে গেছেন। মা যে পরিশ্রম করেন, আশপাশের দশ গ্রামের মানুষও এত পরিশ্রম করবে না।

জরিনা বেগম বলেন, সংসারের অভাব, স্বামীর নির্যাতন, সন্তানের মুখ—সব মিলিয়ে কতবার ভেবেছি সব ছেড়ে দেব। কিন্তু পারিনি, লড়াই চালিয়ে গেছি। আজ আমি কারও দয়ায় বাঁচি না। শুধু চাই, আমার সন্তানরা আর কষ্ট না পাক।

748

তিনি বলেন, ৪০ বছর আগে ছোটন আমাকে জোর করে বিয়ে করেন। প্রথমে সংসার ভালোই চলছিল, পরে নির্যাতন শুরু হয়। তিন সন্তান হলেও নির্যাতন কমেনি। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করেছি, ফুটপাতে মাছ, ডিম, কাঁচা সবজি বিক্রি করেছি। দুই বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর বাড়িতে ফিরে আসি, কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। কোনোভাবে ছোট একটা ঘরে থাকছি। দুই মেয়ের মধ্যে একজন শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে, আরেকজনকে এখনো দেখাশোনা করতে হয়। ছেলে বিয়ে করে নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত।

জরিনা বেগমের জীবনসংগ্রাম প্রমাণ করে, যদি মনোবল দৃঢ় থাকে, তাহলে দারিদ্র্য, নির্যাতন বা কোনো বাধাই একজন নারীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে রাখতে পারে না।  

প্রান্তিক নারীদের ঘুরে দাঁড়াতে বাগেরহাটে কাজ করছে ইনিশিয়েটিভ ফর রাইট ভিউ, বাঁধন মানব উন্নয়ন সংস্থা, ওয়ার্ল্ড ভিশন, রূপান্তর, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। এসব সংস্থার সহায়তা পেলে আরও অনেক জরিনার জীবন বদলে যেতে পারে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence