আ’লীগ সরকারের নিয়োগকৃত ভিসিদের দেখুন, যোগ্য কেউ ছিল?

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন   © ফাইল ছবি

ধরে নেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগ হলো বাংলাদেশের প্রোগ্রেসিভ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তির একমাত্র আশ্রয়স্থল। এ বিশ্বাসকে পুঁজি করে গত ১৫টি বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার উৎসবের মতো করে গুম, খুন, দুর্নীতি, পাচার আর লুন্ঠন করে গেছে। তারা কৌশলে একটা ন্যারেটিভ তৈরি করেছে যে, আওয়ামীলীগ হারলে জামাত-বিএনপি ক্ষমতায় আসলে কোথায় যাবেন? এ ন্যারেটিভের কারণে আওয়ামী লীগ কোনো ভালো কাজ করার কোন চাপ অনুভব করেনি, বরং যা ইচ্ছে তা করার একটা লাইসেন্স পেয়ে গিয়েছিল। 

তারা বোঝাতে সক্ষম হয় যে, সরকারে আওয়ামী লীগ না থাকলে প্রোগ্রেসিভ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তি মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়বে। এ জুজুর ভয় দেখিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। কে ক্ষমতায় আসবে আর কে আসবে না, এইটা কি নির্বাচন কমিশনের দেখার বিষয়। তারা হলো, খেলার রেফারীর মতো। রেফারি পক্ষপাতদুষ্ট হলে সেটা কি আর খেলা থাকে? নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পুলিশ, আমলাকে তুষ্ট করতে হয়েছে। এ দুটো গোষ্ঠী একেকজন দশ হাতে দুর্নীতি করেছে। আর সেই অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার। 

দেশে যে টাকা ছিল, সেটা দিয়ে বিলাসিতা করেছে। বিকল্প নাই ন্যারেটিভ দিয়ে মিথ্যার চাষাবাদ করে দেশে মিথ্যার একটা আবরণ তৈরি করা হয়েছে। চারিদিকে দেখুন, কেবল দুর্নীতিবাজ আর দুর্নীতিবাজ।  পুলিশের সর্বোচ্চ পদ হলো আইজিপি। সেই পদে ছিলেন বেনজির আহমেদ। একদিকে দুর্নীতি করেছেন আর অন্যদিকে সততার কথা ফেরি করেছেন। আবার সকল বিরোধী মতকে দমন করতে বলেছেন টোকায়ে টোকায়ে ধরে আনবেন। মাটির তলা থেকে টোকায়ে আনবেন। শাসিয়েছেন এই বলে যে, সরকারের ক্ষমতা কতটা মানুষ জানেনা। 

এরা সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যত রকমের সাপোর্ট দরকার দিয়েছে; আবার সরকার এদের সকল অন্যায় কাজকে দেখেও না দেখার ভান করে গিয়েছেন। শুধু তাই না, আওয়ামী লীগ সরকার মনে করেছিল সাধারণ মানুষের মতামতের কোন মূল্য নাই। দেশে কিছু মানুষকে পালতে হবে যাদের হাজার হাজার কোটি টাকা থাকবে। এরাই আসল ক্ষমতাবান মানুষ। তারা তার পাশে থাকলেই চলবে। এই শ্রেণিটা তৈরি করতে সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এগিয়েছে এবং এ প্রসেসে আজিজ খান, এস আলম, সালমান এফ রহমান প্রমুখ তৈরি হয়েছে। 

আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভা দেখুন। ছিল কোনো আলোকিত মানুষ? আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগকৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিদের দেখুন। ছিল কোন সত্যিকারের যোগ্য ভিসি। আওয়ামী লীগ আমলে ইউজিসিতে নিয়োগকৃত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের দেখুন। ছিল কোন যোগ্য মানুষ। আওয়ামীলীগ আমলে নিয়োগকৃত গভর্নরের দেখুন। ছিল কোন যোগ্য গভর্নর? শেষের জন আব্দুর রউফ বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে সি গ্রেড পাওয়া গভর্নর। আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের দেখুন। ছিল কোন যোগ্য ব্যক্তি? এইভাবে রাষ্ট্রের পরতে পরতে এমন মানুষদের বসানো হয়েছে যারা কেবল জি হুজুর আর যাচ্ছি হুজুর করবে। কেউ দ্বিমত করবে না। এমন মানুষ দিয়ে কি দেশ উন্নত করা সম্ভব?

আর অন্যদিকে সরকারের বয়ান মানুষকে খাওয়ানোর জন্য মিডিয়াকে ব্যবহার করেছে। কিছু অসৎ ধূর্ত সাংবাদিককে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের মালিকানাসহ নানা কিছু সুবিধা দিয়েছে। কিছু পেইড সাংবাদিক নিয়োগ দিয়েছে। তাদের মাধ্যমে পুরো গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে উন্নয়নের নেরেটিভ মানুষকে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পত্রিকা ও টেলিভিশন দেখলে মানুষ শুধু উন্নয়নের বয়ানই শুনে। আর ব্যক্তি জীবনে দেখে জিনিসপত্রের মূল্য হু হু করে বাড়ে, রাস্তাঘাট ময়লা, ট্রাফিক সিগন্যাল এখনো স্বয়ংক্রিয় না, চাঁদাবাজি দেদারছে চলছে। 

আরো পড়ুন: ড. ইউনূস শেষ আশা, তিনি ব্যর্থ হলে দেশ সমৃদ্ধ সভ্য হবে না

তারা দেখে তাদের টাকা দিন দিন কাগজে পরিণত হচ্ছে। তারা চোখের সামনে দেখে সরকার দলীয় লোকজন রাতারাতি ফুলে ফেঁপে ধনী হয়ে যাচ্ছে। তারা দেখে সাধারণ মানুষ সরকার দলীয় লোকদের দ্বারা সর্বত্র নিপীড়িত হচ্ছে। তারা দেখে তাদের ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না। তারা দেখে ছেলেমেয়েরা মাদকে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে কিশোর গ্যাং এর দৌরাত্ম। তারা দেখে লেখাপড়ার মান নামছেতো নামছেই। তারা দেখে শিক্ষায় বরাদ্দ কমছেতো কমছেই। তারা দেখে শিক্ষকরা নির্যাতিত হচ্ছে। কারিকুলাম দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছেতো হচ্ছেই। সুতরাং মিডিয়ার বয়ানের সাথে বাস্তবের বিরাট তফাৎ মানুষকে হতাশ করেছে। হতাশ থেকে ক্ষোভ আর ক্ষোভ থেকে মহা বিক্ষোভের বিস্ফোরণ।

এসব কথা আজকে নতুন লিখছি না। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যখন ছিল, তখনও লিখেছি। যা সত্য বলে মনে হয়েছে, তা লিখেছি। তবে তখন লেখার সময় একটু সতর্ক থাকতে হয়েছে। আমাকে আমার আপনজনরা সবসময় সতর্ক করেছে, খবরদার প্রধানমন্ত্রীর ছেলেকে নিয়ে একটা শব্দও লিখবা না। আমি নিজেও বুঝেছি আসলেই তাই। বাংলাদেশে থেকে কোন বাংলাদেশির ক্ষমতা ছিল না শেখ হাসিনার পুত্রের নাম নিয়ে সমালোচনা করার। আজ তার ফল ভোগ করছে। মানুষকে তার ক্ষোভ ডিসচার্জ করতে দিতে হয়। না হয় ছোট ছোট ক্ষোভ একদিন একত্রিত হয়ে মহা বিস্ফোরণ ঘটায়। এইরকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি এবং লালনে যারা বাতাস দিয়ে গিয়েছে তারাই ছিল আসল খারাপ মানুষ।

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)


সর্বশেষ সংবাদ