মিলছে না এমপিও, পেশা বদলাচ্ছেন প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষকরা

দাবি আদায়ে প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষকদের কর্মসূচি
দাবি আদায়ে প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষকদের কর্মসূচি  © ফাইল ফটো

বগুড়া মূক-বধির বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করছেন আব্দুর রহিম। তবে যোগদানের পর এখন পর্যন্ত এক টাকাও বেতন পাননি তিনি। এই অবস্থায় শিক্ষকতা ছেড়ে সম্প্রতি বাড়ির পাশে মুদি দোকন দিয়েছেন। পরিবার নিয়ে কোনো মতে খেয়ে বেঁচে আছেন তিনি।

শিক্ষকতা পেশা ছাড়া প্রসঙ্গে আব্দুর রহিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, অনেক স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত হয়েছিলাম। তবে দীর্ঘদিন ধরে বেতন না পাওয়ায় পরিবার নিয়ে অনাহারে জীবন যাপন করতে হচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়ে পেশা বদল করেছি। সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য নানা উদ্যোগ নিলেও শিক্ষকদের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

শুধু আব্দুর রহিমই নন; তার মতো বিশেষায়িত স্কুলের এমন প্রায় অর্ধ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী বেতন ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি সমাধানে সরকার আইন করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। দ্রুত প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোকে স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্ত করা না গেলে বড় ধরনের সংকট তৈরির আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সরকার প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোকে স্বীকৃতি দেয়ার উদ্যোগ নেয়ার পর রাতারাতি অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। এগুলো বাদ দিতে আমরা একটি সার্ভে করছি। এই সার্ভে শেষ হলে প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। একই সাথে তাদের এমপিওভুক্তির কার্যক্রমও শুরু হবে।

ইতোমধ্যে কিছু স্কুলকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, যে স্কুলগুলো অনেক পুরোনো এবং দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সাথে পাঠদান দিয়ে যাচ্ছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। ধীরে ধীরে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও স্বীকৃতি দেয়া হবে। তবে এই প্রক্রিয়া কিছুটা সময় সাপেক্ষ বলেও জানান তিনি।

আরও পড়ুন: ‘মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার সিলেবাস অপরিবর্তিত থাকবে’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা ও অন্যান্য অধিকার বিষয়ে নীতিমালা করে সরকার। এই নীতিমালার আলোকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত স্কুল প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। ২০১৩ সালে সরকার প্রতিবন্ধী সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন করে। এই আইনটি ২০১৯ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। গেজেট প্রকাশের পর ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রতিবন্ধীদের জন্য গড়ে ওঠা স্কুলগুলোকে স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির লক্ষ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সরকার। এরপর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে স্কুলের তালিকা চেয়ে চিঠি দেয়। এই চিঠির প্রেক্ষিতে পাওয়া তালিকা যাচাই করে মন্ত্রণালয় এক হাজার ৭৭২টি প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত করে। তালিকা করার দুই বছর অতিক্রম হলেও এখনো স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হয়নি।

প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্মিত স্কুলগুলোর স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির দাবিতে বেশ কয়েকবছর ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সর্বশেষ গত বছরের অক্টোবর মাসে ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তারা। পরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেননের আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করেন আন্দোলনরতরা।

শিক্ষক সমিতির নেতারা জানান, সরকার প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় নিয়ে যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, সে অনুযায়ী বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করা হয়েছে। তবে দুই বছরের বেশি হয়ে গেলেও এখনো সেই নীতিমালার বাস্তবায়ন হয়নি। এই অবস্থায় শিক্ষকরা বিশেষায়িত স্কুল ছেড়ে ভিন্ন পেশায় যোগ দিচ্ছেন। এতে শিক্ষক সংকট তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। একই সাথে কোমলমতি শিশুরা তাদের কাঙ্খিত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই অবস্থায় সরকারের নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি তাদের।

আরও পড়ুন: শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত: আন্তর্জাতিক মান নেই ৪৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে

বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী শিক্ষক সমিতির নেতা মো. মোস্তাফিজুর রহমান জুয়েল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, বেসরকারি উদ্যোগকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা করার লক্ষ্যে সরকার ‘প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০০৯’ প্রণয়ন করে। ২০১৯ সালে প্রতিবন্ধীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে আরও দুটি নীতিমালা করা হয়। তবে সবকিছু নীতিমালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এক অদৃশ কারণে এই নীতিমালার কোনো বাস্তবায়ন এখনও হয়নি।

তিনি আরও বলেন, যে এক হাজার ৭৭২টি স্কুল বাছাই করা হয়েছে। এখানে প্রায় পাঁচ লাখ ছেলে-মেয়ে পড়ালেখা করে। স্বীকৃতি না দেয়ায় এই পাঁচ লাখ শিশুর শিক্ষা জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এছাড়া স্কুলগুলোর প্রতি অমনোযোগের ফলে বিশেষায়িত শিশুদের শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার যেমন বাড়ছে না, লেখাপড়ায় থাকা প্রতিবন্ধী শিশুরা সফলতার সঙ্গে শিক্ষাচক্র শেষ করতে পারছে না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষায়িত স্কুলকে দ্রুত স্বীকৃতি দিয়ে এমপিওভুক্তির আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমরা প্রাথমিকভাবে এক হাজার ৭৭২টি স্কুল বাছাই করেছিলাম। তবে এই স্কুলগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই ভুয়া তথ্য দিয়েছিল। তাই সেগুলো আবার যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। খুব সম্ভবত ৪৫০টি স্কুলকে স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তি করা হবে। সেভাবেই তালিক তৈরির কাজ চলছে।

আরও পড়ুন: ঝড়ে উপড়ে গেছে বিজ্ঞানী নিউটনের সেই আপেল গাছ!

তালিকা তৈরিতে সময় বেশি লাগার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার যখন উদ্যোগ নিয়েছিল তখন অনেক স্কুল রাতারাতি গজিয়েছে। অনেকগুলোর কাগজপত্র ঠিক ছিল না। স্কুলের জায়গা নিয়েও ঝামেলা আছে। এগুলো করতে সময় লেগেছে। এছাড়া করোনাকালীন সময়ে আমরা কোনো কাজই করতে পারিনি। তবে এখন সবকিছু ভালোর দিকে যাচ্ছে। আশা করছি দ্রুত স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির কাজ শেষ করা যাবে।

কবে নাগাদ বিশেষায়িত স্কুলগুলো স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্ত করার কাজ শেষ হবে এমন প্রশ্নের জবাবে রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, এটি নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে চলতি অর্থ বছরে এই কাজ শেষ হবে না বলেও জানান তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ