হাল ছেড়ো না, বেলা শেষে খেলা জমে

মুহম্মদ সজীব প্রধান
মুহম্মদ সজীব প্রধান  © সংগৃহীত

সম্প্রতি দেশের প্রথম সারির বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং মেডিকেল কলেজের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে চান্স প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের তালিকায় নিজের নাম খুঁজে পাওয়া একজন শিক্ষার্থীর জন্য বাঁধভাঙা আনন্দের হলেও অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের জন্য এটা ঘোর অমানিশার গল্প। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চান্স না পাওয়া একজন শিক্ষার্থীর জন্য কতটা ব্যর্থতার বিষয়? কঠিন এই উত্তরটি সহজ একটি উদাহরণের মাধ্যমে দেওয়া যাক।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাকে চেয়ার সিটিং খেলার সাথে তুলনা করতে পারি। চেয়ার সিটিং খেলায় যেমন সবাই চোখ কান খোলা রাখা সত্ত্বেও কাউকে না কাউকে খেলা থেকে বাদ পড়তে হয় ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় সবার পর্যাপ্ত মেধা ও পরিশ্রম থাকলেও অনেকেই ছিটকে যাবে এবং এটাই স্বাভাবিক। বিষয়টা কষ্টদায়ক হলেও হিসাবটা খুবই সহজ! বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আসন সংখ্যার প্রায় ৫০-৬০ গুণ বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ইতোমধ্যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেয়ে যারা হতাশার চোরাবালিতে আটকে গেছে তাদের সাথে আজকের লেখায় কিছু গল্প করা যাক।

তোমরা নিশ্চই ডিসকভারি টিভি চ্যানেলের সাথে পরিচিত। সেখানে বাঘের হরিণ শিকার করার দৃশ্য নিয়ে কি কখনো ভেবেছো? বাঘ হরিণ শিকার করার পূর্বে কয়েক পা পিছনে যায়। এর মানে এই নয় যে, বাঘ হরিণ কে ভয় পেয়ে পিছু হটেছে। এর মানে হচ্ছে, বাঘ তার শিকারকে সঠিকভাবে তাক করতে এবং গতিশক্তি বাড়াতেই কিছুটা পিছনে যাচ্ছে। বাঘের হরিণ শিকার পদ্ধতি থেকে আমাদের শিখনফল হচ্ছে, পিছিয়ে যাওয়া মানেই হেরে যাওয়া নয় বরং কিছু কিছু পিছিয়ে যাওয়া জিতে যাওয়ার উপায় বটে।

তোমরা মেডিকেল, বুয়েট, ঢাবি, রাবি, চবি এবং জাবিতে চান্স না পেয়ে ভাবছো তোমরা অন্যদের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে আছো। বিষয়টা এমনও হতে পারে যে, তোমাদের এই সাময়িক পিছিয়ে যাওয়া শীঘ্রই এগিয়ে যাওয়ার গল্পে রূপান্তর হবে। মনে রেখো, ভাগ্যের চাকা যেকোনো সময় ঘুরে যেতে পারে। তোমাদের হাতে এখনো গুচ্ছের অন্তর্ভুক্ত ২৪ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। অর্থাৎ চান্স পাওয়ার সবচেয়ে বড় জায়গাটা এখনো তোমাদের অপেক্ষায়। মনে রেখো, বেলা শেষে খেলা জমে।  সুতরাং, হতাশাকে শত আশায় রূপান্তর করে শেষ লড়াইটা করে যাও।

এখন আসি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় কীভাবে ঈর্ষণীয় সাফল্য ছিনিয়ে আনবে সে বিষয়ে। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা মিডেল ক্লাস শিক্ষার্থীদের জন্য নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ। এখানে সঠিক উপায়ে পড়াশোনা করতে পারলে বাজিমাত করা কোনো ব্যাপার ই না। চলো তোমাদের সাথে শেষ মুহূর্তের সেরা প্রস্তুতির কয়েকটি বিষয় আলোচনা করি।

১. প্রথমেই মাথায় ইন্সটল করতে হবে অন্যান্য ভার্সিটিতে চান্স না পাওয়া তোমার জন্য শুধুই একটি অভিজ্ঞতা, এটা কোনো ব্যর্থতা নয়। আমাদের অতীতের ব্যর্থতা কখনোই বর্তমানের প্রচেষ্টা এবং ভবিষ্যতের সাফল্যকে বিঘ্ন করে না। তাই গুচ্ছের জন্য নতুন উদ্যমে সজীবতা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করতে হবে। 

২. সাইকোলজির একটা চমৎকার বিষয় হচ্ছে আমরা নিজেদের নিয়ে যা বিশ্বাস করি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের সাথে সেটাই ঘটে।এটা ম্যাজিক নয়, লজিক। তাই প্রস্তুতি নেওয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে অর্থাৎ সবসময় বিশ্বাস করতে হবে পরীক্ষা যতই কঠিন হোক এবং পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন আমি ভালো করব। সেজন্য প্রস্তুতির শুরুতেই সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং সময় ব্যবস্থাপনা করা জরুরি। কোন বিষয় কীভাবে এবং কতক্ষণ পড়ব সেটা ভেবে নিতে হবে। এতে প্রস্তুতির মাঝামাঝি অনিশ্চিত গন্তব্য মনে হবেনা।

৩. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা ইউটিউব থেকে দূরে থাকতে হবে কেননা এসব মাধ্যমে ৫ মিনিটের জন্য ঢুকলে অনেক ক্ষেত্রে ৫ ঘণ্টায়ও বের হওয়া যায় না অর্থাৎ প্রচুর সময় নষ্ট হয় যা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে বাঁধা সৃষ্টি করে।তাই ফেসবুক বাদ দিয়ে টেক্সট বুক ওপেন করো। এক্ষেত্রে চাইলে একটা জেদ নিতে পারো যে, চান্স না পাওয়া পর্যন্ত ফেসবুকে যাবে না। চান্স পাওয়ার পর পোস্ট করবা “আলহামদুলিল্লাহ, চান্স আমি পেয়ে গেছি”। তখন দেখবা জগতটা কতই না বর্ণিল!

৪. অন্যদের সাথে কখনোই নিজেকে তুলনা করবে না বরং নিজের সাথে নিজেকে তুলনা করবে। এক্ষেত্রে গতকাল যা শিখেছ আজকে তার থেকে বেশি শিখেছ কিনা সেটা তুলনা করাই বাঞ্ছনীয়।মনে রাখবা বিশাল এই পৃথিবীকেও যদি সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের সাথে তুলনা করি তাহলে পৃথিবীও ছোট মনে হবে। So, Competition with yourself and Comparison with yourself.

৫. অনেক বেশি বই না কিনে মানসম্মত অল্প কিছু বই কিনে সেগুলো খুটে খুটে পড়তে হবে। মনে রাখতে হবে, বই যত বেশি কিনবে পড়া তত কম হবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, কোচিং বা প্রাইভেটের চেয়ে সেল্ফ স্টাডিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যত বেশি সম্ভব টেবিলে সময় দিতে হবে এবং মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে।

৬. পরীক্ষার কমপক্ষে ১০ দিন আগে পড়া গুছিয়ে নিতে হবে এবং রিভিশন দিতে হবে। অনেক বেশি পড়ে কোন লাভ নেই যদি পরীক্ষার পূর্বে রিভিশন করা সম্ভব না হয়। সর্বশেষ যা করতেই হবে তা হলো, ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলতে হবে। এতে মন ও মেধা সতেজ থাকবে। মনে রাখতে হবে পরিশ্রম ও প্রার্থনার সুষম সমন্বয় হলেই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।

পরিশেষে, তোমাদেরকে একটি গল্প শোনাই। একজন সাধারণ মানুষ ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজন আসামিকে জিজ্ঞেস করছিলেন, এই অন্ধকার কারাগারে দিনের পর দিন হেসে খেলে কীভাবে পার করছেন? কারাগারের এই মানবেতর জীবনের চেয়ে মরে যাওয়াও তো অনেক ভালো। তখন আসামি উত্তরে বললেন, “একদিন বাইর হমু তারপর মনের মতো সুন্দর করে জীবনডা সাজামু। এই আশায়া বাইচ্চা আছি।” এই গল্পে তোমাদের জন্যও শিখনীয় বিষয় আছে। আমি জানি তোমাদের বর্তমান সময়টা কারাগারের মতোই অন্ধকার এবং তোমরা মানবেতর জীবন যাপন করছো। তবে এই জেল থেকে বের হয়ে অর্থাৎ চান্স পেয়ে একটি সুন্দর জীবন গড়তে তোমাদেরকে নিজের সেরাটা দিয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তোমরা নিশ্চই জানো, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। তোমাদের শেষটা সাফল্যে ভরপুর হোক। তোমাদের সফলতা হিমালয়ের চূড়ার চেয়েও উঁচু হোক।

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।
কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম।

ই-মেইল: sajibprodhanbd@gmail.com


সর্বশেষ সংবাদ