উপাচার্যের নিয়োগ বাণিজ্য: ৩৫০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ৪২৬ শিক্ষক-কর্মকর্তা

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রহমান খানের লাগামহীন নিয়োগ বাণিজ্যে শিক্ষাঙ্গনটিতে এখন শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে এখন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৪২৬ জন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম চলে একটি স্কুল ও আরেকটি ভাড়া করা ভবনে।

ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের ছেলেমেয়ে, শ্যালক, ভাতিজা সবাই পেয়েছেন চাকরি। এমনকি শ্যালিকাপুত্রও নিরাশ হননি। জীবনে শিক্ষকতা না করলেও সহধর্মিণীকে অধ্যাপক বানিয়েও ফেলেছিলেন প্রায়। তবে ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া পথ হারায় ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরদারিতে।

তথ্য মতে, অনুমোদন পাওয়া ৪৪৭ পদের মধ্যে উপাচার্য তার ছেলে-মেয়ে, শ্যালক, ভাতিজাসহ ৪২৬ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। স্ত্রীকে নিয়োগ দিতে গেলে বাদ সাধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের বিষয়গুলো ইউজিসির তদন্তে প্রমাণিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ আগস্ট উপাচার্যের ছেলেমেয়েসহ ৯ স্বজন ও ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। এর আগে অনিয়ম হওয়ায় কয়েক দফা নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে চিঠি দিয়েছিল ইউজিসি। তবু এ বছর আরও ৪০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেন উপাচার্য।

এদিকে মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তিম সময়ে গত জুলাইয়ে পরিচালকসহ আরও ২৩ জনকে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন তিনি। তবে নানা আপত্তির মুখে এই কার্যক্রম আর শেষ করে যেতে পারেননি। উপাচার্য পদের মেয়াদের শেষ দিন শনিবার তার কোনো বিদায় সংবর্ধনা কিংবা আনুষ্ঠানিকতা হয়নি ক্যাম্পাসে। সেদিন রাতে অনেকটা নীরবেই খুলনা ছাড়েন উপাচার্য।

তার দেয়া নিয়োগ প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছেন, ছেলে শফিউর রহমান খান ও শ্যালক জসিম উদ্দিন হয়েছেন শাখা কর্মকর্তা। মেয়ে ইসরাত খান হয়েছেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক। চার ভাতিজার মধ্যে মুরাদ বিল্লাহ হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, সুলতান মাহমুদ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ইমরান হোসেন ল্যাব টেকনিশিয়ান ও মিজানুর রহমানকে বসানো হয়েছে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে। উপাচার্যের শ্যালিকার ছেলে সাইফুল্লাহ হককে নিয়োগ দেওয়া হয় সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) হিসেবে। ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ পাওয়া নিজাম উদ্দিনও উপাচার্যের আত্মীয়।

আরও পড়ুনঃ প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গড়ে তিন শিক্ষকের পদ শূন্য

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিষেধাজ্ঞা কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ- কোনো কিছুই পরোয়া করেননি কখনও। তদন্ত করে অনিয়ম ধরা পড়লেও দমানো যায়নি তাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব খাতে মিলেছে তার দুর্নীতি আর অনিয়মের প্রমাণ। তবে মেয়াদ ফুরানোর নিয়ম মেনে চার বছর শেষে চুপিচুপি ক্যাম্পাস ছাড়লেন তিনি। এখনো পর্যন্ত নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রহমান খান ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের ছিলেন। তিনি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন। তিনি যত দিন ক্যাম্পাসে ছিলেন, মেতেছিলেন জনবল নিয়োগের নেশায়। তার লাগামহীন নিয়োগবাজিতে শিক্ষাঙ্গনটিতে শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে এখন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৪২৬ জন। এই চার বছরে স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য কোনো প্রকল্পই অনুমোদন করাতে পারেননি উপাচার্য। এখন শিক্ষা কার্যক্রম চলছে সিটি করপোরেশনের একটি স্কুল ও আরেকটি ভাড়া করা ভবনে।

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, দায়িত্ব নিয়েই অস্থায়ী ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ শুরু করেন উপাচার্য। পরে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেই পদগুলো স্থায়ী করেন। এতে আপত্তি তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যরা। ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম ধাপে ২৯ শিক্ষকসহ ৭৬ জনকে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন উপাচার্য। তিনি নিজেই ছিলেন নিয়োগ বোর্ডের প্রধান।

নিয়োগে অনিয়ম দেখে ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে নালিশ জানান সিন্ডিকেটের পাঁচ সদস্য। চিঠিতে তাঁরা লিখেছিলেন, 'খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের শুরু থেকেই অস্বচ্ছতা ও আত্মীয়করণ দেখা যাচ্ছে। বিষয়টির যথাযথ তদন্ত করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অদক্ষ জনবল ও আত্মীয়করণের হাত থেকে রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, উপাচার্যের স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম বিশ্ববিদ্যালয়টির মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক পদে প্রার্থী হন। উপাচার্য নিজেই ছিলেন ওই নিয়োগ বোর্ডের প্রধান। এ নিয়ে সমালোচনা তৈরি হলে ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্তে ধরা পড়ে অনিয়ম :নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ২০২০ সালের নভেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি করে ইউজিসি। এক বছরের বেশি সময় পর তদন্ত কমিটি গত ২৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেয়।

অনিয়ম তদন্তের সময় নতুন নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত রাখতে গত ১০ জানুয়ারি রেজিস্ট্রারকে চিঠি দেয় ইউজিসি। চিঠিতে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা নিয়োগ স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এই সময় ১৫ কর্মকর্তা ও ৩৫ কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এঁদের বেশিরভাগই আগে অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মরত ছিলেন। নতুন করে আরও ১০ শিক্ষক ও ১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতে গত ১৮ জুলাই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তবে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে দোটানায় পড়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেননি উপাচার্য।

উপাচার্যের ছেলেমেয়েসহ ৯ স্বজন এবং একসঙ্গে ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশে ক্যাম্পাসে অস্বস্তি বিরাজ করছে। বিষয়টির সুরাহা না করে উপাচার্যের নীরব প্রস্থান মেনে নিতে পারছেন না কেউই।

সার্বিক বিষয় নিয়ে ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, আমরা তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন ও কিছু সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এর আলোকে মন্ত্রণালয় কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইউজিসির কোনো বক্তব্য নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়া উচিত।

রেজিস্ট্রার ড. খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার বলেন, উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন কাউকে এখনও দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রশাসনিক দৈনন্দিন কাজ স্বাভাবিকভাবে চলছে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিষয় সামনে এলে মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিয়ে কাজ করা হবে। তিনি বলেন, স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে জমি অধিগ্রহণ করে স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরি করা হবে। নিয়োগের ব্যাপারে তিনি জানান, ইউজিসির চিঠি পেয়ে ২৩ জনের নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।

খুলনা ছেড়ে শনিবার রাতেই সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শহীদুর রহমান খান ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলে যান। এ বিষয়ে কোনো গণমাধ্যমকে এখনো কোনো বক্তব্য দেননি তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ