জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগ ও রাজা-রানি ইতিবৃত্ত
- জাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২২, ০৬:৪৫ PM , আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২২, ০৮:২১ PM
ক্যামব্রিজ অনুযায়ী র্যাগ শব্দের অর্থ পুরনো ছেঁড়া কাপড়। অন্যদিকে অক্সফোর্ড অভিধান অনুসারে শব্দটির অর্থ এমন কোনো গোলমাল, বিরক্তিকর, হৈ-হুল্লোড়পূর্ণ দিন, যে দিন কর্তৃপক্ষকে দ্বন্দার্থে আহ্বান করা। র্যাগ ডে মূলত একটি গ্রীক কালচার। পূর্বে যারা দাতব্য কাজে র্যাগ ডে’র প্রচলন করেছে, তারা পথিকদের নিকট হতে অর্থ-কড়ি ও পুরানো কাপড় সংগ্রহ করতেন। এ নিয়ে অনেক সময় বিতর্ক ও ঝামেলা হতো।
শিক্ষার্থীরা এ দিনগুলোয় জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক, বড় বড় তোয়ালে, সবুজ পাখা পরিধান করে নানা ধরনের শব্দ করে রাস্তা দিয়ে শব্দ করতে করতে হেঁটে যেতেন। র্যাগ ডে শব্দের যথাযথ মর্মার্থ বুঝুক আর না বুঝুক সকল শিক্ষার্থীই এ শব্দের সঙ্গে খুবই পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নেচে, গেঁয়ে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পারস্পরিক রং মাখামাখি, টি শার্টে বিভিন্ন স্মৃতিচারণ মন্তব্য লেখার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উদযাপন করে।
আরও পড়ুন : এক দশকে কলায় পিএইচডি পেয়েছেন ২৮৮ জন, বিজ্ঞানে ৪০
ইউরোপ-আমেরিকায় র্যাগ ডে’র প্রচলন শুরু হলেও বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগ ডে কথাটির মূল অর্থ থেকে বেরিয়ে এসে ভিন্ন উপায়ে দিনটি উদযাপিত হয়। তবে ব্যতিক্রমী কিছু উদ্যোগের কারণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) র্যাগ ডে দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।
র্যাগ আয়োজন
কারোর একার পক্ষে র্যাগ আয়োজন করা সম্ভব হয় না। সম্মিলিত উদ্যোগে র্যাগ আয়োজন করা হয়ে থাকে। এজন্য একটি মূল কমিটি গঠিত হয়। মূল কমিটি থেকে কিছু ধাপ পর্যালোচনা করে উপকমিটি গঠিত হয়। এর আগে, শুরুতেই একজন আহ্বায়ক ও একজন কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। ক্রমে দুইজন করে সদস্য নিয়ে হল কমিটি, স্পন্সর কমিটি গঠন করা হয়।
আরও পড়ুন : চবির শাটল ট্রেনে পায়ের মাংস ছিঁড়ে গেল বহিরাগত যুবকের
এছাড়া র্যাগ ডে উদযাপনের মূল আকর্ষণ হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জাবির মুক্তমঞ্চে র্যাগার ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নিজস্ব পরিকল্পনা ও পরিবেশনায় এই সাংস্কৃতিক পর্বের আয়োজন করেন। এ জন্য একটি সাংস্কৃতিক কমিটিও গঠিত হয়। নাচ, গান, আবৃত্তি, র্যাম্প, অ্যাক্রোবেটিকসহ বিভিন্ন আয়োজনে সাংস্কৃতিক পর্ব সাজানো হয়।
রাজা-রানী নির্বাচন প্রক্রিয়া
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) র্যাগ ডে উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ রাজা-রানী নির্বাচন। এ পদে অংশ নিতে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কমিশন হতে মনোনয়ন ফর্ম কিনতে হয়। তবে ক্যাম্পাসে অত্যন্ত পরিচিত মুখরাই এ পদে আগ্রহ দেখায়। এছাড়া বেশ কিছু গুণাবলীর সমন্বয়ে রাজা-রানি নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া যায়।
পোস্টারিং, ক্যাম্পেইন, লিফলেট, ভোট চাওয়ার মাধ্যমে এ নির্বাচনের প্রচারণা প্রায় ১৫-২০ দিন পর্যন্ত চলে। এরপর নির্ধারিত দিনে নির্বাচন হয়। সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ও আকর্ষণীয় ব্যাপার হল রাজা-রানী প্রার্থীদের বর্ণাঢ্য রিকশা শোভাযাত্রা।
আরও পড়ুন : চবি ডিন নির্বাচন ৩০ মার্চ, তিন প্যানেলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা
র্যাগার ব্যাচের প্রত্যেক শিক্ষার্থীই ভোটার হিসেবে একজন রাজা এবং একজন রানীকে ভোট দেন। নির্বাচন কমিশনারের তত্ত্বাবধানে ভোট গ্রহণ ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে একজন রাজা ও একজন রানী নির্বাচিত হন।
তবে সপ্তম ব্যাচ থেকে জাবিতে মৌখিক বা সিলেকশনের মাধ্যমে রাজা-রানী নির্বাচন হতো। সবাই চেনে, জনপ্রিয় বা চোখে পড়ে এমন কাউকে নেওয়া হতো। জাবির ২৭তম ব্যাচ থেকে ভোটের মাধ্যমে রাজা-রানী নির্বাচন শুরু হয়। এ ব্যাচের রাজা ছিলেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আহমেদ শরীফ সানি এবং রানী ছিলেন আইবিএ’র তানি। এরপর থেকেই এই প্রক্রিয়া রাজা-রানি নির্বাচিত হয়।
বর্তমানে যেভাবে র্যাগ উৎসব
জাবিতে শুরু দিকে স্নাতক পর্যায়ে ক্লাস শেষের দিনে র্যাগ পালিত হতো। তবে বর্তমানে ন্যূনতম ৩ দিন র্যাগ উদযাপন করা হয়। মূলত স্নাতক শেষ হওয়ার পর থেকেই এই আয়োজন শুরু হয়। এ আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় কোন সহায়তা দেয় না। তাই চাঁদার মাধ্যমেই এ উৎসবের আয়োজন করা হয়।
আরও পড়ুন : জাবির র্যাগ ডের নৃত্যে ক্ষুব্ধ সালমান, ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো স্পন্সর করার জন্য এগিয়ে আসছে। কয়েক মাসের ফান্ডিং দিয়ে এ আয়োজন করা হয়। র্যাগার ব্যাচ থেকে মুভি ফেস্টিভ্যালসহ ছোট ছোট কিছু আয়োজনে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এরপর চলে ব্যাচ লগো ও শ্লোগান আর্টের কাজ। এছাড়া ব্যাচের বাঁশ ও ছন দিয়ে র্যাগার ব্যাচের টেন্টও বানানো হয়। এতে র্যাগার ব্যাচের আড্ডা চলে। এভাবে ক্রমশই মূল আয়োজন আনুষ্ঠানিকতা পায়।
র্যাগারদের অনুভূতি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম আবর্তনে রাজা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সিফাত আল রাব্বানী। আর রানির খেতাব জিতেছেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ফারহানা রহমান শোভা।
৪২তম ব্যাচের র্যাগ রাজা সিফাত আল রাব্বানী বলেন, বন্ধুদের ভালোবাসার কারণে, তাদের ইচ্ছায় রাজা নির্বাচিত হয়েছি। এটা যেমন একটি বড় পাওয়া। করোনার কারণে নানা ধরণের অনিশ্চয়তাকে অতিক্রম করে র্যাগ ডে উৎযাপন করতে পারাটাও সেরকম অর্জন। এই বিষয়গুলোই একটি দারুণ অনুভূতি তৈরি করেছে। এ জন্য আহ্বায়ক ইসমাইল হোসেন, র্যাগ রানি শোভাসহ সকল বন্ধুদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আরও পড়ুন : পরীক্ষা দিতে পারবে ছাত্র লাঞ্ছনার অভিযোগে বহিষ্কৃত জাবির দুই ছাত্রী
রানী ফারহানা রহমান শোভা বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা ব্যাচের জন্য র্যাগ ডে একটা স্বপ্নের মতো দিন। তারা চায় তাদের ব্যাচকে সবাই মনে রাখুক। জাবির মতো এতো বড় একটা ভার্সিটিতে ভোটের মাধ্যমে একটা ব্যাচের র্যাগের রানী হতে পেরেছি। এজন্য আমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। নানামুখী চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে অনুষ্ঠানটি করতে পারায় নিজেকে চ্যালেঞ্জিং রানী মনে হয়েছে।
জাবির শিক্ষার্থীদের মন্তব্য
জাবির ৪৫ তম ব্যাচের ইতিহাস বিভাগের পাপিয়া জানান, র্যাগ ও রাজা রানি নির্বাচন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঐতিহ্য। এর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উৎসব মুখর আমেজ তৈরি হয়। যুগ যুগ ধরে এ উৎসব চলতে থাকুক।
জাবির ৪৩তম আবর্তনের শিক্ষার্থী তামান্না বিনতে জামান জানান, এ বছর করোনাকালীন অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে র্যাগ শেষ হয়েছে, এটাই বড় কথা। তবে প্রতিটি আনন্দ উৎসবে আলোচনা-সমালোচনা থাকবেই।