ঢাবির ৫ ছাত্রী হলে পুরুষ নিরাপত্তা প্রহরীদের ‘হয়রানি’ যেন নিত্যসঙ্গী

*প্রতিকার চান ছাত্রীরা *অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব: প্রশাসন

ঢাবির নারীদের ৫টি হল
ঢাবির নারীদের ৫টি হল  © টিডিসি ফটো

‘এখান থেকে এখনি বের হয়ে যান। কোনো চিপার মধ্যে ঢুকে আপনি বসে থাকলে আমি কীভাবে দেখবো’— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের সামনে রাস্তায় দাঁড়ানো অবস্থায় এক নারী শিক্ষার্থীকে এভাবে চলে যেতে বলেন ওই হলের এক পুরুষ নিরাপত্তা প্রহরী (দারোয়ান)।

শুধু ওই ছাত্রী নন, বিশ্ববিদ্যালয়টির মেয়েদের ৫টি হলে কর্মরত এসব কর্মচারীদের হয়রানিমূলক নানা কথাবার্তা ও প্রশ্নে ক্ষুব্ধ নারী শিক্ষার্থীরা। বাসা থেকে আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিবারের কেউ দেখা করতে আসলেও তাদের সামনে পুরুষ নিরাপত্তা প্রহরী কর্তৃক করা হয় এমন আচরণ।

আরও পড়ুন: এক বেলা খেয়েও ঢাবিতে মেয়েকে পড়ানো কাঠমিস্ত্রি বাবা আজ নিঃস্ব

এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য চারটি নারী হলের (রোকেয়া হল, শামসুন নাহার হল, সুফিয়া কামাল হল ও বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হল) নারী শিক্ষার্থীদের সাথেও খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ উঠছে হল গেটে থাকা এসব কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ ঘটনা তাদের সঙ্গে প্রায় ঘটে থাকে। বিশেষ করে নন-পলিটিক্যাল ছাত্রীদের (রাজনীতির সাথে যুক্ত নয় এমন ছাত্রীরা) সঙ্গে। তাই তারা এই ঘটনার প্রতিকার চান। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের অভিযোগ কোনোভাবেই কাম্য নয়। ছাত্রীদের কাছ থেকে এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে অভিযুক্ত কর্মচারীদের বদলিসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

“এখনো পর্যন্ত কোনো নারী শিক্ষার্থী এ বিষয়ে অভিযোগ করেনি। তবে অভিযোগপত্র জমা দিলে বা আমাকে বললে তদন্ত সাপেক্ষে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজন হলে অভিযুক্ত দারোয়ানকে পরিবর্তন করে দিবো- প্রক্টর, ঢাবি

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির মেয়েদের ৫টি হল ভোর ৬টায় হল গেট খোলা হয়, আর রাত ১০টায় গেট বন্ধ হয়। কিন্তু কোন ছাত্রী জরুরি প্রয়োজনে বাইরে থাকে এক্ষেত্রে তিনি লেইট পারমিশন নিতে পারেন। লেইট পারমিশন নিলে সর্বোচ্চ রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বাহিরে অবস্থান করতে পারে।

কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, মেয়েদের হলে রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকা নারী শিক্ষার্থীরা রাতে যে কোনো সময় চাইলে প্রবেশ ও বের হতে পারেন। তাদেরকে প্রবেশ ও বের হতে কোনো বাধা দেয় না হল কর্তৃপক্ষ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকা কর্মচারীরা।

আরও পড়ুন: সেই আলিফ প্রফেশনাল মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টারে দ্বিতীয়, তার মা নবম

গত ১৯ জানুয়ারি রাতে বঙ্গমাতা হলের সাবেক এক নারী শিক্ষার্থী ও তার বন্ধু হলের বাহিরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি আর আমার এক বন্ধু (ছেলে) হলের বাহিরের রাস্তায় হাঁটছিলাম, তখন রাত ১০টা ৫০ মিনিট। তখন হলের এক মামা (কর্মচারী) ভয়ানক বাজেভাবে আমাকে বের হয়ে যেতে বলেন। এরপর আমি বাহিরের গেইট বন্ধ হওয়ার টাইম জিজ্ঞেস করলে বলেন যে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত।

“নারী শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দিলে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। যে হলে এমন ঘটনা ঘটবে, প্রথমে সেই হলের প্রভোস্টকে জানাতে হবে। প্রভোস্ট ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পরবর্তীতে আমরা ব্যবস্থা নেব- সভাপতি, প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি

“এরপর আমি জিজ্ঞেস করলাম যে তাহলে আমি তো আরও ১৫-২০ মিনিট আগেই এখানে এসেছি, তখনও তো কিছু বলেননি। উনি বলেন, "আপনি কোনো চিপার মধ্যে ঢুকে বসে থাকলে আমি কীভাবে দেখবো?”

আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন, উনার অস্বস্তির কথা ভেবে আমি খুব একটা কথা বলতেও পারিনি। এরপর গেট রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে এটা বললে উনি বলেন, আমার ইচ্ছে আমি গেট খুলে রাখবো। আপনার কাছে হিসেব দিতে হবে নাকি?

আরও পড়ুন: ঢাবির ছাত্রী হলে নেই মিল সিস্টেম, ভোগান্তির সঙ্গী বাড়তি খরচও

জানতে চাইলে অভিযুক্ত বঙ্গমাতা হল দারোয়ান আলমগীর হোসেন বলেন, আমি সবার সাথে ভালো ব্যবহার করি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরের একজন ছেলে ছিল তাই দুজনকে বের হয়ে যেতে বলেছি। 

কিন্তু আপনি কাউকে বের করতে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কথা বলতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ধরনের খারাপ ব্যবহার আমি করিনি। আমি কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করি না।

“কাউকে কোনো নির্দেশনা মানাতে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা কখনো উচিত নয়। আমি এ বিষয় জানতাম না। হলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব- প্রভোস্ট, বঙ্গমাতা হল

রাজনীতির সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীরা রাত ১১টার পরও কীভাবে বের হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, উনারা হল অফিসের সাথে যোগাযোগ করেন। হল কর্তৃপক্ষ বললে আমরা প্রবেশের অনুমতি দেই।  

জানতে চাইলে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. ফারহানা বেগম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কাউকে কোনো নির্দেশনা মানাতে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা কখনো উচিত নয়। আমি এ বিষয় জানতাম না। হলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।

আরও পড়ুন: চাপে পড়ে চবির বিজ্ঞাপনের খরচ কি উপাচার্যই দিচ্ছেন?

রাজনীতির সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীরা রাত ১১টার পরও কীভাবে বের হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে কারো জরুরি প্রয়োজনে আমরা বের হওয়ার অনুমতি দেই। অনেক সময় অনেকের প্রোগ্রাম থাকে, কাজ থাকে। তখন অনুমতি দেওয়া হয়।   

বঙ্গমাতা হলের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সারাফ আফরা মৌ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বঙ্গমাতা হলের গেস্টরুমে এক শুক্রবারে বাবা এসে সকালে আধা ঘণ্টা, বিকালে আধা ঘণ্টা, আর রাতেও আধা ঘণ্টার মত ছিল। কোনো জিনিস আনতে বা রাখতে গিয়ে আমার রুমে যেতে এবং আসতে যতক্ষণ সময় লাগা দরকার, ততক্ষণই বাবা ওখানে বসেছিলো।

“রিটার্ন ট্রেন ধরার আগে বাবার ব্যাগ এনে দেওয়ার জন্য রাতে ৯টার দিকে ১০/১৫ মিনিটের জন্য গেস্ট রুমে বসিয়ে রুমে গেলাম। এর মধ্যে গেটের এক মামা নাকি এসে আমার বাবাকে কটু কথা শোনায়। এভাবে নাকি বসে থাকা যায় না, তো গেস্টরুমটা তাহলে কী কাজের জন্য রাখা হয়েছে, এটা আমার বোধগম্য নয়। বছরে ২/১ বারই বাবা-মা আমাদের সাথে দেখতে আসে৷ এরপরও যদি তাদের সাথে এমন ব্যবহার করা হয় তাহলে তারা তো আর কখনো আসবে না।”

শামসুন নাহার হলের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফা জাহান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একদিন ক্যাম্পাসে হঠাৎ আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। যেহেতু অনাবাসিক শিক্ষার্থী, তাই বাসাও দূরে। পরে রোকেয়া হলের কয়েকজন বান্ধবী (যারা আবাসিক) তারা কার্ড জমা রেখে হলের ভেতরে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু হলের ভেতরে যেতে দেননি দায়িত্বরত দারোয়ান। এমনকি গেস্টরুমও খুলে দেয়া হয়নি।

“বরং যারা হলের ভেতরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তাদের হলের আইডি কার্ড আটকে রেখে বলেছিলেন, এগুলো হল অফিসে ম্যামের কাছে জমা দিয়ে দিবেন এবং তাই করেছেন। এটা তো একদিনের ঘটনা। প্রায়ই এরকম করে থাকেন উনারা।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ৪র্থ বর্ষের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, শামসুন নাহার হলে আমার এটাস্টেড। সিটের ব্যাপারে ম্যামের সাথে দেখা করতে গেলেও দারওয়ানদের কাছে নানান রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। হল এ থাকি না বলে কার্ড দেখানোর পরও নিজের হলের ক্যান্টিনের খাবার খেতে পারি না তাদের জন্য। এমনকি তারা বলে, গেট খোলা আছে বের হয়ে যান, বলে হুকমি দেন।

“একদিন ক্যাম্পাসে হঠাৎ আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। যেহেতু অনাবাসিক শিক্ষার্থী, তাই বাসাও দূরে। পরে রোকেয়া হলের কয়েকজন বান্ধবী (যারা আবাসিক) তারা কার্ড জমা রেখে হলের ভেতরে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু হলের ভেতরে যেতে দেননি দায়িত্বরত দারোয়ান। এমনকি গেস্টরুমও খুলে দেয়া হয়নি- আরিফা জাহান, শিক্ষার্থী, ঢাবি

তিনি আরও বলেন, শামসুন নাহার হলের গেস্টরুম খোলা থাকে না, আত্মীয়-স্বজন আসলে যে বসতে দেওয়া যাবে সেটাও পারা যায় না। তাদের নাকি গেস্টরুম খোলার শিডিউল আছে, একদিন সুফিয়া কামাল হলের বান্ধবীরা আমার হলে এসেছিল। গেস্টরুম খোলা ছিল রাত ৮টার দিকে। ওদের গেস্টরুমে বসতে দিয়েছি বলে ওদেরকে বের করে সাথে সাথেই গেস্টরুমে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল দারোয়ান। একজন ঢাবি শিক্ষার্থীর সাথে এমন আচরণ করা মোটেও কাম্য নয়। এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

আরও পড়ুন: ঢাবির শিক্ষার্থীবান্ধব হল প্রভোস্ট অধ্যাপক জাকির হোসেন ভূইয়া

বঙ্গমাতা হলের তৃতীয় বর্ষের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, অন্তত ৪ বার হয়েছে যে মৈত্রী হলে ঢুকতে চেয়েছি, কিন্তু ওই হলের দাদুরা (দারোয়ান) ঢুকতে দেয়নি। গেস্ট রুমেই বসতে দেওয়া হবে সর্বোচ্চ, ব্যাপারটা এমন। আমার হলের বিপণী একদিন বন্ধ ছিল, প্রয়োজনের সময়ও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাছাড়া বন্ধু আছে ওই হলে, ওদের রুমেও যাওয়ার পারমিশন নেই। একই ঘটনাটা কয়েকবার রোকেয়া হল, শামসুন নাহার হলেও ফেইস (সম্মুখীন হওয়া) করেছি। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড জমা রেখে ঢুকতে দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।

সুফিয়া কামাল হলের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রী বলেন, হলের দারোয়ানরা যদি অন্য হলের কাউকে (ছাত্রী) হলে পান, তাহলে প্রচুর অপমান করে। এমনকি যাদের অনাবাসিক আইডি কার্ড আছে তারাও এই হলে ঢুকতে পারেন না।

“এ বিষয়ে জানতে চাইলে দারোয়ানরা বলেন, এটা নাকি হলের নিয়ম। এ হলের কোনো শিক্ষার্থী বিপদে পড়লে বা অসুস্থ হলে তার মা-বাবা দেখতে আসতে চাইলেও হল এ প্রবেশ করতে পারেন না।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল রউফ মামুন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, দারোয়ানদের দুর্ব্যবহার নিয়ে কোনো নারী শিক্ষার্থী অভিযোগ করিনি। তবে শিক্ষার্থীদের সাথে দারোয়ানের খারাপ ব্যবহার মোটেও কাম্য নয়।

তিনি বলেন, নারী শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দিলে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। যে হলে এমন ঘটনা ঘটবে, প্রথমে সেই হলের প্রভোস্টকে জানাতে হবে। প্রভোস্ট ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পরবর্তীতে আমরা ব্যবস্থা নেব।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হলের মেয়ে অন্য হলে প্রবেশ করতে পারে, এতে বাধা প্রদান করার কিছু নেই। তবে হলের নারী শিক্ষার্থীদের সাথে দারোয়ানদের বাজে ব্যবহার মোটেও গ্রহণীয় নয়।

তিনি আরও বলেন, এখনো পর্যন্ত কোনো নারী শিক্ষার্থী এ বিষয়ে অভিযোগ করেনি। তবে অভিযোগপত্র জমা দিলে বা আমাকে বললে তদন্ত সাপেক্ষে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজন হলে অভিযুক্ত দারোয়ানকে পরিবর্তন করে দিবো।


সর্বশেষ সংবাদ