‘হাসিনার পতনে সব যন্ত্রণা ভুলে গেছি’

শরীরে গুলি নিয়ে কতরাচ্ছেন কলেজছাত্র খালেদ মাহমুদ সুজন।
শরীরে গুলি নিয়ে কতরাচ্ছেন কলেজছাত্র খালেদ মাহমুদ সুজন।  © সংগৃহীত

এক দফা দাবি নিয়ে সারাদেশের মতো লক্ষ্মীপুরে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন ১৯ বছরের কলেজছাত্র খালেদ মাহমুদ সুজন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলিবিদ্ধ হয় সুজনের। পুরো শরীর জুড়ে ৮টি গুলি রয়ে গেলেও অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না তার পরিবার। চিকিৎসকের মতে বিদেশের উন্নত চিকিৎসা না দেওয়া হলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে সুজন। 

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএসসি অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী খালেদ মাহমুদ সুজন লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার চররুহিতা এলাকার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হতদরিদ্র শাহীন কাদিরের ছেলে। তার ছোট দুই ভাই সোহান হোসেন ও শিহাব হোসেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে সোহান হোসেনও বাবার মতো বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। অপর ভাই শিহাব ৮ম শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। মা-বাবাসহ পাঁচজনের সংসার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন। পরিবারের পাঁচ সদস্যের আহার এবং নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে খণ্ডকালীন একটি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতেন তিনি।

আরও পড়ুন: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত সাংবাদিক তুরাবের মাকে দেখতে গেলেন সমন্বয়করা  

শ্লোগানে শ্লোগানে লক্ষ্মীপুর উত্তাল ছিল ৪ আগস্ট। সেদিন শহরের মাদাম ব্রিজ ও তমিজ মার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সহপাঠীদের সাথে অংশ নেয় কলেজ শিক্ষার্থী খালেদ মাহমুদ সুজন। এসময় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এক পর্যায়ে শহরের নিজ বাসভবনের ছাদ থেকে প্রকাশ্যেই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একেএম সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু হয়। এতে খালেদ মাহমুদ সুজনসহ তিনশর বেশি শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়। এসময় মারা যায় চার শিক্ষার্থী। গুলিবিদ্ধ সুজনকে প্রথমে লক্ষ্মীপুর সদর পরে ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি করে অপারেশনের মাধ্যমে দুইটি গুলি বের করা হয়। এখনো তার ঘাড়-গলা ও ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৮টি গুলি রয়েছে। যেগুলো এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। শরীরে এসব গুলি নিয়ে বাড়িতে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন সুজন। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না বুদ্ধি প্রতিবন্ধী তার পিতা।

সম্প্রতি চররুহিতার তাজুল ইসলাম ভূঁইয়া বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী খালেদ মাহমুদ সুজনকে কফিল উদ্দিন ও আজাদ চৌধুরী নামে দুইজন তাদের কাঁধে ভর দিয়ে ঘর থেকে বের করছেন। কোনোভাবেই সুজন দাঁড়াতে পারছেন না। পাশে তার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীবাবা এবং শাহীন কাদির ও ছোটভাই সোহান দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এ সময়ে তাদের দুইজনকে চোখের পানি মুছতে দেখা গেছে।

আরও পড়ুন: ‘আল্লাহ জানেন আর আমি জানি, টাকার কাছে বিক্রি হই নাই’ –তাসরিফের আবেগী স্ট্যাটাস

সুজন জানান, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে ডাকা সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। গত ৪ আগস্ট দুপুরে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে তাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়। এতে তার শরীরে ১০টি বুলেট বিদ্ধ হয়। অপারেশন করে দুইটি গুলি বের করলেও ৮টি গুলি এখনো শরীরের ভিতর রয়েছে।

র্অথের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারিভাবে এখনও কোন সহায়তা পাইনি। আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। দ্বিতীয়বারের মতো দেশ স্বাধীন হয়েছে, এটাই বড় প্রাপ্তি। যতই কষ্ট বা যন্ত্রণা হোক, মনে প্রশান্তি আছে। হাসিনার পতনে সকল কষ্ট ভুলে গিয়েছি।

সুজনের আত্মীয় কফিল উদ্দিন ও আজাদ চৌধুরী বলেন, অসহায় এই পরিবারের সদস্যদের এখন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন সুজন। সে পড়ালেখার পাশাপাশি একটি দোকানে খণ্ডকালীন চাকুরি করে পরিবারের ও পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছিলেন। এখন কীভাবে সামনের দিনগুলো যাবে, সে চিন্তায় দিশেহারা পরিবার। 

সমাজের বিত্তবানরা তার চিকিৎসায় এগিয়ে আসবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেন স্বজনরা। পাশাপাশি গুলিবর্ষণকারী সন্ত্রাসী সালাউদ্দিন টিপুসহ জড়িতদের গ্রেফতার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানান তারা। এছাড়াও সুজনকে দ্রুত বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছেও দাবি জানান আহত শিক্ষার্থীর স্বজনরা।

আরও পড়ুন: বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে শুধু কি শিক্ষকরাই বিচারের কাঠগড়ায়?

লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা.মো. জয়নাল আবেদিন বলেন, দেশে খালেদ মাহমুদ সুজনের চিকিৎসা সম্ভব নয়। প্রতিটি গুলি খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থায় রয়েছে। গুলির কারণে শরীরে ইনফেকশন দেখা দিলে সুজনের জীবনহানিও ঘটতে পারে।

জেলা প্রশাসক রাজিব কুমার সরকার বলেন, বৈষম্য বিরোধী হতাহত শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন সব সময় আছে। থাকবে। পাশাপাশি যারা তাদের ওপর হামলা ও গুলিবর্ষণ করেছে, তাদের কেউই রেহাই পাবে না। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। উদ্ধার করা হবে অবৈধ সকল অস্ত্র। এ বিষয়ে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

জেলা পুলিশ সুপার মো. আকতার হোসেন বলেন, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ছাত্রদের ওপর হামলাকারীরা ছাড় পাবেনা, তাদের ধরতে ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে। অপরাধী যতই বড় বা শক্তিশালী হোক না কেন, ধরা পড়তে হবেই।


সর্বশেষ সংবাদ