শিক্ষকের ভুলে হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময়

এসএসসি পরীক্ষা
এসএসসি পরীক্ষা   © ফাইল ফটো

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষার একটি এসএসসি পরীক্ষা। উচ্চশিক্ষা থেকে কর্মক্ষেত্র সর্বত্র এই পরীক্ষার ফলাফলকে গুরুত্ব প্রদান করায় শিক্ষার্থীদেরও এই পরীক্ষাকে ঘিরে থাকে ব্যাপক প্রস্তুতি। টানা দুই বছরের প্রচেষ্টায় নিজেদেরকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেন তারা। কিন্তু প্রতিবছরই শিক্ষকদের ভুলে সকল প্রস্তুতি নিয়েও স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে কিছু শিক্ষার্থীর। রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত জটিলতায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এসব শিক্ষার্থী।

দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায়ও ছয় শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত জটিলতায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। এদের মধ্যে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পাঁচ জন এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন শিক্ষার্থী রয়েছেন।

আরো পড়ুন: পাল্টে গেলো ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির ক্লাস রুটিন 

দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পাঁচ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনজনই নীলফামারী সদর উপজেলার টুপামারী দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই বিদ্যালয়ের মোট ১৮ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষার আগে রেজিষ্ট্রেশন কার্ড এবং প্রবেশপত্র পাননি। পরবর্তীতে তারা আন্দোলন করলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে পরীক্ষার আগের রাতে ১৫ জন প্রবেশপত্র পান। কিন্তু তিনজনের রেজিস্ট্রেশন ফর্ম বিদ্যালয় থেকে পূরণ না করায় তাদের প্রবেশপত্র আসেনি।

ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান আশিক বলেন, গত ছয় মাস আগে জানতে পারি যে আমার রেজিস্ট্রেশন হয়নি। এরপর থেকেই স্যারকে রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়ার অনুরোধ করেছি। স্যার বলেছিল বাবা তুমি কোনো টেনশন করো না এটা হবেই। আমি চেষ্টা করতেছি তুমি তোমার মতো পড়াশোনা করো। এখন শেষ সময়ে এসে আমি পরীক্ষা দিতে পারলাম না। বন্ধুরা যখন এসএসসি পরীক্ষা দিল আমি তখন বাড়িতে বসেছিলাম। আমার যে কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটা শুধু আমি বুঝতেছি।

আশিক আরো বলেন, আমার সঙ্গে আরও দুই বন্ধুর সমস্যা হয়েছে। তাদের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল কিন্ত পরীক্ষা দিতে না পেরে আমার মতো বাড়িতে অসহায় হয়ে বসে আছে। আমি এটার সুষ্ঠু বিচার চাই এরকম ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য এই স্যারের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

আরো পড়ুন: শিক্ষা কর্মকর্তা চাকরি দিতে ঘুষ নেন ৩৪ লাখ টাকা 

আশিকের বাবা রবিউল ইসলাম বলেন, যখন যা চাইছে দিছি। এখন শুনতেছি যে আর পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। আমার ছেলেটার জীবনটা যে ওরা নষ্ট করল এর দায়টা কে নিবে। আমি তো একজন গরিব মানুষ। আমি কত কষ্ট করে আমার ছেলেকে লেখাপড়া করাইছি সেটা তো আমি জানি। আমি এর বিচার চাই।

জয়দেব নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমি একজন শারিরীক প্রতিবন্ধী ছাত্র। প্রবেশ পত্র না পাওয়ায় পরীক্ষা দিতে পারিনি। বন্ধুরা সবাই যখন পরীক্ষা দিল আমি তখন বাড়িতে বসেছিলাম। এতোদিন কষ্ট করে পড়াশোনা করে আজ পরীক্ষা দিতে পারলাম না শুধুমাত্র হেড স্যারের গাফিলতির কারণে। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ আমাদের জীবন এভাবে নষ্ট করার জন্য স্যারের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।

এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসুদ রহমানের সাথে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

আরো পড়ুন: শৌচাগারে থাকা ছাত্রীর ভিডিও করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র

প্রধান শিক্ষকের ভুলে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না নীলফামারীর ডিমলা খগা বড়বাড়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিমু আক্তারও। তার বিদ্যালয়ের মানবিক শাখা থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিলো।

শিমুর বাবা রবিউল ইসলাম জানান, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে যথা সময়ে শিমু আক্তারের  ফরম পূরণের জন্য দুই হাজার চারশত টাকা জমা দেওয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি পরীক্ষার প্রবেশপত্র ও রেজিস্ট্রেশন কার্ড নিতে বিদ্যালয়ে গেলে প্রধান শিক্ষক জানান শিমুর ফরম পূরণ হয়নি। পরে প্রধান শিক্ষকের নিকট এ বিষয় জানতে চাইলে তিনি বিভিন্ন তালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করেন। 

রবিউল ইসলাম আরও বলেন, প্রধান শিক্ষকের এরকম অবহেলার কারণে আমার মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ হয়নি। ফরম পূরণের জন্য আরো ছয় হাজার টাকা চেয়েছেন তিনি। আমি গরীব মানুষ এতো টাকা কোথায় পাবো।

আরো পড়ুন: আসন ফাঁকা রেখে ভর্তি: দায়েরকৃত রিটের কপি পেয়েছে জবি 

শিক্ষার্থী শিমু আক্তার বলেন, আমি প্রধান শিক্ষককে ফরম পূরণের জন্য টাকা জমা দিয়েছি। প্রবেশপত্র তুলতে গিয়ে জানতে পারি আমার এসএসসি ফরম পূরণ হয়নি। ভুল করে আমার নামের পরিবর্তে আরেকজন ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর নামে ফরম পূরণ হয়েছে। এখন প্রধান শিক্ষক আমাকে এক বছর অপেক্ষা করতে বলছেন। আমি এর বিচার চাই।

এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক মারুফা আক্তারের সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়। 

একই ঘটনার শিকার রংপুর সদর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের রূপসী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসানও। মেহেদী জানান, তিনি ফরম পূরণ বাবদ ২ হাজার ৮০০ টাকা প্রদান করেন প্রধান শিক্ষকের কাছে। এছাড়াও বোর্ডে যাতায়াতের জন্য অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা প্রদান করেন। কিন্তু যখন বিদ্যালয়ের বাকিদের প্রবেশপত্র আসে তখন তার প্রবেশপত্র আসেনি। প্রধান শিক্ষকের  কাছে প্রবেশপত্র চাইলে আজ না কাল চলে আসবে বলে টাল-বাহানা করতে থাকে। পরীক্ষার আগের দিন হলে প্রবেশপত্র পেয়ে যাবে বলেও আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যায় জানতে পারেন তার ফরম পূরণ করা হয়নি।

আরো পড়ুন: ফেসবুকে পোস্ট: লিখিত মুচলেকায় ক্ষমা পেলেন ঢাবি অধ্যাপক

মেহেদি হাসানের বাবা মোক্তারুর রহমান বলেন, ১৬ বছর ধরে দিনমজুরি করে আমার ছেলের পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছি। ফরম ফিলাপের টাকা ছাড়াও বোর্ডে যাতায়াতের জন্য অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রধান শিক্ষকের ভুলে আমার ছেলে পরীক্ষা পারেনি এর দায় তাকেই (প্রধান শিক্ষক) নিতে হবে।

এ বিষয়ে রূপসী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল হক বলেন, মেহেদি হাসানের ফরম ফিলাপ করতে গিয়ে ভুল হয়েছে। তার সঙ্গে কথা বলে আগামীতে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু সে এলাকাবাসীকে নিয়ে স্কুলে এসে হট্টোগোল শুরু করে। আমার সাথেও খারাপ আচরণ করে।

শিক্ষকের ভুলে পরীক্ষা দিতে পারছেন না ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কৈলাইল ইউনিয়ন টেকনিক্যাল হাই স্কুলের শাওন মণ্ডল নামের আরও এক শিক্ষার্থী। 

আরো পড়ুন: ক্যাম্পাসেই মারধর ও ছিনতাইয়ের শিকার রাবি শিক্ষার্থী, প্রশাসনের ভূমিকায় প্রশ্ন

শাওন মণ্ডল বলেন, স্কুলের বেতন, সেমিস্টার, রেজিস্ট্রেশন ফিসহ সব ধরণের ফি পরিশোধ করেছি। কিন্তু  ঈদের ছুটির পর গত ২৬ এপ্রিল সহপাঠীদের সঙ্গে আমি প্রবেশ পত্র আনতে স্কুলে গেলে জানতে পারি আমার প্রবেশ পত্র আসেনি। পরে আমাকে জানানো হয় আমার নাকি রেজিস্ট্রেশনই হয়নি।

শাওনের বাবা প্রাণতুষ্ট মণ্ডল বলেন, ছেলের মুখে ঘটনা শুনে আমি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ফোন দিলে তিনি আমাকে আশ্বাস দেন বিষয়টি সমাধানের। কিন্তু পরদিন আবার আমি ফোন দিলে তখন তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আগামী বছর বিনা খরচে শাওনের পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি। দুঃখ প্রকাশ করে কি হবে। ওই স্যার কি আমার ছেলের জীবনের দুই বছর ফিরিয়ে দিতে পারবে।

কৈলাইল টেকনিক্যাল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, নবম  শ্রেণিতে যখন ছাত্র-ছাত্রীদের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শাওন মন্ডল তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দেয়নি। তাকে সময় দেওয়া হয়েছিল, যোগাযোগ করেনি সে। স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভুলে গেলে আর নিবন্ধন করা হয়নি।

আরো পড়ুন: ঢাকাসহ ৮ বিভাগে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস

এসময় তিনি আরো বলেন, চূড়ান্তভাবে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের তালিকা আসলে শাওন মন্ডলের নাম না থাকার বিষয়টি আমরা জানতে পারি। আমি বোর্ডে যোগাযোগ করেছিলাম, তবে এ বছর আর পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নেই। আগামী বছর শাওন পরীক্ষা দিতে পারবে। 

এদিকে এমন ঘটনার ফলে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নীলফামারী সদর উপজেলার টুপামারী দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, যে তিনজন পরীক্ষা দিতে পারছে না তাদের মধ্যে দুজনের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এই ঘটনার পর তারা আবারও এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে কিনা এবং অংশগ্রহণ করলেও পড়ালেখার আগ্রহ পাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

এই শিক্ষক আরও বলেন, আমরাও একসময় শিক্ষার্থী ছিলাম। যখন সহপাঠীরা সবাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তখন একজন অংশগ্রহণ করতে না পারলে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, অনেকে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের সাথে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে ভেবেও পুনরায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণে অস্বস্তি বোধ করে। তাই যারা ফর্ম পূরণের দায়িত্বে থাকে তাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত।

আরো পড়ুন: দ্বিতীয় দিনের মতো কারিগরি অধিদপ্তরের সামনে পলিটেকনিকের শিক্ষকরা

এ বিষয়ে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একজন শিক্ষার্থীর জীবনের মূল্যবান সময় এভাবে নষ্ট হবে সেটি কাম্য নয়। আমরা বোর্ডের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ আন্তরিক ছিলাম। পরীক্ষার আগের দিন রাত পর্যন্ত আমরা কাজ করেছি এবং যারা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এসেছি তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করেছি৷ এধরণের ঘটনা আমরা আগে জানলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতাম। 

এসময় তিনি আরও বলেন, যদি ভুক্তভোগী বা তাদের অভিভাবকরা এ বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ দেয় তাহলে এখতিয়ার অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এছাড়া, প্রতিটি স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি রয়েছে। বিদ্যালয় সংক্রান্ত অভিযোগগুলো তারা সমাধান করতে পারেন। এসব বিষয়ে তারা আরও সচেতন হলে আশা করছি এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ হবে।

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।


সর্বশেষ সংবাদ