ইডেনে সিট বাণিজ্যে: কোটি টাকা পকেটে ভরছে ছাত্রলীগ!

ইডেন কলেজ
ইডেন কলেজ  © ফাইল ছবি

ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দল এখন সবার জানা। তবে এই সমস্যা একদিনে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেনি। এর পেছনে রয়েছে কোটি টাকার সিট বাণিজ্য। আপাতদৃষ্টিতে কলেজ ছাত্রলীগের এক নেত্রীকে মারধরের ঘটনার জেরে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হলেও এর পেছনে রয়েছে মূলত দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা কলেজের হলগুলোর কক্ষের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব। যেই দ্বন্দ্বের পেছনে রয়েছে মোটা অংকের টাকা।

কলেজ ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেত্রীর ভাষ্য, এককালীন কোটি টাকা পকেটে ভরেছেন ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যরা। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের ভেতরের ক্যান্টিন ও বাইরের ফুটপাতের দোকানগুলোতে চাঁদাবাজির টাকার ভাগবাটোয়ারাও অন্তর্কোন্দলের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিদ্যাপিঠ ইডেন মহিলা কলেজ। বিপুলসংখ্যক এই শিক্ষার্থীর আবাসনের জন্য আছে মাত্র ছয়টি ছাত্রীনিবাস। সিট আছে ৩ হাজার ৩১০টি। হলে থাকছেন অন্তত ১২ হাজার শিক্ষার্থী। একেক কক্ষে ১২ থেকে ১৫ জন পর্যন্ত থাকছেন। গাদাগাদি করে অনেকটা কষ্টের মধ্যেই পড়াশোনা করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এই সংকট কাজে লাগিয়ে সিট বাণিজ্য করছেন ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেত্রীরা। বর্তমানে কলেজটির ছয়টি আবাসিক হলের বেশির ভাগ কক্ষই নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের নেত্রীরা। আসনসংখ্যার বাইরে ও ভেতরে সব শিক্ষার্থীর বেশির ভাগেরই ছাত্রলীগ নেত্রীদের এককালীন ও মাসিক চাঁদা দিয়ে থাকতে হয়। আসনসংখ্যার বাইরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বছরে এককালীন ১৫ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয় নেত্রীদের। বৈধ সিটসংখ্যার বাইরে প্রতিজন থেকে ১৫ হাজার টাকা করে নিলেও ৯ হাজার শিক্ষার্থী থেকে বছরে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়। এই টাকা বাণিজ্য করতে হলের অনেক কক্ষকে পলিটিক্যাল রুম বানিয়েছেন ছাত্রলীগের নেত্রীরা।

কলেজের একাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনটি পদ্ধতিতে ইডেন হলে উঠা যায়। প্রথমত, ছাত্রলীগের পদধারী নেত্রীদের এককালীন টাকা দিয়ে। দ্বিতীয়ত, মাসিক ভাড়া দিয়ে। কেউ কেউ আবার বার্ষিক চুক্তিও করে নেন। তৃতীয়ত, বৈধ পদ্ধতিতে। তবে এ পদ্ধতিতে সিট পাওয়া সহজ নয়। হলের যাবতীয় পাওনা দেওয়ার পরও আবার টাকা দিয়ে নেত্রীদের রেফারেন্সে লিগ্যাল হয়ে রুম পরিবর্তন করে নিতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রী জানান, এ বছরের ১৩ মে কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হলে যাঁরা পদপ্রত্যাশী ছিলেন, কিন্তু নেতা হতে পারেননি তাদের কক্ষগুলো দখল করে নেন সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা এবং সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেত্রী জানান, ইডেন কলেজ প্রশাসন থেকে অনুমোদিত ছয়টি হলে ছাত্রলীগের জন্য বরাদ্দ ১০০ রুম। এর ৫০টির নিয়ন্ত্রণে সভাপতি রিভার গ্রুপ, বাকি ৫০টির নিয়ন্ত্রণে সাধারণ সম্পাদক রাজিয়ার গ্রুপ। তাদের পছন্দের নেত্রীরা দখল করে রেখেছেন এসব রুম। প্রতিটি রুমে ১০ থেকে ১৫ জন করে ছাত্রী থাকেন। যাদের রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেত্রী রুমে তুলে থাকেন।

কলেজে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আরেক নেত্রী বলেন, এটি সত্য। এটা কলেজে ওপেন সিক্রেটের মতো। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পলিটিক্যাল রুমগুলো নিজেদের আয়ত্তে রাখতে চান এবং সিট বাণিজ্য করতে চান।

কলেজ ছাত্রলীগের আরেক নেত্রী বলেন, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছের লোকদের বেশি করে রুম দেওয়া হয়, অন্যরা রুম পান না।

সংঘর্ষের দিন সকালে কলেজের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের সামনে রিভা-রাজিয়ার বিরোধী পক্ষের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রুম বাণিজ্যের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সদ্য বহিস্কৃত কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুস্মিতা বাড়ৈ বলেন, কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পর সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর আমি দেখেছি, ১০০টি পলিটিক্যাল রুমের কথা বলা হলেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অধীনের এরও বেশি রুম রয়েছে। ডিজিএফআই এবং এনএসআইর রিপোর্টে এর সংখ্যা ১২৮টি বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে কলেজ ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা বলেন, আমি যদি ভুল করি, তাহলে সংগঠন আমার বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। অন্য কেউ ভুল করলে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে। আমি সংগঠনের সব সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

সার্বিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ইডেন কলেজের কমিটি হওয়ার পর তাদের মধ্যে ঝামেলা দেখা দিলে কমিটির নেতৃবৃন্দ ও তাদের দায়িত্বে থাকা নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আমরা পার্টি অফিসে বসেছিলাম। তাদের নানা ধরনের নির্দেশনাও দিয়েছিলাম। এর পরও অনেকে কেন্দ্রের নির্দেশ না মেনে এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ আনছে।


সর্বশেষ সংবাদ