৮ বছর ধরে সমাবর্তনের অপেক্ষায় কয়েক হাজার গ্র্যাজুয়েট

 গণ বিশ্ববিদ্যালয়
গণ বিশ্ববিদ্যালয়  © টিডিসি ফটো

দীর্ঘ আট বছর ধরে চতুর্থ সমাবর্তনের অপেক্ষায় সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) কয়েক হাজার গ্র্যাজুয়েট। সর্বশেষ ২০১৪ সালে তৃতীয় সমাবর্তনের পর চতুর্থ সমাবর্তন এখনো আয়োজন করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ সমাবর্তনের অপেক্ষায় থাকা গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীরা। গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দ্রুত সমাবর্তন আয়োজনের দাবি জানিয়েছেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ২৪ বছর ইতিমধ্যে পার করলেও মাত্র ৩টি সমাবর্তন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। ২০১১ সালের ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদের সময় অনুষ্ঠিত হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন। দুই বছর পরও প্রফেসর ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে দ্বিতীয় সমাবর্তন হয় ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট। এরপর আবারও ২০১৪ সালের ২৯ মে প্রফেসর ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদের সময়ই  তৃতীয় সমাবর্তন হয়।

গবির আইন বিভাগ দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ পারভেজ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে সব গ্র্যাজুয়েটের স্বপ্ন থাকে কালো গাউন আর মাথায় হ্যাট পরে আনুষ্ঠানিক সমাবর্তনের মাধ্যমে সনদ গ্রহণ করার। কিন্তু গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত হওয়া হাজারো গ্রাজুয়েটসের সেই স্বপ্ন ঝুলে আছে বিগত ৮ বছর ধরে। নানা জটিলতা ২০১৪ সালের পর আর কোন সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়নি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীরা আশা করে নতুন নিয়োগ প্রাপ্ত উপাচার্য অতিদ্রুত সমার্তনের উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা দিবেন।

আরও পড়ুন: ফেসবুকে ‘ক্ষমা’ লিখে আত্মহত্যা ঢাবি ছাত্রের

সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগ ৫ম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. খাদেমুল ইসলাম বলেন, গায়ে কালো গাউন জড়িয়ে সমাবর্তন পাওয়াটা আমাদের স্বপ্ন। তবে নিয়মিত ভাবে সমাবর্তন না হওয়া এটা প্রশাসনিক ব্যর্থতা। আমাদের সুযোগ-সুবিধার কথা না চিন্তা করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকায় সমাবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবার সময় হয়ে উঠছে নাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসনের। তাই স্বার্থের রাজনীতি বাদ দিয়ে আমাদের সকলের কথা চিন্তা করেই নিয়মিত ভাবে সমাবর্তনের সম্পন্ন করার আহ্বান জানাই।আর সমাবর্তন মানে নবীন প্রবীনের মিলনমেলা। যেখানে প্রশাসনের অন্ধ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বর্তমান সাবেকদের সেতুবন্ধন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান এবং সাবেক শিক্ষার্থীরা যা কর্মক্ষেত্রে অতীব জরুরী।

ফার্মেসি ২৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মেহেদী তারেক জানান, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া প্রতিটি শিক্ষার্থী স্বপ্ন থাকে গাউন আর হ্যাট পরে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাদের শিক্ষাসনদ গ্রহণ করার। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে মাথার হ্যাট আকাশে উড়িয়ে তাদের শিক্ষা জীবনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়। কিন্তু দীর্ঘ আট বছর যাবত গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন না হওয়া এখানে অধ্যায়ন করা শিক্ষার্থীদের সেই আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে দেশের বেশীরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ২-৩ বছর পর পরই সমাবর্তন হচ্ছে সেখানে গণ বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে সমাবর্তনে পিছিয়ে আছে। একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে এটা আমাদের জন্য হতাশার। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি অনেক আগেই অথচ সমাবর্তন না পাওয়া আমাদের জন্য তৈরি করেছে আক্ষেপ। ইউজিসি স্বীকৃত ভিসি নিয়োগসহ নানা প্রশাসনিক যে জটিলতার কারণে এত বছর যাবত গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন হচ্ছিলো না সেসব জটিলতার সমাধান হয়ে গিয়েছে বলে জেনেছি। সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে এখন আমাদের প্রাণের দাবী অতি দ্রুত সমাবর্তন আয়োজনের।

আরও পড়ুন: বাসা-বাড়ির গাছ কাটতে সরকারের অনুমতি লাগবে

ব্যবসায় প্রশাসন ৭ম ব্যাচের শিক্ষার্থী মানসুরা হক রুপা বলেন, সমাবর্তন আমাদের নায্য অধিকার। সমাবর্তন পাওয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের লালিত স্বপ্ন। এটা শুধুমাত্র গাউন আর টুপি পড়ে ছবি তোলা নয় এটার সাথে অনেক সম্মান এবং গর্ব জড়িত। যেখানে দেশের অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছরই সমাবর্তনের আয়োজন করে সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর তো দূরের কথা গত ৮ বছরেও হয়নি সমাবর্তন। দীর্ঘ ২৪ বছরের পথচলায় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন হয়েছে মাত্র তিনবার। ফলে স্নাতক শেষ করা একজন শিক্ষার্থী তার প্রাপ্য সম্মান স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই ব্যর্থতা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। যথাযথ উদ্যোগ আর সদ্বিচ্ছা থাকলে প্রতি বছরই সমাবর্তন আয়োজন করতে পারত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হয়ে এটা আমাদের জন্য যেমন কষ্টের তেমনি লজ্জার। আমাদের একটাই আশা, একটাই চাওয়া আমাদের প্রাপ্য সম্মান স্বীকৃতির সাথে উৎসবমুখর বিদায় চাই।

আইন বিভাগ ৮ম ব্যাচের শিক্ষার্থী এস এম আহমেদ মনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে কখনও মনে হয়নি আমি প্রাইভেট কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। তবে, হতাশার বিষয় হচ্ছে সর্বশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালে। যেখানে প্রায় নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অন্যান্য ছোট-বড় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন নিয়মিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সাথে এ বিষয়ে কম-বেশি প্রতি বছর কথা হলে প্রশাসনের উদাসিনতা এবং উপ- উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি বারে বারে সামনে আসে। ফলে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীদের সাময়িক সনদপত্র নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। বর্তমানে সরকার কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্ত উপ-উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণ করেছে যা নিঃসন্দেহে আনন্দের। আশা করি দ্রুত সমাবর্তনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কার্যত পদক্ষেপ নিবেন এবং আমাদের মত হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের হতাশা কাটিয়ে মূল সনদপত্র স্ব চোক্ষে দেখিবার ভাগ্য প্রদান করে।

আরও পড়ুন: ছাত্রজীবনেই যে সফটওয়্যারগুলোর কাজ জানা উচিত

বাংলা ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মৌসুমী হক বলেন, গত ৮ বছর যাবত সমাবর্তন অনুষ্ঠান হচ্ছে না। আমার মতো আরও অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকে বেরিয়ে এসেছে। অথচ, আমাদের হাতে শুধু রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া কিছু মার্কশিট। এটাই কি আমাদের দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম ও অপেক্ষার ফলাফল! শুধুই একটা মার্কশিট বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া সাধারণ সার্টিফিকেট। এই ধরণের মার্কশিট যা আমাদের মানসিক তৃপ্তি দেয় না।

এছাড়া প্রাক্তনদের কোনো সংগঠন নেই। নতুনদের সাথে পুরাতনদের কানেকশন নেই। হয় না কোনো পুর্নমিলনী এটা হওয়াটা শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট প্রয়োজন।

মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ২৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন বলেন, প্রত্যেক ছাত্রের মনের মধ্যে একটা আশা থাকে পড়ালেখা শেষে সমাবর্তনের মাধ্যমে সার্টিফিকেট গ্রহণ করবে। ৮ বছর ধরে সমাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে একটাই দাবি যতদ্রুত সম্ভব সমাবর্তনের ব্যবস্থা করুন।

আরও পড়ুন: দেশে তরুণদের নিয়ে অবিশ্বাস্য অপরিকল্পনা, ঔদাসীন্য

মেডিকেল ফিজিক্স এন্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ১৪ তম ব্যাচের সাব্বির আহমেদ প্রিন্স বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জীবনে সবচেয়ে বড় চাওয়া হচ্ছে, আনুষ্ঠানিকভাবে একটা কালো গাউন আর সনদ নেয়া। শিক্ষা জীবন শেষ করে যে যার মতো সনদ নিয়ে চলে যাবেন, এটা একজন শিক্ষার্থীর কাম্য নয়। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৮ বছরেও সমাবর্তন হয়নি। ফলে এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এটা অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। শিক্ষার্থীদের এই চাওয়া যৌক্তিক। আমি এখানে নতুন উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েছি। আমি যতগুলো কাজ হাতে নিচ্ছি, তার মধ্যে এটাতে বেশি প্রাধান্য দিব। যেহেতু এটি বেশকিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করতে হয়, সেহেতু দ্রুতই আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণ বিশবিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ছিল না। এখন উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ হয়েছে। উপাচার্যকে নিয়ে একটা মামলা চলছে। এটা নিষ্পত্তি হলে আমরা উপাচার্য প্যানেল পাঠাবো। উপাচার্য নিয়োগ হয়ে গেলে সমাবর্তনের কাজ শুরু করবো।


সর্বশেষ সংবাদ