বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ব্যারাকে পরিণত হলো কীভাবে

ঢাবির হলে ‘ম্যানার’ (আচরণ) সংক্রান্ত ছাত্রলীগের নোটিশ সাঁটানো হয়েছে
ঢাবির হলে ‘ম্যানার’ (আচরণ) সংক্রান্ত ছাত্রলীগের নোটিশ সাঁটানো হয়েছে  © টিডিসি ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলে থাকতে হলে একটি Do's and Don'ts এর লিস্ট পড়লাম। হতবাক হয়ে গেলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো কীভাবে একটি ব্যারাকে পরিণত হলো? এইটাকে কি আর বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কোন আবাসিক হলে স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সিট্ বরাদ্দ দেওয়া হয়না। অথচ সিট্ বরাদ্দের ক্ষেত্রে তাদেরকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের এই অসুবিধাকে পুঁজি করেই ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতারা তাদের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যোগদানের বিনিময়ে হলের গণরুমে তুলেন নবীন শিক্ষার্থীদের। এটাই হলো হাই ওয়ে টু হেল। এই তরিকাতেই আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা মনন যা কিছু ভালো আছে তাকে মেরে ফেলা হয়। আর মেধার এই গণহত্যার দায় প্রশাসনেরও।

শুনেছি এক হলেই আবাসিক শিক্ষকদের বসার ঘরটি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুনেছি আমাদের প্রভোস্টরা নিজেদের মস্তিষ্কে চলেন না। তারা চলেন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মস্তিষ্কে। প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন মিলে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি ব্যারাকে রুপান্তিরত করেছে যা মেধা বিকাশের বদলে মেধা বিনাশে কার্যকর।

অনেক বছর ধরে শুনে আসছি গেস্টরুমে ‘ম্যানার’ (আচরণ) শেখানোর নাম করে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের আইন-কানুন শেখানো হয় হলগুলোতে। কি সাংঘাতিক! কোমলমতি ছাত্রদের স্বাধীনচেতা মনকে এখানেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এই দেশটা যে এখন তোষামোদকারী ও চাটুকারকারিতে ভরে গেছে এইটাতো গত ৩০ বছর ধরে একটু একটু করে বাড়তে থাকা গেস্টরুমে ‘ম্যানার’ (আচরণ) শেখানোর কালচারই দায়ী। প্রশাসন দায়ী এই জন্য যে তারা এইটাকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছে উল্টো অনেক ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে।

আরও পড়ুন: ‘ভাইয়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেকের সময় বামহাত পেছনে রাখতে হবে’—হল ছাত্রলীগের ১৪ নির্দেশনা

গতকাল শুনলাম জিয়া হলের প্রভোস্ট তারই হলের এক ছাত্রকে পুলিশে সোপর্দ করেছে। এইটা আজকের পত্রিকাতেও এসেছে। প্রথমত এর মাধ্যমে ওই প্রভোস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা যখন আবাসিক হলে থাকে তাদের অভিবাবক হলো প্রভোস্ট। সেই প্রভোস্ট কিভাবে একটি দলের হয়ে কাজ করে কোন একটি ছাত্রকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কি লিখেছে সেটাকে ভিত্তি করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে? পরবর্তীতে পুলিশ তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্য প্রমান না পেয়ে ছেড়ে দিয়েছে। অথচ প্রভোস্ট বলেছেন উনার কাছে যথেষ্ট তথ্য প্রমান আছে। মানে কি হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে?

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া মানে ছাত্ররা একটি দলই করতে পারবে, গণতন্ত্র মানে একটি দলের মিটিং মিছিলে যেতে পারবে। আমাদের এখন দাবি হওয়া উচিত বুয়েটের মত দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং ছাত্র রাজনীতি বন্ধ। ছাত্র বা শিক্ষক রাজনীতির নামে যদি এইসব অনাচার হয় তা যে দেশের জন্য কি ক্ষতিকর সেটা আমরা আর কবে বুঝব? ছাত্ররা করবে ছাত্রদের রাজনীতি, ছাত্রদের জন্য রাজনীতি। এরা স্বাধীনচেতা হবে। এদেরকে পুরো আকাশ দেখার অধিকার দিতে হবে। এরা নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকবে। এর মাধ্যমেই লিডারশিপ শিখবে। রাজনীতির মাধ্যমে নয়।
  
যেহেতু সকল কিছুর মুলে হলো আবাসিক হলে সিট্ সমস্যা সেহেতু মাস্টার্সের ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে সিট্ দেওয়া বন্ধ করা উচিত। তাদের বলা উচিত তারা গ্রুপ করে বাহিরে বাসা ভাড়া করে থাকতে। এটাই করা হয় উন্নত বিশ্বে এবং এটা করতে পারলেই মোটা দাগে সকলের লাভ হবে।

সেই ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের বাসা পাইয়ে দিতে সাহায্য করতে পারে। তারা যেন বাসা ভাড়া দিতে পারে সেই জন্য মাস্টার্সের সকল ছাত্রকে টিচিং এসিস্টেন্ট বা ক্যাম্পাস জবের ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত। তাছাড়া মাস্টার্স-এ ভর্তির জন্য পুনরায় ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নেওয়া উচিত। এতে ছাত্র সংখ্যাও কমবে এবং মাস্টার্স কেবল তারাই করবে জরা একাডেমিয়াতে থাকবে। আমরা কি আমাদের নতুন প্রজন্মকে এইভাবে নষ্ট হয়ে যেতে দেব?

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ