উপাচার্য-শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

আবুল বাশার রিপন খলিফা
আবুল বাশার রিপন খলিফা  © টিডিসি ফটো

“লোকে তোমার প্রশংসা করলে খুশি হইও না, লোকে তোমার নিন্দা করলেও দুঃখ পেয়ো না, কারণ লোকের কথায় কয়লা কখনো সোনা হয় না”

প্রকাশভঙ্গির নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজণীয়তা

ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, লক্ষ-উপলক্ষ, চাই সেটা মানুষের হোক আর পশুপাখির হোক, যেমন ধরুন গরু বা ছাগলের হোক, তার জন্য নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। প্রশ্ন হল পশুপাখিদেরও কি ইন্দ্রিয়গত বিষয়গুলি আছে? একেবারে নাই বললে তা অযৌক্তিক, কিছুটা তো আছে যেটা তারা বুদ্ধি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে।

গরু, কুকুর, বিড়াল অন্যান্য প্রাণীকে লাঠি দেখালে ভয় পায়, আগুন দেখলে পালিয়ে যায়, এর দ্বারা বুঝা যায় তাদেরও কিছু না কিছু অনুভূতি কাজ করে। পার্থক্য হল সে নিজের থেকে ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারেনা। আশা-প্রত্যাশা এগুলো কোন কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না এবং ভাষার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে পারে না। এটাই ওদের দুর্বলতা।

কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন, সে অন্তর দিয়ে সব ইন্দ্রিয়গত বিষয়গুলো সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ করে। মন থেকে উৎপত্তি হয় আর সে অনুযায়ী বুদ্ধিকে ব্যবহার করে। নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পশুরা অনেকটা পরাধীন, অন্যের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষ নিজের উপরই নির্ভরশীল।

যেমন গরুকে গৃহস্থ নিয়ন্ত্রণ করে, গোয়াল ঘরে আটকে রাখে, গলায় দড়ি লাগিয়ে বেঁধে রাখে। তা না হলে অন্যের ক্ষেতে ঢুকে পড়বে, ফসলের ক্ষতি করে। অন্যের ক্ষেতে ঢুকে কিছুক্ষন হয়তো খাবে, কিন্তু এরপর ক্ষেতের মালিক আসবে, ওকে ধরে মারবে, গরুর বা ছাগলের মালিক কে ডাকবে, কখনো কখনো গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে গরুর বা ছাগলের নয় বরং ওদের মালিকের বিচার করবে।

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যদি এভাবে আরও কয়েকদিন করতে থাকে, তাহলে হয়ত একদিন তাকে জবাই করে খেয়েই ফেলবে অথবা বাজারে বিক্রি দিয়ে করে দেবে। পশুদের নিজ স্বার্থেই তাকে বেঁধে রাখতে হয়। তার নিরাপত্তা মূলত তার ওই গৃহস্থের নিয়ন্ত্রণে অথবা মালিকের নিয়ন্ত্রণে থাকার মধ্যে।

দুনিয়াতে যত জীবজন্তু আছে, তাদেরকে কোন না কোনভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয়। আর এই নিয়ন্ত্রণ থেকে যখনই সে বের হয়ে যায়, তখনই বিপদে পড়ে। ঠিক তেমনি একজন শিক্ষকের চিন্তা-চেতনা, তার অনুভূতির প্রকাশ, তার লেখনীর প্রকাশভঙ্গি, তার কথা বলার ভঙ্গিমা, এমনকি তার লেখনীর ভাষার নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনও রয়েছে। যদি নিয়ন্ত্রিত হয় তবে সমাজ সুন্দর শিক্ষা নিতে পারে। আর যদি অনিয়ন্ত্রিত হয় তবে তা প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই পুরো সমাজের মধ্যে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়।

যার একটা উদাহরণ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সকলে দেখতে পাচ্ছি। যারা একটি জাতি গঠন করবে আর যারা জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরী। তা না হলে জাতি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে, বিফলতার আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।

জঙ্গলের হরিণকে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে না হলেও (অন্ততঃ) সতর্ক, বিচক্ষণ থাকতে হয়। তা না হলে বাঘের খাবার হয়ে যাবে। নিজের জীবন দিতে হবে। কিন্তু এই হরিণ যদি কারও অধীনে চলে আসে, তাহলে বাঘের ভয় নেই। যেমনটা পৃথিবীর বিভিন্ন চিড়িয়াখানার হরিণের নেই। কারণ যার অধীনে সে চলে এসেছে, সে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে এটাই তো স্বাভাবিক ছিল। থাকলে তাদের জীবন নিরাপদ। কিন্তু প্রশ্ন হল কোন শিক্ষক যখন একটি বিশেষ চেয়ারে বসে যান আর বাঘের মতো আচরণ করেন তাহলে শিক্ষার্থীদের জীবন এর নিয়ন্ত্রণ ব্যহত হয়, এটা বাস্তব সত্য। আর নিয়ন্ত্রণ মানেই হচ্ছে, সে তার নিজের ইচ্ছে মত নয়, বরং যে নিয়ন্ত্রণ করছে তার ইচ্ছে মত চলবে।

তদ্রূপ একজন শিক্ষককে অথবা একজন শিক্ষার্থীকে নিজস্ব সত্ত্বাগুনে নিয়ন্ত্রণ করা এবং নিয়ন্ত্রণ হওয়া প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনি কোনো বিয়ের দাওয়াতে অথবা অন্যকোন দাওয়াতে পরিবারসহ গিয়েছেন। নানান ধরনের খাবার সামনে দেয়া হয়েছে। ছোট বাচ্চা ছটফট করে এইটাতে হাত দিতে চায়, ঐটাতে হাত দিতে চায়। তার মা অথবা বাবা তাকে সামলে রাখে, নিয়ন্ত্রণ করে।

তার মা অথবা বাবা যদি তাকে না সামলায়, নিয়ন্ত্রণ না করে তাহলে বাচ্চা জিনিস নষ্ট করবে। আর জিনিস যদি নষ্ট করে, তাহলে সবাই ওর ওপর বিরক্ত হবে। কিন্তু যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে জিনিস নষ্ট করবে না, সবাই তাকে আদর-যত্ন করে খাওয়াবে। বাচ্চার মা-ও যদি খেতে চায়, খেতে পারবে। আর এটাতে-ওটাতে হাত দিলে, প্লেট ভাঙবে, এতে নিজেরও খাওয়া হবে না। তাই তার মা বাবা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, এলোপাথাড়ি হাত দিতে দেয় না। বরং তার মা বাবা উপলব্ধি করে যে, ও কোনটা পছন্দ করে, আর সেটা তাকে পরিমিতভাবে খাওয়ায়।

ছোট বাচ্চা যেরকম, তার খাওয়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, বড়দেরও ওইরকম ইচ্ছাশক্তি এবং প্রকাশভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসককে, একজন শিক্ষককে তার চিন্তাশক্তি এবং তার প্রকাশ করার ভঙ্গি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেননা তার একটি কথার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে, একটি সমাজের মাঝে, সমগ্র দেশের মাঝে, সর্বোপরি বিশ্বমানবতার সামনে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সম্পর্ক, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিকে এক অস্থির প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দিতে পারে।

যেটা একটি জাতিকে ভবিষ্যতের জন্য অনিয়ন্ত্রিত ক্ষতির মুখে পরতে বাধ্য করবে। সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে জীবনকে যাপন করার বিধান দিয়েছেন, যেটাকে আমরা ধর্মীয় গ্রন্থ হিসাবে মেনে থাকি। আর এই জীবনযাপন মানেই হচ্ছে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করা। আর আমার এই নিয়ন্ত্রণ আমার নিজের স্বার্থেই করা।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, গরুকে যেরকম গৃহস্থ নিয়ন্ত্রণ করে, এতে গৃহস্থের স্বার্থও আছে, গরুর স্বার্থও আছে। বিনা নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিলে, ওকে যে কেউ ধরে নিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলতে পারে। একজন ভাইস-চ্যান্সেলরকেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আর আইনের মধ্যে থেকে তিনি কি বলতে পারবেন, কি বলতে পারবেন না, তিনি কি করতে পারবেন ,আর কি করতে পারবেন না তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাই সরকারের নীতিনির্ধারক মহল আইনানুগভাবে যখন থেকে কাউকে নিয়োগ প্রদান করবেন তার কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণেরও ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

নিজ গুনে মূল্যবান হওয়া

সৃষ্টিকর্তা দুনিয়ার মানুষকে ডাকছেন সুন্দর সভ্য, এবং শুদ্ধ জীবনের দিকে। আর মানুষ দৌড়াচ্ছে দক্ষতার আর ক্ষমতার দিকে। জীবনকে যদি সে শুদ্ধ করতে পারে তাহলে সৃষ্টিকর্তা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাকে ইহলোকে ভাল জীবন দেবেন এবং পরলোকেও ভাল জীবন দেবেন। প্রত্যেকেই নিজেকে মূল্যবান বানাতে চায়, আর বড় ভুল পদ্ধতিতে, শুদ্ধতা নয়, দক্ষতা দিয়ে। দক্ষতার দ্বারা তার নিজের জীবন ‘মূল্যবান’ হয়না, বরং সে মূল্যবান জিনিসের ‘প্রস্তুতকারী’ হয়।

একজন কামার লোহাকে গলিয়ে বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র, পাত্র বানায়। সে যদি দক্ষ কামার হয়, তাহলে সে শুদ্ধ, খুব সুন্দর আর নিখুঁত অস্ত্র বানাতে পারবে, কিন্তু এতে সে নিজে শুদ্ধ হয়না; শুদ্ধ মানুষ হয়না। সে হচ্ছে দক্ষ; ‘দক্ষ কামার’ হচ্ছে। ওর কীর্তি শুধু শুদ্ধ জিনিস বানানো, যার মূল্য বড় সাময়িক।

এমন অনেক কিছুই আছে যা নিজগুনেও মূল্যবান হয় আর উৎপাদনের গুণেও মুল্যবান হয়। ফুল-ফল নিজ গুণে নিজ দাবিতে মুল্যবান, আর গোবর উৎপাদনের গুণে মূল্যবান। কৃষকরা গোবরকেও মুল্য দিয়ে কিনে, গোবরেরও মূল্য আছে। তো গোবরের যে মূল্য আছে, সেটা তার নিজ গুণে নয় যে, এর গন্ধ ভাল, সুন্দর, এইজন্য কেউ গোবর কিনে না। বরং গোবর এজন্য কেনা হয় যে, এটা সুন্দর ফুল উৎপাদনের সহায়ক। ফুলকে যে কেনা হয়, এটা তার নিজ গুণের কারণে কেনা হয়। আসুন না আমরা সবাই নিজ গুণে গুণান্বিত হই।

পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত যত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম, বড় বড় মনীষীগণ, ধর্ম গুরু এসেছেন; ধর্মের মূলবাণী, ধর্মের মূল যে পথ তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন সেই পথে চলার, অনুকরণ ও অনুসরণ করার মাধ্যমে একজন মানুষ নিজ দাবীতে মূল্যবান, শুদ্ধ ও সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে পারে, যা সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট।

অন্যদিকে শুধুই বস্তুবাদী শিক্ষা, বস্তুবাদের ধারণা যেটাকে আমরা যোগ্যতার বিচারে ধরে নিতে পারি দক্ষতার পথ যা তাকে শুদ্ধ উৎপাদনের সহায়ক বানায়। যতদিন পর্যন্ত ওই উৎপাদন আছে, ততদিন পর্যন্ত তার মূল্য আছে। গোবরের মূল্য সবার কাছে নয়, শুধু কৃষকের কাছে, তাও আবার তার চাষের মৌসুমে। যখন কৃষকেরও মৌসুম পার হয়ে যাবে, যখন আর সারের দরকার পরবে না, তখন তার কাছেও সেই গোবরের আর কোন মুল্য নেই। কিন্ত ফুল-ফল এগুলো সবার কাছে সবসময় মূল্যবান।

কর্মদক্ষতা ও শুদ্ধতা

একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার তার কর্মদক্ষতার গুনে বাড়ি নির্মাণ, ব্রিজ নির্মাণ অথবা রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য মানুষের কাছে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। একজন দক্ষ ডাক্তার শুধুমাত্র রোগীর কাছে মূল্যবান, যতদিন পর্যন্ত সে রোগী। অন্যদিকে, একজন শুদ্ধ মানুষ সবার কাছে সবসময় মূল্যবান। এই জন্যে পূর্বে উল্লেখিত বিশিষ্ট মনীষীগণ যে পথ এনেছেন; এ পথে যারা মূল্যবান হয়, তারা তখনও মূল্যবান ছিলেন, আজও মূল্যবান। এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত মূল্যবান থাকবেন।

উল্লেখ্য যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু, হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ সব সাহাবাগণ তখনও মূল্যবান ছিলেন, আজও মূল্যবান, আর ভবিষ্যতেও থাকবেন। উনারা যে পথ দেখিয়ে গেছেন, সে পথ আজও আমাদের জন্য বড় অর্থপূর্ণ। উনাদেরও অনেকের অনেক দক্ষতা ছিল। কেউ ভাল যোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু ওই দক্ষতার মূল্য আজ শেষ হয়ে গেছে। এখন আর আমরা কেউ তীর দিয়ে যুদ্ধ করি না। সাহাবারা কেউ যদি বড় দক্ষ যোদ্ধা হয়েও থাকেন, বর্তমান সময়ে সেই দক্ষতার মূল্য নেই, কিন্তু উনাদের সেই শুদ্ধতার মূল্য আছে এবং থাকবে।

যে নিজেকে শুদ্ধ বানাতে পারবে, তার জীবন ধন্য হবে। বিভিন্ন সভ্যতার ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই যে পুরো দুনিয়াতে শিক্ষার খুব চর্চা আছে, কিন্তু গোটা দুনিয়ার প্রতিষ্ঠিত প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিরই একটা বড় দূর্বলতা যে, শিক্ষার লক্ষ্যই হচ্ছে দক্ষতা, শুদ্ধতা নয়। আর মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে শুদ্ধতার প্রয়োজন।

জাতিসংঘের মহাসচিব, একটি দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, একজন ভাইস চ্যান্সেলর অথবা একজন শিক্ষক, একজন রাজনীতিবিদ,সমাজের যে কোন দায়িত্বে থাকেন না কেন সবার জন্য শুদ্ধতার প্রয়োজন সবসময়ই রয়েছে। অর্থলিপ্সা অনেক সময় মানুষকে অধঃপতনের দিকে নিয়ে যায়। একজন গরীব মানুষ, তার কোন সম্পত্তি নেই, মামলা-মোকাদ্দমা নেই, ট্যাক্স নেই, সন্ত্রাসী নেই, চাঁদাবাজি নেই, কিছুই নেই। ফকিরের কাছে কোন চাঁদাবাজ যাবে? কোন ট্যাক্স ওয়ালা যাবে? এই ধরনের সমস্যা তার নেই।

কিন্তু একটা সমস্যা তার আছে। সেটা হল- সে যা ইচ্ছা তাই কিনতে পারেনা। এই সমস্যাটা তার আছে। বাকি অনেকগুলো সমস্যা থেকে সে বেঁচে গেছে। সে চায় তার অনেক টাকা হবে, আর দুশ্চিন্তামুক্তও হবে, এই দু’টো একসাথে হওয়া সম্ভব নয়। হয় অনেক টাকাওয়ালা হও, আর দিন-রাত দুশ্চিন্তায় থাকো। আর না হয় ফকির হও, আর চিন্তা মুক্ত হও।

ফকিরের কোনো চিন্তা নাই। ওর কিসের চিন্তা? ওর পকেট কে মারবে? ওর পকেট থাকলে না পকেট মারবে। বরং পকেটমার যে, সেও ফকিরকে কিছু টাকা দেয়। অনেক জায়গা থেকে পকেট মারে, আর ফকিরকে সেও কিছু দেয়। ওর পকেট কেউ মারে না। কিন্তু এই ফকিরই যখন বিরাট ধনী হয়ে যায়, তখন তার পেছনে পকেটমারেরা পড়বে। সম্পদ আর সম্মান এই দুই জিনিস সবসময় বিপরীতমুখী।

একজন ভাইস চ্যান্সেলর যদি সম্মান চান তাহলে তিনি সম্মানিত থাকবেন কিন্তু যখন সম্পদের লোভ এসে যায় তখন তার সম্মান অনেক সময় বিলীন হয়ে যায়। আমাদের সামনে অনেক নজির রয়েছে , বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যা প্রমাণিত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতির কারণে অনেক উপাচার্য মহোদয় অপদস্থ হয়েছেন, এমনকি কারাগার পর্যন্ত যেতে হয়েছে। যেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান থেকে জাতি শিক্ষা নেবে, তিনি যদি কারাগারে যান তাহলে জাতি তার কাছ থেকে কি শিক্ষা নিতে পারে!

অবাস্তব চাওয়া ও বাস্তবতা

আমাদের চাওয়াগুলো অবাস্তব। একদিকে চাইবো যে, বিরাট ধনী হয়ে যাবো, অপরদিকে চাইবো যে, আমার যেন কোনো চিন্তা না থাকে। কিন্তু ‘ধন’ আর ‘চিন্তা’ তো একসাথে চলে আসবে। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটাকে নেয়া যাবে না। টাকার যেমন এপিঠ আছে, ওপিঠ আছে। টাকার একদিকে ধানের ছবি, আরেকদিকে মসজিদের ছবি। মসজিদের ছবি নিবো, কিন্তু ধানের ছবি নিবো না, তা তো আর হয় না। ওটা চলে আসবে। পুরো দুনিয়ার মানুষের সমস্যা-তার ইচ্ছা হয় একটা, পায় আরেকটা। সে বাচ্চা হোক, আর বুড়ো হোক। রাজা হোক বা প্রজা হোক, শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিত হোক, শিক্ষক বা শিক্ষার্থী হোক, রাজনীতিবিদ হোক আর রাজনৈতিক কর্মী হোক।

মানুষের যত কষ্ট, সব কষ্টের মূল হচ্ছে- কোন একটা ইচ্ছা, যেটা পূরণ হচ্ছে না। তো তার ইচ্ছা রাজা হবে, কিন্তু হয়েছে বেচারা রিকশাওয়ালা। ইচ্ছা ছিল রাষ্ট্রপতি হবেন, হয়েছেন সচিব, ইচ্ছা ছিল উপাচার্য হবেন কিন্তু হয়েছেন ট্রেজারার, ইচ্ছা ছিল প্রক্টর হবেন কিন্তু হয়েছেন সহকারি প্রক্টর, ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন কিন্তু হয়েছেন স্কুল অথবা কলেজের শিক্ষক। এই যে চাইলাম কিন্তু হলো না, আর এই জন্য পেরেশান। আর চাইলে যদি হয়ে যেতো, তাহলে যে খুব ভালো হতো, তাও নয়।

আরও পড়ুন: ‘অপরাজিতা পুরস্কার’ পেলেন জাবি উপাচার্য

কোন এক বক্তব্যে প্রফেসর মুশফিকুর আহমেদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছিলেন, আমার এক নাতি; বোনের নাতি সেই হিসেবে আমারও নাতি, যখন ছোট ছিলো, তখন ওদের বাসায় তিন তলার ছোট বারান্দার রেলিং এর উপর উঠেছিল। আর রেলিং এর উপর উঠে ওখান থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে তিন তলার উপর থেকে নীচে জাম্প দেবে। নীচে দারোয়ান আছে, লাফ দিয়ে দারোয়ানের কোলে পড়বে-ওরকম তার প্ল্যান। তো ওর মা তখন তাকে দেখে ফেলে। খুব সতর্ক হয়ে আস্তে আস্তে করে ওকে ধরে ফেলে। ওর ইচ্ছা তো 'খুবই সুন্দর ইচ্ছা' যে, তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়বে।

কারণ টিভিতে দেখছে বোধহয় যে, উড়ে উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে যে ওরকম ওড়া যায় না, ঐ জ্ঞান তার নেই। কেউ দেখেছে যে, টিকটিকির মতো দেয়ালে মানুষ হাটে। তো সেও হাঁটতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা তাকে মানুষ বানিয়েছেন, টিকটিকি বানাননি। তো টিকটিকির মতো উল্টো হয়ে কেন যেতে পারে না, এজন্য তার মন খারাপ; কান্নাকাটি। তো বাচ্চাদের এ জাতীয় সমস্যা বড় হওয়ার পর আর থাকে না। তার মানে এটা নয় যে, বড়দের কোন চিন্তা-কল্পনা নেই। আছে, সেটা অন্যখানে। আর সেগুলোও কম অবাস্তব নয়। স্পাইডারম্যান হতে পারলো না কেন, এ জন্য বাচ্চার খুব দুঃখ। টিকটিকির মতো হাঁটতে পারছে না বলে তার খুব মন খারাপ। (অন্যদিকে) ওর বাবারও মন খারাপ।

বাবা ওরকম টিকটিকির মতো হাঁটার চিন্তা করে না, কিন্তু তার মন খারাপ এই জন্য যে, সে বিলাসী শিল্পপতি হতে চেয়েছিলো, কিন্তু এখনো হতে পারেনি। তার একটা অবাস্তব চিন্তা, যা বাস্তবায়িত হয়নি; হবারও নয়, (কারণ) আল্লাহ তা'আলা তার কিসমতে রাখেননি। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে মানুষের মতো বানিয়েছেন, টিকটিকির মতো বানাননি যে, টিকটিকি দেয়ালে হাঁটতে পারে বলে আমিও পারবো।

মানুষের মেনে নেয়া উচিত যে, আল্লাহ তা'আলা আমাকে টিকটিকি বানাননি, আমি মানুষ হয়েছি। আমাকে মানুষের মতো মেনে নিতে হবে। ঐ টিকটিকির মতো ইচ্ছা করে আমার কোন লাভ নেই। ফকিরকেও মেনে নেয়া দরকার যে, রাজার মতো ইচ্ছা করে আমার কোন লাভ নেই। রাজাকে আল্লাহ রাজা বানিয়েছেন, রাজার মতো থাকবে। আল্লাহ তা'আলা আমাকে ফকির বানিয়েছেন, আমি ফকিরের মতো থাকবো। খারাপ কোনটাই না।

মানুষের যতো ইচ্ছা থাকে, এগুলোর বড় অংশ অবাস্তব! এগুলো যদি (পূরণ) হতো, তাহলে বড় মসিবত হয়ে যেতো। এই যে বললাম-বাচ্চা তিন তলার রেলিং-এ যেয়ে লাফ দেয়ার চেষ্টা করছে। লাফ দিতে পারলে কী হতো? ভাগ্যিস লাফ দিতে পারেনি! আমরা বড়রা যারা আছি, আমাদের মনেও বহুত কিছু চায়। যেসব জিনিস মনে চায়, ওগুলো যদি হয়ে যেত, তাহলে 'লাফ দেওয়ার' মত অবস্থাই হতো। আল্লাহ তা'আলা কোনভাবে আটকিয়ে রেখেছেন। করতে পারলে মসিবত হয়ে যেতো। (অথচ) ভাবছি বড় ভাল হতো।

বাচ্চাটাকে যখন তার মা ধরে ফেললো আর লাফ দিতে পারলোনা, এজন্য তার খুব মন খারাপ। 'বিরাট একটা কাজ' করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত হলো। আমরাও আমাদের তকদীরের কারণে অনেকগুলো কাজ করতে পারিনা। মনে হয়-করলে কতই না ভালো হতো! কিন্তু আসলে তা নয়। মানুষের ইচ্ছা যেগুলো থাকে, সেগুলো উপর থেকে লাফ দেবার মতই অবাস্তব জিনিস।

এই ধরুন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়তোবা চেয়েছিলেন নিজেকে সেভ করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করতে। আর পুলিশ ও হয়তোবা চেয়েছিল তাদেরকে সেভ করতে, জানিনা যদি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয় তাহলে প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে। নিশ্চয়ই যাওয়ার অনুভূতির মধ্যে কোন গরমিল অবশ্যই রয়েছে তা না হলে ফলাফল কখনোই এমনটি হতে পারেনা যা বিশ্ব দরবারে আমাদের শিক্ষক ছাত্র, এমনকি বাঙালি জাতি হিসেবে লজ্জাজনক এক পরিস্থিতিতে আজ দাঁড় করিয়েছে।

অনুভূতির পরিচর্যা

অনুভূতির পরিচর্যা করারও প্রয়োজন আছে। "মানুষকে আল্লাহ তাআ’লা অনুভূতি দিয়েছেন। মানুষ যদি তার অনুভূতি হারায়, ঐটা তার সবচেয়ে বড় হারানো। কারও কাছে শুনেছিলাম একজন পেশাদার খুনির কথা। কাউকে খুন করবার জন্য তাকে নিয়োগ করা হয়েছে। সে খুন করে এসেছে। এসে বাথরুমের মধ্যে জামা কাপড় পরিবর্তন করেছে। যে রক্ত টক্ত লেগেছিল, সেগুলো ধুয়েছে। তারপর মুছে টুছে বিছানায় শুয়ে দিব্বি ঘুমিয়ে গেল! ঘুমোতে বেশিক্ষণ লাগেনি; গভীর নিদ্রা। তো ও যে খুন করলো, একটা অন্যায় খুন; নিঃসন্দেহে একটা জঘন্য অপরাধ।

আরও পড়ুন: পাঠক্রম অনুযায়ী ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা: উপাচার্য

কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি জঘন্য; ওর ঘুমাতে পারা। ওর ঘুমাতে পারা, এটা এই দেশের সরকারি আইনে কোন অপরাধ নয়। শরীয়তের আইনেও এটা ধরবে না। ওর হত্যা করাকে ধরবে। কিন্তু ওর একজন নিরপরাধ মানুষকে সামান্য কয়টা টাকার জন্য অথবা যেকোন কারণে হত্যা করা আর ফিরে এসে তার ঘুমের কোন ক্ষতি হলোনা, পেট ভরে খেতে পারলো আর আরামসে ঘুমিয়ে গেল; এটা হত্যা করার চেয়ে অনেক বড় অপরাধ।

এটা ওর সবচেয়ে বড় জিনিস হারানো। ওর ভিতর থেকে, একটা মানুষ যে ছিল, একেবারেই নিঃশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তার কোন চিহ্নই বাকি নেই। একটা মহিলার গলা থেকে হার ছিনতাই করার সময় ঐ মহিলা বাঁধা দিয়েছে। তো ছুরি মেরে দিয়েছে। সে মহিলাটা মরে গেছে। পত্রিকাতে খবর এসেছে, তার তিনটা ছোটছোট বাচ্চা। তারমধ্যে সব ছোটটা দুধ খায়। এই কথা গুলো ঐ ছিনতাইকারীকে কেউ বলল। ও হেসে উড়িয়ে দিল। ওর ছিনতাই করা, হত্যা করা যত বড় অপরাধ, এরচেয়ে অনেক বেশি অপরাধ হল ওর এই ব্যাপারে কোন অনুভূতিই না থাকা; এটা যদিও কোন আইনের আওতার মধ্যেই আসে না।

এটা ওর সবচেয়ে বড় হারানো যে, ওর কোন অনুভূতিই নেই। এর মোকাবিলায় একজন ‘মানুষ’, আল্লাহ তাআ’লা তাকে উন্নত অনুভূতি দিয়েছেন। অনুভূতি যদি শুদ্ধ হয়ে যায়, তবেই আসলে একজন মানুষ শুদ্ধ। আর তার অনুভূতিই যদি নষ্ট হয়ে যায় বা বিকৃত হয়ে যায়, তাহলে তার ঐ ক্ষতি বড় ধরণের ক্ষতি; সে তো কিছু বুঝবেই না!

মিথ্যার আশ্রয় হত্যা নয়, আত্মহত্যা

বহুদিন আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম "আমেরিকায় বেশ কয়েক বছর আগে এক লোক একটা নিজস্ব মতবাদ বানিয়েছে, তার বেশ কিছু অনুসারীও পেয়েছে, প্রায় ১০০০ লোক। এদেরকে নিয়ে সেন্ট্রাল আমেরিকার ছোট একটা কলোনিতে গিয়ে বসবাস করতে আরম্ভ করেছে। তার কথা চালায়। এক পর্যায়ে কোন বে-আইনি কাজ করেছে। গোয়েন্দারা এসেছে আক্রমণ করার জন্যে। যখন অবস্থা বেগতিক দেখেছে, সে তার ১০০০ লোকসহ আত্মহত্যা করেছে। হত্যা নয়, আত্মহত্যা! ১০০০ লোক হত্যা করেছে- তাতো বুঝা যায়, কিন্তু ১০০০ লোক নিয়ে আত্মহত্যা করেছে, পরিবারসহ।

বিরাট পাত্রের মধ্যে পটাসিয়াম সায়ানাইড সলিউশন করেছে, সবাইকে বলেছে এগুলো খাও। মায়েরা বাচ্চাদেরসহ ওখানে কলোনিতে ছিল। সিরিঞ্জের মধ্যে নিয়ে বাচ্চাকে ইনজেকশন দিয়েছে, নিজে ইনজেকশন নিয়েছে। আর এরকম করে ১০০০ লোক একসাথে সব মরেছে। তো মানুষ এমন ধরনের, যে তাকে যদি ভাল করে বুঝাতে পারে, বলতে পারে, তো তাকে দিয়ে আত্মহত্যা করানো যায়, মাকে দিয়ে তার শিশুকেও হত্যা করানো যায়।

একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে দিয়ে এমন অনেক ক্ষতিকর কাজও করাতে পারেন, আবার ভালো কাজও করাতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায় অনেক স্বনামধন্য শিক্ষক তার সাংবাদিক ছাত্রদের মাধ্যমে অন্য শিক্ষকের ব্যক্তিগত জীবনকে একেবারে অতিষ্ঠ করে তোলেন সম্পূর্ণ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে। উদ্দেশ্য নিজেকে উক্ত শিক্ষকের স্থানে নিয়ে যাওয়া হতে পারে সেটা পোস্ট-পজিশন।অনেক ধর্মগুরুও অনেক সময় মানুষকে বিপথে নিয়ে যায় আস্থার সম্মোহনী অবস্থা তৈরি করার মাধ্যমে। গোটা খ্রিস্টান জগত পাদ্রীর কথামত চলছে।

আজ থেকে সম্ভবত নয়শত বছর আগে খ্রিস্টানদের যে প্রোটেষ্ট্যান্ট ধর্ম আরম্ভ হল তার আগের কথা। যে ভিত্তির উপর ক্যাথলিক থেকে প্রোটেষ্ট্যান্টরা বের হয়ে গেল, তার মধ্যে বড় একটা অংশ ছিল যে, পাদ্রীরা গির্জাতে বেহেশতের সার্টিফিকেট বিক্রি করত। আমাদের সমাজেও আমরা অনেক সময় দেখতে পাই অনেক মুসলিম দরবেশ বা পীরদের কথার উপর ভিত্তি করে অনেক মানুষ তাদের সম্পদ তাদের টাকা পয়সা তার পীরের কাছে অথবা দরবেশের কাছে সর্বস্ব সমর্পণ করে। এই কিছুদিন আগে ভারতে আপনারা দেখেছেন রাম রহিম নামে একজন ধর্মগুরু বেরিয়েছিল যিনি নবী দাবি করেছিন মেসেঞ্জার অফ গড দাবি করেছেন।

তার ভন্ডামীর ফলাফল আমরা দেখলাম, তার তিন কোটিরও বেশি ভক্ত রয়েছে এবং তাদের সর্বস্ব তার কাছে সমর্পণ করতে একটুও চিন্তা করে নাই। তো মানুষ কিরকম বোকা, কাগজে লিখা, পাদ্রীর সাইন করা সার্টিফিকেট, ঐটা দিয়ে সে মনে করে বেহেশত, স্বর্গ বা জান্নাত পেয়ে যাবে! কিন্তু এক-দুইজন নয়, লাখো-কোটি মানুষের কাছে বিক্রি করেছে, প্রচুর টাকা উপার্জন করেছে। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে করে ওরা চিন্তা করতে লেগেছে যে, ‘কী কিনলাম’?

অনেক সময় ছাত্র বা শিক্ষার্থীরাও প্রতারিত হন তার শিক্ষকের সম্মোহনী বক্তব্যের মাধ্যমে, সাময়িক সময়ের জন্য তাদের চিন্তাশক্তি, উপলব্ধি করার শক্তি অনেক সময় চাপা পড়ে যায় ।অনেক সময় শিক্ষার্থীরা ভুলে যান শিক্ষকের সাথে কেমন সম্পর্ক থাকা উচিত, আর শিক্ষকরা তাদের বিশেষ চিন্তাশক্তির ক্ষমতাবলে তাদের ছাত্রদেরকে বা শিক্ষার্থীদের কে বিপথে ঠেলে দেয় যেটা কখনো কাম্য নয়।

শিক্ষক এবং ছাত্রের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত? সম্পর্ক আরও ভালো করতে হলে উভয়পক্ষকে কী কী নিয়ম মেনে চলতে হবে? ছাত্র শিক্ষককে শ্রদ্ধা করবে। ভালোবাসতে হবে। ভালো না বাসলেও ঐ শিক্ষক অবস্থানটার জন্য শ্রদ্ধা তাকে করতে হবে। কিন্তু নুয়ে পড়লে চলবে না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে, স্কুল কলেজ পর্যায়ে বিভিন্ন সময় আমরা দেখতে পাচ্ছি কোন শিক্ষক তার ছাত্রীকে বলছেন তার সাথে একা একা দেখা করতে, কথা আছে বলে তাকে বিভিন্ন জায়গায় দেখা করার জন্য বাধ্য করছে।

অনেক সময় পরীক্ষার মার্ক কমিয়ে দিবে অথবা ফেইল করিয়ে দেবে এই ভয় এবং আশাকে পুঁজি করে শিক্ষার্থীকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেটা শিক্ষক সমাজের জন্য বড়ই লজ্জাকর, ঘৃণিত। আমি ব্যক্তিগতভাবে এধরনের শিক্ষকদের প্রতি সংক্ষুব্ধ, লজ্জিত, নির্বিকার কিন্তু নির্বিকার থাকলেতো আর চলে না সেজন্য আজ লিখতে বসেছি কিছু কথা। কারণ আমরা জানি আমরা যাঁকে লিখছি, তাঁর পা ধরে কিছু চাইছি না। ছাত্রের নিজের আত্মসম্মানবোধও থাকতে হবে, আবার এমন আত্মসম্মানবোধ না যে শিক্ষক কটু কথা বললে মন খারাপ করে থাকতে হবে।

শিক্ষাদান ক্ষমতাকে কি বিচার্য বিষয়?

শিক্ষকদের শিক্ষাদান ক্ষমতাকে বিচার করবে শিক্ষার্থীরা। হ্যাঁ স্যার, জি স্যার বলে যাওয়া শিক্ষার্থীর কাজ না। শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীরা তাদের বর্তমান নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করবে। অযথা কোনো বাধা থাকবে না। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝখানে যৌক্তিক দূরত্ব সৃষ্টি হবে আর যৌক্তিক দূরত্ব এক সময় না এক সময় ঘুচে যাবে। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক হবে দেয়া-নেয়ার। দুজনই দুজনকে দেবে, অথবা দুজনই দুজনের থেকে নেবে।

একজন শিক্ষকের পক্ষে সবজান্তা হওয়া সম্ভব না, কারণ সে একজন মানুষও বটে। বিশ্ববিদ্যালয়ই একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরি করতে মুখ্য এবং সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয় শিক্ষককে। শিক্ষক-শিক্ষিকা শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়ের মতো। বাবা-মা যেমন সন্তানদের তাদের ভালোবাসা-স্নেহ-মমতা দিয়ে বড় করেন, ঠিক তেমনি শিক্ষকেরা শিক্ষার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য যৌক্তিক চিন্তাশক্তি এবং মেধার সর্বস্ব নিয়োগ করবেন। সাথে সাথে থাকতে হবে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা। তাঁদের শিক্ষার আলো যেমনি শিক্ষার্থীদের সামনের পথ চলাকে সুদৃঢ় করে, তেমনি তাদের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে।

আরও পড়ুন: সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেব: শাবি ভিসি

মাননীয় উপাচার্য (শিক্ষক হিসেবে) হচ্ছেন লোকোমোটিভ রিসোর্সঃ ‘Teachers are like locomotive resource centers where students can go for support. So teachers must be ready for conversations with students. Teachers can teach new learners how to use crucial resources’.

মানুষকে আলোকিত করেন

শিক্ষক হচ্ছেন শিক্ষা প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে এগিয়ে নেয়ায় অনুপ্রেরণাদানকারী ব্যক্তি। জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের অংশগ্রহণ মানুষকে আলোকিত হতে সাহায্য করে। কোনো বিষয় চর্চা বা অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষক ধারণা ও জ্ঞান অর্জন করে এবং ঐ জ্ঞানের জ্যোতির দ্বারা নিজে আলোকিত হতে ও সমাজকে জ্যোর্তিময় করতে সহায়তা করে। শিক্ষকের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই শিক্ষার্থীর মন-মনন, মানসিক উৎকর্ষ সাধন হয়, আচার আচরণ, মন ও আত্মার ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন ঘটে, মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের প্রভাব ফেলে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই সুশিক্ষিত ও উন্নত জাতি গঠন করেন। মানুষ গড়ার কারিগর একজন শিক্ষকই পারেন একটি সুশিক্ষিত ও উন্নত জাতি গঠন করতে। শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব, আদর্শ ও মানবিক মূল্যবোধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একজন শিক্ষার্থীর উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দিলেও শিক্ষকই তাকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। একজন শিক্ষকই পারেন শিশুর সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করে জাতির উন্নয়নে নিযুক্ত করতে।

তার চিন্তা-চেতনা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন একজন শিক্ষক। সন্তানের কাছে তার পিতা-মাতা যেমন আদর্শ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত তেমনি একজন শিক্ষকও তার ব্যক্তিত্ব, আদর্শ ও কর্মের গুণে শিক্ষার্থীর কাছে আদর্শ ও অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে মানুষের প্রতিভার বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন শিক্ষক। আর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করেন বলেই শিক্ষকেরা সবার কাছে সম্মানীত।

মহৎ পেশা, বৃহৎ সেবা নিঃসন্দেহে শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা। পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে অন্য সকল পেশার জননী বলা হয়। সেটি শিক্ষার যেকোনো স্তরেই হোক না কেন। হতে পারে সেটি কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়। দল-মত, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে একজন শিক্ষক সমাজের সকল মানুষের কাছে অত্যন্ত মর্যাদা ও সম্মানের পাত্র। শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিখন প্রক্রিয়া উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ বিনির্মাণে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তুলতে শিক্ষকরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শিক্ষকদের মধ্যে যারা উপাচার্য পদে আসীন হন জাতির প্রতি তাদের দায়িত্ব বিশেষ করে মানবিকতার শিক্ষা ও দীক্ষা শিল্প সংস্কৃতি এবং সমাজ উন্নয়নে তারঁ ভূমিকা অপরিসীম। আদর্শ উপাচার্য, আদর্শ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী সৃষ্টির শৈল্পিক কারিগর। তাঁর দূরদৃষ্টি, চিন্তাশক্তি, দৃষ্টিভঙ্গি, নির্দেশনা এবং স্থান, কাল, পাত্র, জাতি, ধর্ম ও বর্ণভেদের উর্ধ্বে উঠে মানবতার কল্যাণে ব্যাপৃত হয়। তাই বলা হয় ব্যক্তি মানব এখানে অর্থহীন কিন্তু ব্যক্তি উপাচার্য যদি একজন শিক্ষক হন তবে তিনি হবেন সকলের শ্রদ্ধার ও সম্মানের পাত্র। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উপাচার্যের দায়িত্ব কোন নির্ধারিত ফ্রেমে আবদ্ধ করা যায় না।

তিনি সমাজ এবং রাষ্ট্রের পর্যায়েও বহুবিদ দায়িত্বপূর্ণ কর্তব্য সম্পন্ন করে থাকেন। সম্মানিত উপাচার্য মহোদয়গন তার প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক শিক্ষার্থীর সঙ্গে ব্যবহারে সমতাবিধান, একীভূতকরণ ও ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করবেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের, সমাজের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, সামাজিক কর্মকান্ডে নেতৃত্বদান, সংগঠিত মনোভাব সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রদান একজন আদর্শ উপাচার্য নৈতিক দায়িত্ব।

সমাজের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বহিসেবে সামাজিকতা, জনসচেতনতা সৃষ্টি, সামাজিক বিভিন্ন কাজে নেতৃত্বদান, জনমত গঠন করা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন বিবাদ-মীমাংসা, অপরাধপ্রবণতা রোধে করণীয় নির্ধারণ এবং সামগ্রিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করা। সর্বোপরি একজন আদর্শ উপাচার্য এমন গুণের অধিকারী হবেন, যা তাকে তার দায়িত্ব ও ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের অন্যান্য পেশাজীবী থেকে অনন্য করে তুলবে।

রাষ্ট্র একজন উপাচার্য কে সম্মানের দিক থেকে আচার্যের পরের স্থান দিয়েছেন। সেই অবস্থানকে সম্মানিত করতে তিনি তার মানবিক গুনাবলীর ধারা তার অধীনস্থ সকল পর্যায়ের মানুষের মাঝে উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি, তাদের মধ্যে শ্রমশীলতা, সহনশীলতা, ধৈর্য, নিজ ও অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা এবং অধ্যবসায়ের অভ্যাস গঠন; দেশপ্রেমিক ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই করতে বাধ্য থাকবেন।

জাতির প্রতি শিক্ষার্থীদের দায়িত্ববোধ

জাতিকে সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে ধাবিত করতে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একজন প্রকৃত শিক্ষার্থীর চেষ্টা-সাধনা হবে বিনয়ী, সৎ, দেশ প্রেমিক, মুক্তমনা, আত্মত্যাগী ও আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলা। আজকের শিক্ষার্থীরাই জাতির আগামী দিনের পথপ্রদর্শক। আমাদের সোনার বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আমাদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন উপযুক্ত দেশব্রতী নেতৃত্ব। আর ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রয়োজন মেটাতে হবে আজকের শিক্ষার্থীদেরকেই।

জাতির গৌরব সংরক্ষণ করার সুমহান দায়িত্ব আজকের শিক্ষার্থীদেরকে গ্রহণ করতেই হবে। কেননা তাদের কৃতকর্মের সফলতার ওপরই জাতির ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। শিক্ষার্থীদেরকে একথা মনে রাখতে হবে তারুণ্যের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হতে পারলেই ভবিষ্যৎ বিপদের কালোমেঘ একদিন দূরীভূত হবেই। তোমাদেরকে অবশ্যই নতুন কিছু করার ও গড়ার স্বপ্নে সবসময় উদ্যমী ও দায়িত্ব পালনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরাই পারে অকুতোভয় সংগ্রামী ভূমিকা পালন করতে যার বাস্তব উদাহরন আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সহ নানা আন্দোলন-সংগ্রাম। পৃথিবীর সব ফল জাতিগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুগে যুগে শিক্ষার্থীরাই রচনা করেন স্বপ্নিল পৃথিবী। যেকোনো পথভ্রষ্ট জাতিকে তারাই দেখায় আলোকবর্তিকা, তাদের শক্তি অপরিমেয়, দুর্বার, উচ্ছাস-উদ্দীপনা ক্লান্তিহীন।

হতদরিদ্র মানুষ মানুষের কল্যাণে, নিজের কল্যাণে, প্রতিষ্ঠাবণের কল্যাণে, সর্বোপরি জাতির কল্যাণে তারা হবে দৃঢ়প্রত্যয়ী, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, মুক্তির অগ্রদূত, অপ্রতিরোধ্য ও মুক্তদৃষ্টির অধিকারী। তারাই জাতির কর্ণধার। নিজেকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সাথে সাথে দেশের বিরাজমান অপ্রীতিকর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, পারস্পারিক সহিংসতায় নিপতিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করে জাতীয় উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দুর্গত ও বিপন্ন মানবতার সেবা, জনসেবা, পল্লী উন্নয়ন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, গরীব ও মেহনতি মানুষকে সহায়তা, জনস্বাস্থ্য রক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, বৃক্ষরোপণ, সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক সাংবাদিকতা ইত্যাদির মাধ্যমে দেশ, জাতি ও বিশ্বের সামগ্রিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে হবে।

একনিষ্ঠ দেশপ্রেম

একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক ও পরিচালক শিক্ষার্থীরাই। তাই তাদেরকে দেশপ্রেমের আদর্শে উজ্জীবিত হতে হবে। কেননা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনের সুপ্ত, একনিষ্ঠ, অকুণ্ঠ দেশপ্রেমের ক্ষুদ্র বীজই ভবিষ্যতে কর্মময় জীবনের পথ চলার পাথেয় হিসেবে ব্যবহৃত হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আনলে ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় ঔপনিবেশিক দেশ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমাজের সচেতন ও সংগ্রামী অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।

আমাদের দেশেও শিক্ষার্থীরা মাওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেকের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে এবং সর্বোপরি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবন থেকেই তার আত্মত্যাগের মাধ্যমে তৎকালীন ছাত্র সমাজের মাঝে এক আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আর শিক্ষার্থীদের সেই আত্মত্যাগই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার।

পরিবেশ সংরক্ষণ, দুর্নীতি ও নিরক্ষরতা দূরীকরণ

কিছুদিন পূর্বেও নিরক্ষরতা বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল। আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের প্রাণদীপ্ত তারুণ্যের শক্তির মাধ্যমে তা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। নতুন কিছু করার এবং গড়ার কাজে তারা উদ্যোগী এবং উৎসাহী। তাই নিরক্ষরতা দূরীকরণে শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল এবং করেই চলছে। আমাদের এদেশে বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে চাইলে সবার জন্যে শিক্ষা তথা গণশিক্ষাবিষয়ক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

গণশিক্ষা বিস্তারে শিক্ষার্থীরাই অংশগ্রহণের মাধ্যমে তা সাফল্যমণ্ডিত করতে পারে। যেমন ধরুন পথ শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা, মসজিদে-মসজিদে, মাদ্রাসায়-মক্তবে,বাড়িতে-বাড়িতে গিয়ে নিরক্ষরতার অভিশাপ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে সারাদেশে শিক্ষার্থীরাই বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। আর সেজন্য সাপ্তাহিক ছুটি, পরীক্ষা পরবর্তী ছুটি এবং বিভিন্ন অবকাশকালীন সময়ে গণশিক্ষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরাই জাতিকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে।

শিক্ষার্থীরা যাবতীয় সংকীর্ণ চেতনার উর্ধ্বে। চারিত্রিক দৃঢ়তাই তাদের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। সমাজ ও দেশে যেখানেই নৈতিকতার অবক্ষয় দেখা দেয় সেখানেই শোনা যায় তাদের সরব, প্রতিবাদী ও সোচ্চার কণ্ঠের প্রতিবাদ। যেখানে দুর্নীতির কালো হাত থাবা দিয়েছে সেখানে দেখা যায় ছাত্রদের বলিষ্ঠ অবস্থান, ছাত্রদের এ প্রতিবাদী কন্ঠ অনতিবিলম্বে জন্ম দিতে পারে একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ।কেবল আমাদের দেশে নয়, পুরো বিশ্বের প্রকৃতি ও পরিবেশ আজ ধ্বংসের সম্মুখীন।

শিল্পায়ন, ধনী দেশগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা, কার্বন নিঃসরণ এর ক্ষেত্রে গৃহীত জাতিসংঘের বিভিন্ন আইনের লংঘন, পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা, মহাকাশযানের ধ্বংসাবশেষ পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হওয়া, পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ,জনগণের অসচেতনতা এবং স্বার্থপরতা পরিবেশকে দূষিত করছে প্রতিনিয়ত।

অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, বনভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহার পরিবেশের ক্ষতিসাধন করছে। শিক্ষার্থীরা যদি তাদের উদ্যোগী সচেতন মন নিয়ে জনগণকে সচেতন করে তবে,পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে দেশে আন্দোলন গড়ে তূলে স্বেচ্ছাচারীদের থেকে পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা ছাড়া আর অন্য কেউ জনমত গড়ে তুলতে পারবে বলে আমি মনে করি না।

সমাধানের উপায় কি হতে পারে

অবরোধই কি একমাত্র সমাধান? অনশনই কি দাবি আদায়ের একমাত্র পথ হতে পারে? অনেক সময় দেখা যায় সাধারণ জনগণই নয়, সরকারও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে, সাধারণ যাত্রীরা পরিবহন মালিক সমিতির সংগঠনের কাছে, জনপ্রশাসনে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক সংগঠনের কাছে মাঝেমধ্যেই অবরুদ্ধ ও অসহায় হয়ে পরে। দেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতিবাজদের কাছে অবরুদ্ধ থাক তা কেউই চায়না।

তারা চায় দায়িত্বশীল যারা আছেন তারা যেন জনগণকে বিভিন্ন সিন্ডিকেটের অথবা দুর্নীতিবাজদের,চাঁদাবাজদের অবরোধ থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করবে। ভোক্তা অধিকারের ক্ষেত্রে দেখা যায় সাধারণ ক্রেতারা পাইকারদের কাছে অবরুদ্ধ। পাইকারেরা অবৈধ মজুদদারদের কাছে অবরুদ্ধ।

কৃষকেরা মহাজনের কাছে অবরুদ্ধ। সব জায়গায় শুধু অবরোধ আর অবরোধ। অনেক সময় এটা বুঝতেই বড় কষ্ট হয় এত অবরোধের মূল কারণটাই বা কি? এর পিছনে কারা, কিংবা তাদের স্বার্থ? সরকারের দায়িত্বশীলদের, বুদ্ধিজীবীদের লিখনী, বক্তব্য অথবা টকশো এর মাধ্যমে কেমন যেন একটা অস্পষ্ট সমাধান পাওয়া যায়! আর সেটা হল কে বা কাহারা এর পেছনে আছে তা খতিয়ে দেখা দরকার! সেজন্য তদন্ত কমিটি হয়, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তাদের দ্বারা তদন্ত কমিটি, আরো কত কিছু করা হয়।

কিন্তু দ্রুততার সহিত সমাধান নিয়ে আসতে পারে না। অনেক সময় তদন্ত কমিটির ফলাফল প্রকাশ করা হয় না। আবার কখনো কখনো ঘটনার পিছনে কে বা কাহারা আছে প্রকাশ পেলে মূল হোতা ফেঁসে যেতে পারে সেই ভয়ে তদন্ত কার্যক্রম হয়ে গেলেও তা প্রকাশ করা হয় না। শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্য মহোদয় বলেছেন, তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত কার্য পরিচালনা করার পর যদি নিজে দোষী সাব্যস্ত হন তবে তিনি পদত্যাগ করে চলে যাবেন।

তাহলে সমাধান তো এখানেই হয়ে যায়। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও বর্তমান দাবি এটাই। এ জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় ,বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, UGC সদস্যদের মাধ্যমে একটি সমন্বিত তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার তদন্ত হওয়া জরুরী বলে আমি মনে করি। তদন্তের মাধ্যমে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করাও জরুরী বলে আমি মনে করি।

আমরা অনেক সময় লক্ষ্য করি ন্যায়, অন্যায়ের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, স্নেহশীলতা স্বার্থের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ,পদদলিত হয়, যা কখনোই কাম্য নয়। সেজন্য তদন্তে যে সমস্ত কর্মকর্তা বা ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে গোয়েন্দা বাহিনীর লোকজন সংশ্লিষ্ট থাকবেন তাদের কাছে মানবতা যেন প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়। আর মানবতা যেন বর্বরতার কাছে পদদলিত না হয়। সততা যেন অসত্যের কাছে অবরুদ্ধ না হয়। শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্নের কাছে অবরুদ্ধ হতে না পারে। আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেন কোনোভাবেই আংশিক অথবা পুরোপুরি দলতন্ত্রের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে না পরে।

শাবিপ্রবির সম্মানিত উপাচার্য মহোদয় গত ২২ জানুয়ারি কোন এক বক্তব্যের মধ্যে বলেছেন, আমরা শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছিলাম। তবে কিছু দিনের সময় তাদের কাছে চেয়েছিলাম। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চলমান রাখেন। পরে প্রশাসন ও শিক্ষক প্রতিনিধিরা তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও তারা আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন।তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে তিনি নিজেই বিব্রত ও মর্মাহত। এ ঘটনায় আমার যদি কোনো দোষ থাকে, তাতে সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে যদি আমার কোনো ধরনের অন্যায় পেয়ে থাকেন, তাহলে সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে, তিনি তা মেনে নিতে রাজি হবেন।

তিনি আরও বলেছিলেন, আমি চাই এ ঘটনার একটা তদন্ত হোক। কে বা কারা পুলিশের ওপর এ হামলা করে, তা খতিয়ে দেখতে আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কিন্তু পুলিশিইবা কেন নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর বর্বর হামলা চালালো, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি না করলে, খুব সুক্ষ্ণ, চুলচেরা বিশ্লেষণ না করলে, বিচক্ষণ ব্যক্তির বা ব্যক্তিবর্গের সমন্বিত নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা না হলে, প্রকৃত দায়ী কে বা কাহারা, কার কতটুকু প্রভাব ছিল, কার কতটুকু অংশগ্রহণ ছিল তা বের করে আনা সম্ভব নয় বলে মনে করি।

আর অংশগ্রহণ যদি অন্যায় হয়ে থাকে তবে অন্যায় অনুপাতে প্রত্যেকেই তার নিজ থেকেই আইনের শাস্তি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আর যদি তা না হয় তাহলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাস একটি দুর্ভেদ্য ন্যক্কারজনক ঘটনা হিসেবে ভবিষ্যতে থেকে যাবে। সর্বোপরি সকলের সমন্বিত চেষ্টার মাধ্যমে নিশ্চিত হোক প্রত্যেকের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ