জামায়াত-শিবিরের দাবার গুটি ছাত্ররা
- সাইদুর রহমান
- প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:২২ PM , আপডেট: ০৪ মে ২০২৫, ০২:৩৮ AM

ছাত্ররা নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলেছে! তাদের জামায়াতে ইসলামী বা ছাত্রশিবিরের প্রতি বিশেষ আনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে। সরকারে থেকে দলগঠন এবং নির্বাচনকালীন বিএনপির মহাসচিব নিরপেক্ষ সরকারের দাবির কথা বলার পরপরই তারা বিএনপির বিরুদ্ধে বাকযুদ্ধ শুরু করেছে। বিএনপিকে সংঘবদ্ধভাবে বটবাহিনী আক্রমণ শুরু করে। অথচ জামায়াতের আমীর একই ধরণের আরো আগ্রাসী বক্তব্য দিলেও ছাত্ররা একটি প্রতিবাদও করেননি।
বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্যের পরপরই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম নানাভাবে বিএনপিকে আক্রমন করে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপিকে তুলনা পর্যন্ত করেছে। অথচ তারা কেন জামায়াতকে নিয়ে একটি বক্তব্যও দিলো না? এটি কি তাদের নিরপেক্ষতা ভঙ্গ নয়? জনগন মনে করে, ছাত্র প্রতিনিধিরাই জামায়াতে ইসলাম দ্বারা পরিচালিত। এজন্য জামায়াত প্রসঙ্গে তারা একটি টু শব্দও করেননি।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাসনাত আব্দুল্লাহ অসুস্থ্য হলে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান হাসপাতালে ছুটে যান। সারজিস আলম ছাত্রশিবিরের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন। এগুলো কি দলটির প্রতি আনুগত্যের খন্ড চিত্র নয়? আবার জাতীয় নাগরিক কমিটির আহবায়ক নাসীরউদ্দীনের আপন ভাই চাঁদপুর জেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক শীর্ষ নেতা।
কৌশলে ছাত্ররা যে জামায়াত দ্বারা পরিচালিত সেটি স্পষ্ট হয়ে গেছে। এর আগে নুরুল হক নুরের উত্থানের ক্ষেত্রেও শিবিরের একটি ভূমিকা ছিলো। পরবর্তীতে নুরুর ছাত্র সংগঠনে ফাটল ধরলে ইসলামপন্থীরা বেরিয়ে যায়। নুরুর ছাত্র সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদের এক সময়ের নেতা ছিলেন আখতার হোসেন, নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদরা। নুরুর সাথে বিরোধ হলে ছাত্র শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটান আখতার, নাহিদ এবং আসিফরা। এই অংশটিকে বরাবরই সমর্থন দিয়ে গেছে ছাত্র শিবির। ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন বামসংগঠনেও অনুপ্রবেশ ঘটায় শিবির। এই অনুপ্রবেশকারীদের যৌথ প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে নানা ছাত্র ফ্রন্ট। যা ঘুরে ফিরে শিবির সমর্থিত। এদের বর্তমান মূল লক্ষ্য জনগনের কাছে বিএনপিকে বিতর্কিত করা।
আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন ছাত্রলীগকে কারা প্রশ্রয় দিচ্ছে, কারা পুনর্বাসন করছে? ছাত্রলীগের গর্ভে বেড়া উঠা আন্দোলনকারীরাই কিন্তু। ছাত্রলীগের পদধারী অনেককেই শিবিরের নেতা হিসেবে পদায়ন করা হচ্ছে। পদ দেয়া হচ্ছে নাগরিক কমিটি বা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন বা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটানো অনুপ্রবেশকারীরা ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারীতে চলে আসে। যদিও ১৯ জুলাই হাসনাত-সারজিসের পতিত আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক এবং ২৯ জুলাই নাহিদ ইসলামদের আন্দোলন স্থগিত ঘোষণার বিষয়ে পুরো জাতি ওয়াকিবহাল। এর মাঝে ২১ জুলাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান শেখ হাসিনার সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। এর আগে ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের মৃত্যু ঘটে ২০ জুলাই। পরবর্তীতে এটি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক আন্দোলনে রুপ নেয়। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার পরও বিশেষ ব্যবস্থায় তারেক রহমান টেলিফোনে প্রত্যেকে এই নির্দেশনা দেন। শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রদের পাশে থাকবার কঠোর নির্দেশ (প্রমানসহ আছে) দেন। সরকার পতনের আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনে অবশ্যই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিলো। এজন্য এদেশের একজন নাগরিক হিসেবে ছাত্রদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাদের অবদান জাতি সারাজীবন মনে রাখবে। বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী এবং মুক্তিকামী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি।
এই আন্দোলনে হতাহত বা মৃত্যুর দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি বিএনপি এবং তার ছাত্র ও যুব সংগঠনের। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শূণ্যতা কিছুটা হলেও জায়গা নেবে বিএনপি। ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর ৮ আগস্ট ছাত্রদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম শুধু এটর্নি জেনারেল, পুলিশের আইজি বিএনপি নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। ইতিমধ্যে পুলিশের আইজিকে সরিয়ে দিয়েছেন। ধরলাম বিএনপি মাত্র দু'টি চেয়ার নিতে পেরেছে বাকী চেয়ারে তাহলে কারা দখল করেছে সেটি কি জাতির সামনে স্পষ্ট করবেন? ছাত্রদের সততা এবং নৈতিকতার সাথে সরকার পরিচালনা নিয়ে আপত্তি রয়েছে। জেলা প্রশাসক পদে আপনারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদে জড়িতদের বসিয়ে রেখেছেন, সচিব পদেও বসে আছে বিগত সরকারের সুবিধাভোগীরা। গোয়েন্দা সংস্থায়ও আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে ফ্যাসিবাদে ভরা। ফ্যাসিবাদী শক্তি রাষ্ট্র পরিচালনায় বারবার সরকারকে বাঁধাগ্রস্থ করছে। আপনাদের মতে, দুটি পদ ছাড়া বড় বড় বাকি চেয়ারগুলোয় তাহলে জামায়াতের মেধাবীরা বসে আছে।
ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠনকে সবাই সাধুবাদ জানিয়েছে। কিন্তু ছাত্র প্রতিনিধি সরকারে থেকে দল গঠন করলে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেই কথাটি কি রাজনীতিবিদ হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলতে পারবেন না? তিনি তো রাজনীতিবিদ। ছাত্রদের দূরভিসন্ধিমুলক কর্মকান্ড হয়তো উনি বুঝতে পেরেছেন, সেটি ছাত্ররাও হয়তো জেনেছেন। নয়তো এভাবে আক্রমনাত্মক বক্তব্য কেন আসবে ছাত্রদের পক্ষ থেকে? ফ্যাসিবাদ সমর্থিত ব্যবসায়ীরা নানাভাবে ছাত্রদের দলগঠনে অর্থায়ন করে যাচ্ছে। নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারীরা গাড়ি ছাড়া চলাফেরাও করছেন না। তাদের টাকার উৎস কোথায় সেটি জানবার অধিকার তো আছে জনগনের। নিয়োগ, বদলি,পদোন্নতিতে কি পরিমান বাণিজ্যে হয়েছে সেটি আর নাই বললাম।।
ছাত্ররা রাজপথে ছিলো বলে হাসিনার বিদায় হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। হাসিনার বিদায় হয়েছে বিগত সাড়ে ১৫ বছরের অপশাসনের কারণে। রাজনৈতিক দলগুলোর উপর অমানবিক নির্যাতন, নিপীড়ন চালিয়ে নিজের ক্ষমতা ধরে রেখেছিলো। বিএনপির ৬০ লাখ নেতাকর্মীর নামে মামলা, ২০ হাজার নেতাকর্মী হত্যার শিকার। রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপর দমনপীড়ন মাত্রারিক্ত থাকায় সবাই বিকল্প আন্দোলন খুঁজছিল। বিশেষ করে কোন সামাজিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার প্রবল চেষ্টা ছিল। সেই মোক্ষম আন্দোলন ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন।
রাজপথে থেকে যারা আন্দোলন করেছে তাদের আন্দোলনটি ছিল স্বল্প পরিসরে। আন্দোলনকারীরা কিন্তু কোনদিন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ডামি ভোটের প্রতিবাদ করেনি। বা তারা অবৈধ ভোটের প্রতিবাদ করতে পারেনি। প্রতিবাদ করেছে রাজনৈতিক দল। ছাত্ররা যখন নিশ্চুপ ছিলো প্রতিবাদমুখর ছিলো রাজনৈতিক দল। ছাত্ররা যখন প্রতিবাদমুখর হয়, রাজনৈতিক দল তখন আন্দোলনের ড্রাইভিং সিটে চলে যায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে ছাত্ররা সফলতা পেয়েছে। এখন সেই সফলতাকে নিজেদের অর্জন মনে করে বিএনপিকে টার্গেট করা হবে মহাভুল।
ছাত্ররা ভুলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাদেরকে বিএনপি সম্পর্কে ভুল বার্তা দেয়া হচ্ছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদের নেতৃত্বে সরকার গঠনের জন্য যারা পেছন থেকে মদদ দিচ্ছে তারা মুলত ছাত্রদের বিতর্কিত করতে মাঠে নেমেছে। ওই বিশেষ গোষ্ঠী ছাত্রদের মাথায় ঢুকিয়েছে, আওয়ামী লীগ শেষ। এখন বিএনপিকে টার্গেট করে অগ্রসর হলে তোমরাই ক্ষমতায় আসবে। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, ছাত্রদের সম্মিলিতাবে দেশ পরিচালনার যে ছক তাদেরকে বলা হয়েছে তা বাস্তবে অবাস্তব পরিকল্পনা।
ছাত্ররা এখন জামায়াত-শিবিরের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি তাদেরকে আগে বুঝতে হবে। এভাবে অনৈক্য সৃষ্টি করা হলে দিনশেষে ফ্যাসিবাদী শক্তিই লাভবান হবে, ক্ষতিগ্রস্থ হবে মুক্তিকামী রাজনৈতিক দলগুলো। ছাত্রদের উচিত হবে, নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে ঐক্য নিশ্চিত করা। ফ্যাসিবাদ ঠেকিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচনে পথে অগ্রসর হওয়া। জনগনকে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
লেখক: রাজনীতি ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক