‘একপর্যায়ে বুয়েট আর আমার ভালোবাসা ছিল না, মনে হতো কবে এই জাহান্নাম থেকে বাঁচব’

মাহমুদুল হাসান নয়ন
মাহমুদুল হাসান নয়ন  © সংগৃহীত

আমরা ২০১০ সালের মে মাসে ক্লাস শুরু করি। ২০১২ সালে ভিসিবিরোধী আন্দোলনের আগে সবকিছু ভালোই যাচ্ছিলো। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ভিসিবিরোধী আন্দোলনের প্রভাব সবমিলিয়ে বুয়েটে এক অরাজক পরিস্থিতি শুরু হয়ে গেলো। আজব এক অপরাধ ‘শিবির সন্দেহে’ অমানুষিক নির্যাতন এবং পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার সংস্কৃতি চালু হয়ে গেলো।

আমাদের তখন লেভেল ৩ টার্ম-১ শুরু হয়েছে। আমি বুধবার রাতে গ্রামের বাড়ি গেলাম ঘুরতে। শনিবার সকালে ফিরে ক্লাস ধরার প্ল্যান। হঠাৎ কি মনে হল যে শনিবারে ক্লাস মিস দিয়ে পরের দিন রবিবার ব্যাক করবো। শুক্রবার রাত ১টার দিকে আমার এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলে, আমাকে এবং আর আমার বন্ধু জিয়াকে ছাত্রলীগের ছেলেরা হলে খুঁজছে। আমি সৌভাগ্যক্রমে বাড়িতে আর জিয়া ওর ভাইয়ের বাসা মোহাম্মাদপুরে ছিল।

পরের দিন আমি ট্রেনে ঢাকা ফিরছিলাম। হঠাৎ ফোনে জানলাম জিয়াকে ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রচণ্ড মারধর করে পুলিশ দিয়েছে। জানতে পারলাম যে আমাকে পেলেও একই পরিণতি ঘটাবে। এরপর কয়েক মাস আর ক্লাসে যাইনি। মিডটার্মের পরে একদিন সাহস করে একটা ল্যাব ক্লাসে গিয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য! তৎকালীন ছাত্রলীগের উদীয়মান ত্রাস শুভ্র জ্যোতি টিকাদার ছিল আমার সেকশনে। আমার রোল ৭৯ আর ওর ৭৭। সুতরাং ল্যাবে গিয়েই তার সাথে দেখা।

আমাকে দেখেই তো সে প্রচণ্ড বাজে ব্যবহার করল এবং অনবরত ফোনে ম্যাসেজিং করতে লাগলো। আমার তো আর বুঝতে বাকি রইলো না যে বন্ধু আমার তার ভাই বেরাদারদের বিল্ডিংয়ের নিচে জড়ো করতেছে। আমি আমার আরেক বন্ধুকে নিচে পাঠিয়েছিলাম কনফার্ম হওয়ার জন্য। সে আমাকে জানালো ছাত্রলীগের কয়েকজন নিচে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি এটা জানার পর সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস থেকে বের হয়ে ওপরে এক স্যারের রুমে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরে ওরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আমাকে না পেয়ে চলে গিয়েছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে ওইদিন নিরাপদে বাসায় ফিরেছিলাম। এরপরে আর ক্লাস এ ফেরা হয় নাই। ফলাফল ওই সেমিস্টার ড্রপ দিতে হল।

মাঝে আমরা কয়েকজন মিলে তৎকালীন ছাত্রকল্যাণের পরিচালক দেলাওয়ার হোসেন স্যারের কাছে অভিযোগসহ আবেদন নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যার খুব আন্তরিকতার সাথে আবেদন গ্রহণ করলেন। কিন্তু ছাত্রলীগের নাম দেখে উনি হতাশ হয়ে গেলেন। বললেন ছাত্রলীগ না লিখলে উনি হয়ত অ্যাকশন নিতে পারতেন। বাট ছাত্রলীগ লেখার কারণে তার জন্য ঝামেলা হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন: আবরার মরেছে, আমি বেঁচে আছি—তাই পত্রিকার শিরোনাম হইনি

এরপর ৩-২ শুরু হল, তবুও ক্লাসে ফেরার কোন পরিবেশ তৈরি হল না। ৫-৬ সপ্তাহ ক্লাস শুরুর পরে বাধ্য হয়ে শুভ্রকে ফোন দিলাম। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা এখন এরাই। এদের অনুমতি ছাড়া বুয়েটে ক্লাস শুরু করা অসম্ভব। অবশেষে তার অনুমতির জন্য আমি ২ জন বড় ভাইসহ তার সাথে দেখা করার জন্য এলিফেন্ট রোডের শর্মা হাউজে গেলাম। শুভ্রও দুইজনকে সাথে নিয়ে আসলো।

শুভ্র ৩টা শর্ত দিল। ১) তাকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে (এই টাকা নাকি দ্বীপে পরিবারকে দেবে! কি হাস্যকর) ২) হলে থাকা যাবে না। ৩) ছাত্রকল্যাণের পরিচালকের সাথে আমার বাবাকে দেখা করতে হবে। আমি সবগুলো মেনে নিলাম। এটা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আরেকটা হুমকি সে দিল যে, ও যে টাকা নিয়েছে এটা কাউকে বললে আমাকে জানে মেরে ফেলবে।

তবে সে খুব গোপনীয়তা রক্ষা করে আমার কাছে থেকে টাকা নিয়েছে। টিএসসির ভেতরে একবারে চিপায় গিয়ে নিয়েছে টাকা। তখন কিছুটা হলে ও লজ্জা ছিল। এরপরের দিন আমি আব্বু-আম্মুসহ বুয়েট ক্যাম্পাসে আসি ছাত্রকল্যাণের পরিচালকের সাথে দেখা করার জন্য।ছাত্রকল্যাণের পরিচালক দেলোয়ার স্যার আমাকে বলেন তোমরা কেন যে ঝামেলায় জড়াও? এদের সাথে মিলেমিশে থাকতে পারো না?

তখন ভাবলাম, আমার আব্বু ও একজন শিক্ষক। আপনি ও একজন শিক্ষক। কিন্তু কত পার্থক্য দুজনের মাঝে। আপনি যদি স্টুডেন্টদের নিরাপত্তা দিতে না পারেন তাহলে পদত্যাগ করতে পারতেন। কিন্তু পদে থেকে আমাদেরকেই বলবেন যে এই জালিমদের সাথে মিলেমিশে থাকতে? 

যাহোক অবশেষে প্রায় ১ বছর পর আমি ক্লাসে ফিরি। আমার বোনের বাসা থেকে বুয়েটের বাসে আসতাম। ক্লাস শেষ করে চলে যেতাম। এটাই ছিল আমার রুটিন। আর মাঝে মাঝেই শুভ্র আমার মোবাইল চেক করত। মনে হত আমি একটা কারাগারে আছি। আর ভাবতাম কবে এখান থেকে আমি মুক্তি পাব, কবে আমি পাস করব।

যে ভালোবাসা আর ফ্যাসিনেশন নিয়ে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলাম, সেটা আর ছিল না। মনে হত এই জাহান্নাম থেকে বের হতে পারলেই বাঁচি। শুধু বুয়েট না অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের নির্যাতনের যে কাহিনি শুনেছি তাতে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হয়। কারণ আমার গায়ে কোনো মার পড়েনি। একটু দেরিতে হলেও পড়াশুনা শেষ করতে পেরেছি।

কিছুদিন আগে পিএইচডিও শেষ করেছি ভার্জিনিয়া টেক থেকে। আর আমার বন্ধু শুভ্র এই নোংরা রাজনীতির বলি হল। তার মৃত্যুর সংবাদে বুকটা কেঁপে উঠেছিলো। কীভাবে একজন সাধারণ ছাত্র থেকে দানব এবং অবশেষে আত্মহত্যা করে একটি জীবনের সমাপ্তি ঘটলো। সুতরাং আমি চাই না বুয়েটে এই নোংরা রাজনীতি আবার ফিরে আসুক।

লেখক: শিক্ষার্থী, যন্ত্রকৌশল কৌশল বিভাগ (ব্যাচ-৯), বুয়েট


সর্বশেষ সংবাদ