বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও আমাদের ছাত্ররা বিশ্বমানের হতে পারেনি

অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন  © ফাইল ফটো

গতকালকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর একটি স্ট্যাটাস পড়ে মনটা খুব খারাপ হলো। মনে হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও আমাদের ছাত্ররা বিশ্বমানের হতে পারেনি। ছাত্রীটি লিখেছে সে একটি আবাসিক হলে থাকে। বাকিটা না হয় তার লেখা থেকেই জানুন। নিচে কাট অ্যান্ড পেস্ট করলাম। 

"আমাদের হলে সাধারণত ডাবলিং করতে হয় ফাইনাল ইয়ার পর্যন্ত। আমার সাথে ডাবলিং করবার জন্যে নতুন মেয়ে পাঠানো হয়েছে হাউস টিউটর অফিস থেকে। যাইহোক, কিছু লিগ্যাল প্রসিডিওর তো থাকে। আমি ফ্লোর ম্যামের সাথে কথা বলতে গিয়েছি এই সংক্রান্ত ব্যাপারে। ঠিক তখনই যে নতুন মেয়েকে পাঠানো হয়েছে,  সে মাঝখান থেকে ম্যামকে বলে বসলো, সে কোনো হিন্দুর সাথে বেড শেয়ার করতে ইচ্ছুক না... সম্ভবত আমার হাতে বাঁধা লাল সুতা আর ম্যামকে শ্রদ্ধাসূচক নমস্কার দেয়ার ভঙ্গিতে ততক্ষণে সে অনুমান করে ফেলেছে আমার ধর্ম পরিচয়। তো এই হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটা শিক্ষার্থীর মন-মানসিকতার অবস্থা।

আমি হিন্দু কিংবা মুসলমান এই পরিচয় যদি এতই মুখ্য হয়ে ওঠে, তাহলে ধর্মের ভিত্তিতে যেভাবে ভারত ভাগ হয়েছিল ঠিক সেভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা হল তৈরি করে দেয়া। কারণ আমি আমার যথাযথ যোগ্যতায় এখানে পড়তে এসেছি, হিন্দু বলে মাথা নিচু করে চলবার জন্যে নয়।"

লেখাটা কি কষ্ট নিয়ে লিখেছে ভাবতে পারেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে এসে একজন মানুষের কেবল অন্য ধর্মের হওয়ায় তার সাথে থাকতে না চাওয়া জেনে খুবই ব্যথিত হলাম। ধরুন আমি আমেরিকায় গেলাম সেখানে কেউ একজন আমার সাথে থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে কারণ আমি মুসলমান বলে। এই ট্রমা সারা জীবনেও যাবে না। এখন কি তাহলে প্রতিটি ধর্মের মানুষের জন্য আলাদা আবাসিক হল বানাতে হবে?

এই ভিত্তিতে আমরা যদি segregation করতে থাকি যে অন্য ধর্মের লেখা বই পড়বো না, অন্য ধর্মের স্যারের সাথে থিসিস করব না ইত্যাদি তাহলে আমরা কি সামনে আগালাম? আমি যখন ছাত্র ছিলাম আমার সেই শহীদুল্লাহ হলে অনেক হিন্দু ছাত্র থাকতো এবং তারা খুব দাপটের সাথে থাকতো। এদের সাথে মিশতে, এক বিছানায় ঘুমাতে, এক থালায় খেতে কারো কোন আপত্তির কথাতো কোনদিন শুনিনি। কবে থেকে আমরা এমন হয়ে গেলাম? কোন রাজনীতি আমাদের এমন বানিয়ে দিল? 

প্রতি বছর আমাদের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বিদেশে বিশেষ করে আমেরিকায় পড়তে যায়। সেখানে গিয়ে প্রায় সবাইকেই রুম শেয়ার করে থাকতে হয়। সেখানে গিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা যদি বলা শুরু করে আমি হিন্দুর সাথে একরুমে থাকবো না, আমি খ্রিস্টানের সাথে এক রুমে থাকবো না, আমি ইহুদীর সাথে এক রুমে থাকবো না তাহলে কেমন হবে? যদিও আমার জানা মতে পৃথিবীতে এমন কোন বিশ্ববিদ্যালয় নাই যেখানে একজন ছাত্রীর জন্য বানানো একটি বিছানায় দুজন ছাত্রীকে এক বিছানায় থাকতে হয়।

এইটা কল্পনাও করা যায় না। শুধু ছাত্রী না দুজন ছাত্র একজনের জন্য তৈরী একটি বিছানায় শেয়ার করে এক বিছানায় ঘুমাবে তা অকল্পনীয়। স্বামী-স্ত্রী ছাড়া দুজন এডাল্ট শুধু না দুজন শিশুও এক বিছানায় থাকে না। ছোটবেলা থেকেই আমার দুই কন্যা দুটো আলাদা বিছানায় ঘুমিয়েছে। এইখানে আমাদের দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ব্যর্থতা। আমাদের সময়ও সমস্যাটা এতো প্রকট ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মাত্র ১ থেকে ১.৫ মাস আমাকে এক বড় ভাইয়ের সাথে শেয়ার করতে হয়েছিল। কিন্তু সেই বড় ভাই আমি যতদিন ছিলাম ততদিন নিজ বিছানা আমাকে একা ঘুমাতে দিয়ে তিনি বন্ধুর সাথে অন্য রুমে শেয়ার করে ঘুমাতেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বিশ্ব শব্দটির মহাত্মা যদি আমরা ধারণ করতে না পারি তাহলেতো আসল শিক্ষাটাই হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম ইউনিভার্সাল। অর্থাৎ আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের কারিকুলাম পৃথিবীর অন্য যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের কারিকুলাম মোটাদাগে এক। শুধু কারিকুলামে এক না চিন্তা চেতনা ভাবনায়ও এক হয়ে যায়। আমি আশা করি সরকার শিক্ষার্থীদের থাকার সমস্যার প্রতি দৃষ্টি দিবে।

শিক্ষার্থীরা যদি পড়ার জন্য একটি টেবিল আর ঘুমানোর জন্য একটি বিছানা দিতে না পারি তাহলে উন্নয়ন হচ্ছে বলাটা একটা মকারী বই কিছু না। শত বছরের পুরোনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে দেশে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে কিন্তু একটিও বিশ্ব বিদ্যালয় হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় হতে হলে কেবল কিছু ভবন থাকলে, কিছু ছাত্র এবং শিক্ষক থাকলে আর শ্রেণীকক্ষে পাঠদান থাকলেই বিশ্ববিদ্যালয় হয়না। বিশ্ববিদ্যালয় মানে এমন একটি ক্যাম্পাস যেখানে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন বর্ণের ও সংস্কৃতির মানুষেরা এক উদ্দেশ্যে এক সাথে থাকবে।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)


সর্বশেষ সংবাদ