বিজ্ঞান না জেনে তথ্য-প্রযুক্তি পড়ে প্রযুক্তিবিদ নয়, হবে টেকনিশিয়ান

অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন  © ফাইল ফটো

আমরা যখন এসএসসি পড়ি, তখন বিজ্ঞান পড়ায় আমরা ১০০ নম্বরের ফুল ইউনিট কোর্স হিসাবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিত পড়েছি। আর সাথে বোনাস হিসাবে সাধারণ গণিততো পড়তেই হয়েছে সবাইকে। তাহলে মোট কত নম্বরের বিজ্ঞান পড়লাম? ৪০০+১০০! এই ধারা ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত ছিল।

২০১০ সালে মোট বিষয় ১০টির জায়গায় ১৩টি করা হয়। ধারণা করছি, কাউকে খুশি করতে তথ্য-প্রযুক্তির মতো বিষয়কে ঢুকিয়ে অযৌক্তিকভাবে লেখাপড়াকে dilute করে বিজ্ঞানের বিষয়কে মোট নম্বরের শতাংশ হিসাবে কমে ৩১% করা হয়। এরপর আসে নতুন শিক্ষাক্রম। এইবার আবার মোট নম্বর এক হাজারে চলে যায়।

কিন্তু বিজ্ঞানের ওয়েইট নামিয়ে ১০% এ নিয়ে আসা হয়। এখন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান আলাদা বিষয় থাকবে না। এদের এক করে বিজ্ঞান হিসাবে পড়ানো হবে। এইবার যেহেতু সাইন্স আর্টস কমার্স বিভাগ উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই সিলেবাস এমন করা হয়েছে যেন সকলের জন্য সহজ হয়। আবার একই সাথে উচ্চতর গণিত একদম বাদ।

এইবার বিষয়টাকে বোঝার চেষ্টা করুন। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের মতো অতি জরুরি বিষয় আগের চেয়ে তিন ভাগের দুই ভাগ কম পড়বে, আর উচ্চতর গণিত একদম পড়বে না। অথচ যারা এই সিস্টেম চালু করেছে তাদের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে এইগুলো সব পড়বে। তারা তাদের পছন্দমতো বিষয় নির্বাচন করতে পারবে।

আর বাংলা মাধ্যমে ঘাড়ে ধরে তথ্য-প্রযুক্তি, ভালো থাকা ইত্যাদি সবাইকে পড়তে বাধ্য করা হবে। কেন? মানে বুঝতে পারছেন? বিজ্ঞান এই দেশে থাকবে না। স্কুলে ১০% বিজ্ঞান থাকার কারণে বিজ্ঞানের শিক্ষকের চাকরি কমে গেল। বিজ্ঞান না জেনে তথ্য-প্রযুক্তি পড়ে কি কেউ প্রযুক্তিবিদ হতে পারবে? না। তারা হবে টেকনিশিয়ান।

বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে দেখুন করা চাকরি করছে? সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ কারা? প্রায় ৯৯% বাংলা মাধ্যমের। এই বাংলা মাধ্যমের মানকে অবনমন করলে পুরো দেশের সব কিছুর মান কমতে বাধ্য। এটাই ষড়যন্ত্র। এই বাংলা মাধ্যম নিয়ে ষড়যন্ত্রের শেষ নেই।

এসো নিজে করি চালু, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু, গ্রেডিং পদ্ধতি চালু, বিজ্ঞানকে ১০% এ নামিয়ে নিয়ে আসা ইত্যাদি সবই ষড়যন্ত্রের অংশ। স্কুল কলেজেই এই ষড়যন্ত্র শেষ না। বিশ্ববিদ্যালয়েও হাত দেওয়া হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রজেক্ট হিসাবে Reaching Out of School Children (ROSC II) project, Higher Education Quality Enhancement Project (হেকেপ প্রজেক্ট) এটিসহ আরো অনেক প্রজেক্ট এখনো সক্রিয়।

আচ্ছা বলেন, বাংলাদেশে মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের কি দায়? তাদের জন্মই হয়েছে ইউরোপ আমেরিকাকে সহযোগিতা করতে। ইউরোপ আমেরিকা যেইসব নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে আমরা যেন তাদের ভোক্তা হই। আমরা যেন আবার উদ্ভাবনী দেশে পরিণত না হই।

আরো পড়ুন: শিশুশ্রম প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন

তাই শিক্ষাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য এই শিক্ষাক্রমকে রুখে দিন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে একদম শেষ করে দিচ্ছে। ষড়যন্ত্র শুধু এখানেই শেষ না। এক দিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ছে, মানে খরচ বাড়ছে আর অন্যদিকে শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ দিন দিন কমছে।

যেখানে ভিয়েতনাম তাদের জিডিপির ৪.৭% এর বেশি শিক্ষায় বরাদ্দ দেয় আমাদের সরকার এইবার বরাদ্দ দিয়েছে জিডিপির ১.৭৮% এর মতো। বুঝতে পারছেন? তার মধ্যে এই বরাদ্দের বিরাট একটি অংশতো দুর্নীতি খেয়ে ফেলে।

এই শিক্ষাক্রম নিয়ে আমি আজকে থেকে বলছি না। যেদিন থেকে এই শিক্ষাক্রমের সূচি ও কারিকুলাম পড়েছি সেইদিন থেকেই লিখে আসছি। ডাটা ও চিত্রের মাধ্যমে রাখাল রাহা এই জিনিসটা এত সুন্দর করে দেখিয়েছেন যে এখন যেকোন মানুষের পক্ষে সহজে বোঝা সম্ভব।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)


সর্বশেষ সংবাদ