বশেমুরবিপ্রবি’র শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে শিক্ষকের খোলা চিঠি

জাকিয়া সুলতানা মুক্তা
জাকিয়া সুলতানা মুক্তা  © টিডিসি ফটো

একটি দারুণ বিষয় আজকে আমাদের সবার ফেসবুক নিউজফীডে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তা হলো- এবারের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ জেতা ফরাসি পদার্থবিদ Anne L' Huillier-এর সাথে নোবেল কমিটির মুখপাত্রের ঘটা একটি ঘটনা। ঘটনাটি এরকম- ‘উক্ত ফরাসি পদার্থবিদ Anne L' Huillier তাঁর শ্রেণিকক্ষের ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে, একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল পাওয়ার পর তিনি তাঁর ফোনটা রিসিভ করেছেন।

নোবেল কমিটির মুখপাত্র পরিচয় দেওয়ার পর উনি বলেন, ‘‘আমি ক্লাসে ব্যস্ত, এই মুহূর্তে  কথা বলতে পারছি না।’’ পরে নোবেল কমিটির মুখপাত্র বলেন, ‘‘আমি সত্যি দুই-তিন মিনিটের বেশি সময় নেব না।’’ পরে তিনি কথা বলতে রাজি হন এবং নোবেল পুরষ্কার জেতার সংবাদ শুনতে পান। 

এই সংবাদ পাওয়ার পর তিনি আবারও শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন এবং তাঁর বাকি পাঠদান সম্পন্ন করেন। ক্লাসের পরে শিক্ষার্থীরা হাত তালি দিয়ে এরপর তাঁদের শিক্ষকের নোবেল জয় উদযাপন করছেন।

এটি অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ একজন শিক্ষকের উদাহরণ এবং আমাদের সবার জন্য অনুকরণীয় একটি দৃষ্টান্ত। এটি খুব সহজলভ্য হলে নিশ্চয়ই এটিকে আমরা উদাহরণ হিসেবে দেখাতে পারতাম না। এমন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হওয়ার জন্য অনেক সাধনার প্রয়োজন এবং একইসাথে এমন সাধনার জন্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সমর্থনও প্রয়োজন। যদি এমন পরিবেশ না থাকে তো সেরকম পরিবেশ তৈরির জন্য সংগ্রামেরও প্রয়োজন।

শিক্ষক ও গবেষক Anne L' Huillier-কে অভিনন্দন। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে পদার্থবিজ্ঞানের মতন মৌলিক জ্ঞান শাখায় একজন নারী গবেষক হয়েও তিনি বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানসূচক অর্জনের অধিকারী হতে পেরেছেন। এটি একটি মাইলফলক। 

এবার আসি আমরা কি এমন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক পেতে পারবো বর্তমান বাস্তবতায়? উপরে উল্লেখিত ঘটনার দুটো অংশ নিয়ে আলোচনা করি, একটিতে নোবেল বিজয়ী শিক্ষক-গবেষকের দায়িত্বশীলতা নিয়ে এবং অপরপক্ষে তাঁর শিক্ষার্থীদের কর্তব্যবোধ নিয়ে। আসুন ভাবার চেষ্টা করি আমরা উক্ত স্থলে থাকলে কী করতাম?

প্রথম অংশের আলোচনা-

কেসস্টাডি নং-১:
বিশ্বখ্যাত গবেষকের তালিকায় গবেষক হিসেবে বাংলাদেশের গবেষক হিসেবে নাম লেখানো একজন শিক্ষক (নাম উল্লেখ করলাম না, বিভাগ পরিসংখ্যান), যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২ সাল থেকে কর্মরত। পূর্বেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করানোর অভিজ্ঞতাসহ তাঁর এ পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতি নীতিমালা অনুযায়ী মোট ১৩ বছর ৯ মাসের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

এ সময়ের মধ্যে তিনি ২০১৮ এর ডিসেম্বরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং ইতোমধ্যে তাঁর ২৩টির বেশি গবেষণাপত্র বিশ্বের নামকরা কিছু পাবলিশারের (nature publishing group, Elsevier, Springer-Nature,  Biomed Central, Bentham Science) জার্নাল থেকে প্রকাশিত হয়েছে। পরিচয় প্রকাশ পেতে পারে মর্মে তাঁর গবেষণার লিংক যুক্ত করে দিলাম না। কিন্তু আপনারা খোঁজ নিলেই তা জানতে পারবেন যে আমি সত্যি লিখেছি কিনা!

কেস স্টাডি নং ০২:
বিশ্বখ্যাত গবেষকের তালিকায় গবেষক হিসেবে বাংলাদেশের গবেষক হিসেবে নাম লেখানো আরও একজন শিক্ষক (নাম উল্লেখ করলাম না, বিভাগ গণিত), যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সাল থেকে কর্মরত। উক্ত শিক্ষকতাকালের মধ্যে  তিনি ২০১৯ সালে জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং ইতোমধ্যে তাঁর ৬০টির বেশি গবেষণাপত্র বিশ্বের নামকরা কিছু পাবলিশারের (Elsevier, Springer-Nature, Willy Science, World Scientific, IOP Science, American Institute of Physics,…) জার্নাল থেকে প্রকাশিত হয়েছে। পরিচয় প্রকাশ পেতে পারে মর্মে তাঁর গবেষণার লিংক যুক্ত করে দিলাম না। কিন্তু আপনারা খোঁজ নিলেই তা জানতে পারবেন যে আমি সত্যি লিখেছি কিনা!

আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন না, এবারের ৩৫তম রিজেন্ট বোর্ডে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদানকৃত কর্মকালের বৃত্তান্ত (অভিজ্ঞতার সনদ), অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আপগ্রেডেশন ও ডিউডেট নীতিমালার আলোকে সিলেকশন বোর্ড কর্তৃক অধ্যাপক পদে আপগ্রেডেশনের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও,  রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাঁদের উভয়ের আপগ্রেডেশন সুপারিশ অনুমোদিত হয়নি।

উক্ত সিদ্ধান্ত ভুল কী সঠিক তা নিয়ে বাৎচিতে না গিয়েই বলি, একটা নিয়োগ বা পদোন্নতি বোর্ডে প্রতিটি বিভাগের বহিঃস্থ বিশেষজ্ঞ সদস্যগণের একটা প্যানেল থাকে। তাঁদের মাঝে রাষ্ট্রপতি অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের প্রতিনিধি থাকেন দু'জন। উক্ত নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশের সাথে রিজেন্ট বোর্ড দ্বিমত পোষণ করতেই পারে, কিন্তু উক্ত সুপারিশকে অনুমোদন না দিয়ে এবং আচার্য বরাবর না পাঠিয়ে, এমনকি নিজেরাই অনুমোদিত নয় বলে কি বোর্ড সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে? হতেই পারে সেটা পারে।

তবে আমাদের ক্ষুদ্রজ্ঞানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ব্যাখ্যায় আমরা অনেকেই মনে করছি, রিজেন্ট বোর্ড তা পারে না। এমন হলে নিয়োগ বোর্ডকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে চিহ্নিত করা হয় এবং একইসাথে আচার্যের প্রতিনিধি তথা আচার্যের মূল্যায়নকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বলছে (যদি আমি বা আমরা ভুল না বুঝে থাকি) নিয়োগ বোর্ড ও রিজেন্ট বোর্ডের এই দ্বিমুখী অবস্থানের সমাধান একমাত্র আচার্যই করতে পারেন, আর কেউ নন।

আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও রিজেন্ট বোর্ডের সভাপতি একই ব্যক্তি। আমি যদি ভুল না জেনে থাকি তো আমার জানামতে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী দুই স্থলে দু'ধরনের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন না। অথচ এক্ষেত্রে আমরা কী দেখলাম? দেখলাম~ উক্ত ব্যক্তি নিয়োগ বোর্ডে এক সিদ্ধান্ত নিলেন এবং রিজেন্ট বোর্ডে গিয়ে উভয় বোর্ডের সভাপতি হয়েও আরেক সিদ্ধান্ত নিলেন। তাও আবার কারোর কারোর ক্ষেত্রে একরকম সিদ্ধান্ত, আবার কারোর কারোর ক্ষেত্রে ভিন্নরকম নিয়ম জারি করলেন।

যদি ভুল না হয় আমার তবে এ সবই নিয়মের ব্যত্যয়। যা তিনি উভয় বোর্ডের সভাপতি হিসেবে এবং আচার্যের পর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ অথরিটি রিজেন্ট বোর্ড কোন পক্ষেরই করার এখতিয়ার বশেমুরবিপ্রবি আইন, ২০০১ এ দেওয়া হয়নি। আইন যদি ভুল না হয়, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ যদি মিথ্যে না হয় এবং উক্ত ঘটনার পূর্বাপর ঘটনা পরম্পরায় যদি আমাদের কোনোভাবে মিসগাইড না করে থাকে তো এই সিদ্ধান্তসমূহ তো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধের মধ্যে পড়ে। 

যাইই হোক। এমন সিদ্ধান্ত যদি সবার জন্য প্রযোজ্য হত তাও মানা যেত। তখন সেটা বলা যেত যে লিখিত আইনে যাইই থাক, প্রচলিত আইনে এটি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্চিত ব্যাপার। কিন্তু না! বিষয়টি এরকমও নয়। এই যে নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়টি আমরা দেখলাম, এখানেও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ যে তাঁদের সাথে এমন হলেও একই নীতিমালায় ব্যক্তিবিশেষকে ভিন্ন বিচারে আপগ্রেডেশন দেওয়া হয়েছে।

এরকম হয়েছে বলে যে অভিযোগগুলো আছে, এর মাঝে ইতোমধ্যেই আপনারা জেনে থাকবেন শিক্ষক সমিতির ৬ দফা দাবির মাঝে উল্লেখিত অভিযোগ সমাধানের দাবিতে ৩ জন শিক্ষকের ক্ষেত্রেও একই বৈষম্য করার অভিযোগের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনভঙ্গ করে, যাকে ইচ্ছা আপগ্রেডেশন দিচ্ছে আর যাকে ইচ্ছা আপগ্রেডেশন থেকে বঞ্চিত করছে। 

* এবার আপনারাই বলুন না, এইরকম অভিজ্ঞতা কি এবারের নোবেল বিজয়ী Anne L' Huillier-কে কখনো নিতে হয়েছে বা হওয়া সম্ভব? তাঁর কি এইসব নিয়ে মাথাব্যাথা করতে হয়েছে কখনো? তিনি যদি জীবন-জীবিকা নিয়ে এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হতেন তবে কি তাঁর এমন মহিমান্বিত অর্জন সহজ হত? 

* এবার আরও একটা বাস্তবতা নিয়ে কথা বলি। নোবেল বিজয়ী Anne L' Huillier-কে কি কখনো তাঁর শ্রেণিকক্ষ, ল্যাবের সংখ্যা, ল্যাবের ইন্সট্রুমেন্টের বরাদ্দ নিয়ে, দিনের পর দিন প্রশাসনের সাথে একজন শিক্ষক-গবেষক হিসেবে মল্লযুদ্ধে নামতে হয়? যা এখানকার শিক্ষক-গবেষকগণকে করতে হয়। যদি তাঁকেও এরকম মল্লযুদ্ধে নামতে হত, তাহলে কি তিনি নোবেল বিজয় করার মতন এমন বিশেষ অর্জন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতেন? 

* আপনারা জানেন কিনা জানি না, এখানকার একজন শিক্ষক-গবেষক সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে পেতে তাঁর বেতনস্কেলের অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে তিনি যদি সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়েও থাকেন তবুও সহকারী অধ্যাপক পদে তাঁর বেতন যা থাকে এর থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে বেতনবৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ২০ (বিশ) টাকা। আই রিপিট ২০ (বিশ) টাকা! অধ্যাপক পদে উন্নীত হলে কতটা বেতনবৃদ্ধি পায় এটা এখনও আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক-গবেষকের জানা নাই।

কেননা একটা দীর্ঘকাল যাবৎ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনই মাত্র অধ্যাপক, বাকি আরও একজন যিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়েছেন কিছুদিন হলো, তিনি তো ক্যাম্পাসে নেই। ফলে আমরা আসলে জানি না ওখানে আমাদের জন্য বিশাল কোনো টাকার খনি অপেক্ষা করে আছে কিনা! যদি এমন কিছু আদৌ  থাকত তবে হয়তো আমরা প্রভাষক থেকে সরাসরি অধ্যাপক পদে যাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করলেও করতে পারতাম, বা ষড়যন্ত্র-বিশৃঙখলার এমন অভিযোগ প্রশাসন থেকে করলেও তা গ্রহণযোগ্যতা পেলেও পেতে পারত এবং তা যৌক্তিক হত।

কিন্তু এরকম কিছু না হওয়া সত্ত্বেও যদি প্রশাসন থেকে শিক্ষক-গবেষকদের নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালায় যে, তাঁরা নিজেদের রুটি-রুজি আর টাকা-পয়সার হিসাব মেলাতে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করছে; তা কতটা যৌক্তিক? বিষয়টা অর্থের সাথে যুক্ত অবশ্যই, কিন্তু প্রশাসনের কাছ থেকে যেভাবে বিভ্রান্তিকর বার্তা সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে ততটা আর্থিক লালসা শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিতদের অধিকাংশের নেই।

এটার সাথে সম্মান ও ন্যায্যতার সংযোগ বরং আরও বেশি রয়েছে। একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক-গবেষকের কথা বাদই দিলাম, একজন নগণ্য শিক্ষককেও কেন প্রশাসন বা যে কেউ বৈষম্য করে বঞ্চিত করবে? কেন কোনো প্রশাসন প্রধান বলবেন- "রিজেন্ট বোর্ড কিছু প্রমোশন আটকে দিয়েছে। সবাই কি প্রমোশন পাবে নাকি?" (সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক

এখানে প্রশ্ন হলো, সবাই কি প্রমোশন চেয়েছে? রিজেন্ট বোর্ডে তো সুপারিশকৃত প্রমোশনের প্রস্তাবই যায়। যারা যোগ্য বলে বিবেচিত তাদের জন্যই সুপারিশ যায়। যদি কেউ সুপারিশপ্রাপ্তই হন, তাহলে তিনি কেন অভিযোগ বা দাবি করতে পারবেন না তাঁর সাথে অন্যায় হয়েছে? 

এরপর তিনি আরও বলেছেন, "যেই আইন আগে ছিলো, সেটি (সাবেক উপাচার্য) নাসিরউদ্দিনের আমলের আইন। রিজেন্ট বোর্ড নাসিরউদ্দিনের আমলের আইন মানতে চাচ্ছে না।"

আরও পড়ুন: নোবেল পুরস্কারের কল পেয়ে অধ্যাপক বললেন 'আমি ব্যস্ত, ক্লাস নিচ্ছি'

এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়, রিজেন্ট বোর্ড কোন আইনের বলে পূর্ববর্তী সময়ের আইন যা এখনও বলবৎ রয়েছে তা পরিবর্তন না করেই তা মানতে চাইবে না? তিনি যে তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে রিজেন্ট বোর্ডের সবাইকে রাষ্ট্রীয় আইনভঙ্গকারী হিসেবে অভিযুক্ত করতে সাহায্য করলেন এটা বোঝার মতন বোধবুদ্ধিও কি তাঁর নেই? এমনটা আদৌ রিজেন্ট বোর্ড সদস্যরা বলতে পারেন কি? আমার তো এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে! জানি না, আমি ভুলও হতে পারি। 

তিনি আরও বলেছেন, "রিজেন্ট বোর্ড যেটি মনে করে সেটির যৌক্তিক কারণ আছে, চ্যান্সেলরও সেটি মানতে পারে।’’ 

মজার ব্যাপার হলো এই যে, তাঁর উল্লেখিত এমন দাবির সপক্ষে তিনি কোনো আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। বলেছেন কোনো এক ব্যক্তির সময়কালে করা তাঁর ভূমিকার প্রতি রিজেন্ট বোর্ডের আপত্তির কথা। এগুলো কি ছেলেখেলা? ধরলাম, উক্ত ব্যক্তি পূর্বে রিজেন্ট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে যা নয় তাইই করেছেন। কিন্তু তখন উক্ত বোর্ড মেম্বারগণ উক্ত বোর্ড সভায় কী ভূমিকায় ছিলেন? এমনকি এ প্রশাসনের তিন বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরে এসে কেন, তাঁদের উক্ত ব্যক্তিকে দোষারোপ করে আইন ভঙ্গ করতে হচ্ছে? যদি উক্ত ব্যক্তি অন্যায় আইন করেও থাকেন, তবুও তো তিনি আইন করে নিয়েই তবে কারোর কারোর সাথে অন্যায় করেছেন এবং এই বোর্ড মেম্বারগণরাই ওইসব আইন তৈরির সময়ে তাঁকে অনুমোদন বা সমর্থন দিয়েছিলেন (যাঁরা এখনও উভয় বোর্ডে অপরিবর্তিত আছেন আরকি!)।

কিন্তু এখনকার বোর্ড প্রধান ও বোর্ডের সভাসদগণ তো আইন পরিবর্তন করার পূর্বেই আইনভঙ্গ করে বেশ অনেকগুলো উদাহরণ সৃষ্টি করলেন। এটা ভারি অদ্ভুত নয়কি? আরও বৈসাদৃশ্যপূর্ণ দাবি হলো, মহামান্য রাষ্ট্রপতিও নাকি তাঁদের এমন খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্তকে মানতে পারেন! অবিশ্বাস্য ধৃষ্টতা প্রদর্শন করলেন না এই দাবি করে আমাদের মাননীয় রিজেন্ট বোর্ড সভাপতি? নিজেদের সিদ্ধান্তকে মানাতে স্বয়ং চ্যান্সেলরকেও বিতর্কিত করতে চাইলেন না? স্বয়ং চ্যান্সেলরও কি তিনি মনে করেন যে, আইনের ব্যত্যয় করে এরকম দূর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? এইসব অদ্ভুত দাবি শুধু হাস্যকরই নয়, বরং চূড়ান্ত পর্যায়ের দূর্ভাগ্যের! 

যাই হোক, শিক্ষকেরা নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো প্রতিবন্ধকতা তো অবশ্যই। কেননা আপনি কাউকে তাঁর ন্যায্য অধিকার থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করবেন, আবার উদ্ধত দেখিয়ে বলবেন তা মেনে নিতেই হবে এটা তো চূড়ান্ত অসভ্যতার নমুনা। এমনকি শিক্ষক-গবেষক হিসেবে কারোর অর্জনগুলোকে মূল্যায়ন না করে, বরং তাঁকে নানানভাবে (মানসিক, আর্থিক এবং সর্বোপরি তাঁর ক্যারিয়ার গ্রাফকে ইচ্ছাকৃত ঠেলে পেছনে দিয়ে দিবেন!) হয়রানি-হেনস্থার মুখোমুখি করবেন এবং এরপরও দাবি করবেন তিনি বা তাঁরা নিবেদিতপ্রাণ হয়ে অক্লান্ত সার্ভিস দিয়েই যাবেন, এটা বোধ হয় অসম্ভব একটা গর্হিত আবদার! ভেবে দেখুন!

(শিক্ষার্থীদের বলছি না। তাঁরা আমাদের অভিযোগ করতেই পারেন, কেননা এই পরিস্থিতি তাঁদের সৃষ্ট নয়। কিন্তু এই দাবি প্রশাসন বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা তো করতে পারে না। কেননা তাদেরই সৃষ্ট এইসব অন্যায়ের পাহাড়!) 

দ্বিতীয় অংশের আলোচনা-

দৃশ্যপট ০১:
একবার ভেবে দেখুন তো, নোবেল বিজয়ী Anne L' Huillier-র মতন শিক্ষক-গবেষক আমাদের এখানে কতটা প্রশংসিত হতেন? এরচেয়ে বেশি প্রশংসিত কি প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাশীল শিক্ষক-গবেষকরা হতেন না এদেশে? প্রমাণ চান, তাহলে বলুন তো আপনাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে কম-বেশি অনেকেই বিসিএস ক্যাডার হতে চান! এর মাঝে কতজন শিক্ষা ক্যাডারে যেতে চান? খুব বেশিসংখ্যক হবেন না। কেন চান না? কারণ এদেশে এই মুহুর্তে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডার ব্যতীত অন্যান্য ক্যাডারে ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ কম।

তাই আপনাদের পছন্দের শীর্ষে এই দু'টো ক্যাডারই বেশিরভাগের থাকে। অস্বীকার করার কি উপায় আছে? এটা দোষ না। ওইসব ক্যাডারের যেমন বেতন, শিক্ষা ক্যাডারেওতো একই বেতন। তাহলে এই মুহুর্তে কেন সারা দেশের শিক্ষা ক্যাডাররা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনে আছেন? বৈষম্য দূর হওয়ার আশাতেইতো? এমন বৈষম্য বিদ্যমান থাকলে কি নোবেল বিজয়ী কাউকে Anne L' Huillier-র শিক্ষার্থীরা পেত? তো শিক্ষকদেরই কেবল দায়িত্ব পালনের দায় আছে, আপনাদের শিক্ষার্থীদের কি রাষ্ট্রের বিদ্যামান বৈষম্য নিয়ে সোচ্চার হওয়া; কর্তব্যের পরিধিতে নেই? আপনারা কি এইসব ক্যাডারে আসবেন না অদূর ভবিষ্যতে? নাকি সবাই প্রশাসন আর পুলিশ ক্যাডারে যাবেন? কতজন যাবেন? 

মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামের বছর কি শিক্ষার্থীরা দেশের ক্রান্তিকালে এগিয়ে আসেনি? সার্টিফিকেটের জন্য ঘরের কোণে বসে ছিলো? অতিমারী করোনাকালীন কি শিক্ষার্থীরা সামাজিক দূরত্বের বেড়াজাল ছিঁড়ে মরণাপন্ন ব্যক্তির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি বা মৃত ব্যক্তির লাশের সৎকারে এগিয়ে আসেনি? যেখানে তাদের পরিবারও ভয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলো? শিক্ষার্থীরা যখন প্রশাসকদের ধামা ধরা হতে চায় আর নিজ শিক্ষকদের অসহায়ত্ব নিয়ে অবুঝের মতন মন্তব্য করে, অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করে তখন বুঝতে হবে সিস্টেমটা পাল্টাবে না। কেননা সিস্টেম কখনো বুড়োরা পাল্টাতে পারে না। নতুনের দিশারিরাই পালটায়।

দৃশ্যপট ০২-
ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিও তে ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, নোবেল বিজয়ের সংবাদ পাওয়ার পরেও শ্রেণিকক্ষে ফিরে বাকি পাঠদান সম্পন্ন করা Anne L' Huillier-কে অভিন্দিত করতে তাঁর শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমের বাইরে এসে হাততালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করছে। বিষয়টা অত্যন্ত অভিভূত ও আন্দোলিত হওয়ার মতন বিষয়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে কী হত? আমাদের শিক্ষার্থীরা ফুলেল শুভেচ্ছা আর ফেসবুকে অভিনন্দনের জোয়ার বইয়ে দিত। ঘর-দুয়ার তাদের মৌখিক তৈলমর্দনের তোড়ে এমনভাবে ভেসে যেত যে উক্ত শিক্ষক-গবেষক উক্ত পাম অয়েলের পিচ্ছিল রাস্তা ধরে আছাড় খেতে খেতে আর তাঁর গবেষণাগারের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতেন না।

একজন সত্যিকারের শিক্ষক-গবেষক পেতে চাইলে, শিক্ষার্থীদেরকেও তেমন নিবেদিতপ্রাণই হতে হয়। আপনারা কখনো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবদান নিয়ে গর্ব করে দেখেছেন? এখানকার শিক্ষকেরা সারা বাংলাদেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে সবচেয়ে বেশি মাত্রার  কাজের চাপ নিয়ে থাকেন। আর তাদের ভাতাদি সবার চেয়ে নিম্নে! খোঁজ নিন। অন্তত এটাতো সচোখেই অবলোকন করতে পারেন যে এমন বিভাগও আছে এখানে যেখানে ১-২-৩ জন শিক্ষক দিয়ে শত শত শিক্ষার্থীর পাঠদান ও তাঁদের নানাবিধ একাডেমিক-প্রশাসনিক প্রয়োজন সম্পন্ন করানো হচ্ছে।

এমনও বিভাগ আছে যেখানকার শিক্ষকদের প্রতি সেমিস্টারে ১৩-১৪ টা কোর্সের দায়িত্ব নিতে হয় এবং তা নামমাত্র পারিশ্রমিকে! এগুলোকে নিবেদিতপ্রাণ অক্লান্ত পরিশ্রমের কাতারে প্রশাসন ফেলে না তাদের স্বার্থে, কিন্তু আমরা তো আপনাদের শেখাই। আপনারা এসব দেখেও কীভাবে আমাদের নিয়ে অমূল্যায়ন করে অসংবেদনশীল মন্তব্য করেন ও এমন মন্তব্যগুলো সহ্য করেন? শিক্ষকেরা কি কখনো শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ হয় নাকি? শিক্ষকেরা দায়িত্বে অবহেলা করে না তা নয়, কিন্তু এই শিক্ষকেরাই যতটা দায়িত্ব পালন করেন এর বেশি আপনাদের জন্য দায়িত্ব কর্তব্য অন্য কোনো পেশার ব্যক্তিরা করে না। ভেবে দেখুন। 

একটা ঘটনার উল্লেখ করে আমার এই দীর্ঘ লেখা শেষ করছি। একবার এক প্রথিতযশা পণ্ডিত শিক্ষককে কাছে তাঁর একজন কনিষ্ঠ সহকর্মী এসে জানতে চাইলেন, "আপনি এত বড় পন্ডিত ও ভালো শিক্ষক কীভাবে হলেন? আমিও আপনার মতন হতে চাই।" এর প্রত্যুত্তরে উক্ত পণ্ডিত ব্যক্তি বলেছিলেন, "তোমার ভালো পন্ডিত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না।" 

ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পণ্ডিত শিক্ষক বললেন, "আমি যখন প্রথম প্রথম শিক্ষক হিসেবে শ্রেণিকক্ষে যেতাম, তখন এক শিক্ষার্থী আমাকে নানান প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করত, আমি তার প্রশ্নের সামনে নাজেহাল হয়ে পড়তাম। ভাবতাম এসব প্রশ্ন তাকে আমারই কোনো সহকর্মী শিখিয়ে পড়িয়ে দেন। একদিন তাকে ডেকে এ নিয়ে জানতে চাইলে, সে জানায় আমি নতুন শিক্ষক তাই আমার সাথে প্রতিযোগিতা করলে সে তার জ্ঞানের বহর সহজেই বাড়াতে পারবে। তাই সে ঠিক করেছিলো আমি যদি ২-৩ টা বই পড়ে ক্লাস নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আসি, তো সে আমাকে প্রশ্ন করার জন্য অন্তত ৫-৭ টা বই পড়ে ক্লাসে আসবে। এভাবেই সে আমাকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে জ্ঞানের রাজ্যে ঢুকতে চেয়েছে। আমার সেই ছাত্রটি হলো আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ। এখন তুমিই বলো, তোমার এমন কোনো শিক্ষার্থী কি আছে যে, তুমি আমার মতন ভালো শিক্ষক-গবেষক হবে?"

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ


সর্বশেষ সংবাদ