ভারত সীমান্তে জয় শ্রী-রামের জবাবে আল্লাহু আকবার স্লোগান— কী ঘটেছিল?
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:০৮ PM , আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:০৮ PM
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি অংশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে তিন দিন ধরে একরকম টানাপড়েন বা উত্তেজনার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতীয় অংশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিজিবি, বিএসএফ এবং দুই দেশের স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি দেখা দেয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তের বাংলাদেশ-ভারত দুই দিকেই গ্রামের মানুষজন জড়ো হয় সীমান্তরক্ষীদের সাথে। দুই দিকেরই বেশকিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা গিয়েছে বাংলাদেশ অংশে বেশি সংখ্যক লোকজন জড়ো হয়েছে, অন্যদিকে ভারত অংশে কিছু মানুষকে লাঠি রামদা, কাস্তের মতো অস্ত্র হাতে ‘বান্দে মাতরম’ স্লোগান দিতেও দেখা যায়। তবে এসব ভিডিওর সত্যতা এখনো যাচাই করা যায়নি।
কী ঘটেছিল?
সম্প্রতি চৌকা সীমান্তের ওপারে ভারতের মালদহ জেলার বৈষ্ণবনগর থানার সুকদেবপুর এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া জানান, সীমান্তের প্রায় ১২০০ গজ অংশে আগে কোনও কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। নতুন বেড়া নির্মাণের প্রস্তুতি হিসেবে ভারতের ভেতরে ১০০ গজ দূরত্বে মাটি খোঁড়ার কাজ চলছিল। বিজিবি থেকে এ নিয়ে আপত্তি জানানো হলে সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ রাখা হয়।
নিয়ম অনুযায়ী সীমান্ত লাইন থেকে দেড়শ গজের মধ্যে কিছু করা হলে সেটা অপর পাশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সঠিক নিয়ম মেনে অবহিত করতে হয় যেটা এক্ষেত্রে ভারতের বিএসএফ বাংলাদেশের বিজিবিকে জানায়নি বলে জানান লেফটেনেন্ট কর্নেল কিবরিয়া।
এ ঘটনায় দুই দফায় দুই দেশের বাহিনীর পতাকা-বৈঠক হলেও ফের নির্মাণকাজ শুরু করে বিএসএফ।
এ নিয়ে স্থানীয় দুজন সাংবাদিক জানান, মূলত গত মঙ্গল ও বুধবারে ব্যাপকহারে মানুষের জমায়েত বেড়ে যায় এবং একরকম উত্তেজনার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ভারতের দিকেও বিএসএফের সাথে সেখানকার স্থানীয় লোকজনও ছিল।
ভারতের অংশে তোলা কিছু ছবি ও ভিডিও পাঠান বাংলাদেশি অংশের স্থানীয় সাংবাদিক মো. কাওসার আহমেদ। সেখানে অনেকের হাতে রামদা দেখা গেলেও একরকম হাস্যরসাত্মক পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়। যেমন- একজন রামদা শানাচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে কেউ এলে কাটার জন্য শান দিচ্ছেন বলে হাসতে হাসতে জানান। আরেকজন কাঁধে বস্তা নিয়ে মশকরাচ্ছলে ভিডিওতে বলছেন, ‘বোম, বোম, বোম, ফুটিয়ে দেব বাংলাদেশকে।’
বাংলাদেশ অংশের মানুষের মধ্যে অবশ্য উৎসাহ উদ্দীপনার পাশাপাশি উৎকণ্ঠাও ছিল বলে জানান কাওসার আহমেদ।
তিনি বলেন, অপর পাশ থেকে ‘বন্দে মাতারাম’ ‘জয় শ্রীরাম’ এমন স্লোগান দেওয়া হচ্ছিলো, তখন এপারের মানুষ ‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার’ বলে জবাব দেয়।
এখানে বাংলাদেশ অংশে সীমান্ত ঘেঁষে যেসব কৃষকদের জমি রয়েছে তাদের মধ্যে শঙ্কার জায়গাটা বেশি।
‘ওরা যদি মেরে লাশটা তারের বেড়ায় ঝুলিয়ে দিয়ে যদি বলে তার কাটছিল, আমাদের কিচ্ছু বলার নাই,’ একজন এলাকাবাসীকে উদ্ধৃত করে বলেন এ সাংবাদিক।
সবশেষ সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ের সৌজন্য সাক্ষাতের পর বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে এবং এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক।
গতকাল বৃহস্পতিবার আর নির্মাণকাজ চালানো হয়নি বলে জানান ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া।
বিজিবির বেশ কয়েকজন জানান, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শূন্য রেখা বরাবর দুই দেশের অন্তত দেড়শ গজের মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হলে দুই দিকের সম্মতির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ-ভারতের ১৯৭৫ সালের নীতিমালা অনুযায়ী সীমান্ত লাইন নির্ধারিত হওয়ার পর লাইনের উভয় পাশে ১৫০ গজের মধ্যে কোনও পক্ষই স্থায়ী বা অস্থায়ী সীমান্ত রক্ষী বা সশস্ত্র কর্মী রাখবে না এবং উভয় পাশে ১৫০ গজের মধ্যে (মোট ৩০০ গজ এলাকায়) কোনও প্রতিরক্ষামূলক কাঠামো, যেমন পরিখা বা অন্যকিছু থাকলে সেগুলো ধ্বংস বা ভরাট করতে হবে।
যা বলছে বিএসএফ-বিজিবি
বিএসএফের একজন কর্মকর্তা জানান, বেড়া নির্মাণের কাজটি আগে থেকে অনুমোদন সাপেক্ষেই করা হয়েছে।
মঙ্গলবারে বিএসএফের সাউথ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি এবং মুখপাত্র এন কে পান্ডে জানান, তেমন কোনো সমস্যার কিছু না, আমাদের বেড়া নির্মাণের কাজ চলছে, যেটায় অপর পাশ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল যার জবাব দেওয়া হয়েছে, কাজের অগ্রগতি চলছে।
যদিও বৃহস্পতিবারে আর নির্মাণকাজ আর চালু করা হয়নি বলে জানানো হয়েছে বিজিবির দিক থেকে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, বারবার কাজ থামিয়েও আবার কেন চালু করা হলো, অথবা বিএসএফ যে অনুমোদনের কথা বলছে তা থাকলে সমস্যা হলো কেন?
এ বিষয়ে বিজিবি রাজশাহী ব্যাটালিয়নের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. ইমরান ইবনে আব্দুর রউফ জানান, এখানে অনুমোদন নিয়ে থাকলেও এক্ষেত্রে যে প্রটোকল বা নিয়মনীতি পালনের কথা সেগুলো মানা হয়নি। যারা মাঠে কাজ করেন তাদের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না এবং সাধারণত এমন সিদ্ধান্তগুলো ওপর পর্যায় থেকে আসতে হয়।
‘প্রথম দফায় মনে করেন কোম্পানি লেভেলে হয়েছে, আমি জানি এটা সমাধান হবে না। তারপর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেভেলে হলো, ওখানেও সমাধান হলো না। তারপর সন্ধ্যায় আমার সাথে সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে হলো। ওখানেও শেষ কথা এমন ছিল যে আমরা দুই পক্ষই অর্ডারবাউন্ড, আমাদের ওপর থেকে যে আদেশটা আসবে আমরা সেটাই করব। এই মুহূর্তে আমরা উত্তেজনা প্রশমনের জন্য যেটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে, সেটা আমরা দেব।’
সাধারণত কাজগুলো এভাবেই হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পতাকা বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘তারা বলছিল ২০১৬ সালে এরকম মিটিং হয়েছিল, অনুমোদন পেয়েছে, আমরা বলেছি ২০২১ সালের আমাদের একটা চিঠি আছে যেখানে আমরা বলেছি অনুমোদন হয়নি, জয়েন্ট সার্ভে করার জন্য, যেটা হয় এটা। এটার কোনও উত্তর দেওয়া হয়নি, এখন ২৫ এ এসে বানানো শুরু করে দেওয়া এটা কেমন কথা?’
নওগাঁর সীমান্তেও অনেকটা একই ধরনের বিষয় হয়েছে যেখানে বিএসএফের দিক থেকে পুরোনো অনুমোদনের কথা বলা হচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশের দিকে বিষয়টি মীমাংসিত না বলে উল্লেখ করেন আব্দুর রউফ।
নওগাঁয় কী হয়েছিল?
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঘটনার মতো একই সময়ে বুধবার নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার বস্তাবর সীমান্তের ওপারে বিএসএফের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে বাধা দিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
এনিয়ে নওগাঁর পত্নীতলার ১৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন জানান, নওগাঁর সীমান্তের বেশিরভাগ দিকেই কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও ৬০০ গজের মতো এলাকায় বেড়া নেই। আইন অনুযায়ী এ ধরনের কাঁটাতারের বেড়া সাধারণত শূন্য রেখা থেকে দেড়শ গজের বাইরে হয়।
তবে সেখানে কিছু ঘর-বাড়ির অবস্থান ঠিক রাখতে বিএসফ যেখানে নির্মাণ শুরু করেছে সেসব কিছু জায়গায় দেড়শ গজের ভেতরে চলে আসে বলে বিজিবি থেকে আপত্তি জানানো হয় বলে জানান কর্নেল হোসেন।
আগে থেকে এ বিষয়ে অবহিত না করেই সে এলাকায় গাছপালা কাটার এবং এক্সকাভেটর (খননযন্ত্র) দিয়ে মাটি কাটার কাজ শুরু করে দেয়া হয়। বাধা দেয়ার পর অবশ্য সেখানে কাজ বন্ধ করে সেসব মেশিন দেড়শ গজের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথাও জানানো হয়। সেখানে অবশ্য সীমান্তে জমায়েত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
শুক্রবারে কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে বৈঠক হওয়ার কথা, সেক্ষেত্রে সমাধান না হলে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে বৈঠক করা হবে।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার ৯ই জানুয়ারি বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বিএসএফের দক্ষিণ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারের আইজি এবং বিজিবির দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের আঞ্চলিক কমান্ডারের মধ্যে এক রুটিন অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে।
বৈঠকে সীমান্তে শান্তি এবং সমন্বয় বজায় রাখা, দুই সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, এমন পরস্পর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বিএসএফের তরফ থেকে বলা হচ্ছে।
এছাড়াও সীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধ, সীমান্ত এলাকায় চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম, অবৈধ পারাপার বন্ধ করা, এবং কার্যকর সীমান্ত পরিচালনা এবং দুই বাহিনীর সহযোগিতার মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার করার কথাও বলা হয়। [সূত্র: বিবিসি বাংলা]