‘মা, তুমি ভাত খাইছো তো?’, মৃত্যুর আগে শেষবারের মত বলেছিলেন ছেলে আরিফ
- মামুন হোসাইন, ভোলা প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩৮ AM , আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৪ PM
১৮ বছরের কিশোর শহীদ মো. আরিফ—একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের একমাত্র ছেলে, বাবা-মায়ের শেষ আশার আলো। পাঁচ বোনের আদরের ভাই আরিফ ছিল পরিবারের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। বাবা ইউসুফ মিয়া অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে দিন কাটালেও আরিফের পড়াশোনা বন্ধ হতে দেননি। মায়ের চোখে একটাই স্বপ্ন ছিল—তার ছেলে একদিন সংসারের হাল ধরবে, বাবা-মায়ের কষ্ট লাঘব করবে।
আরিফ লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার আলিম ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরিবারের অভাব দূর করতে গত জুলাই মাসে ঢাকায় মামাতো ভাইয়ের খাবার হোটেলে কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন ফোন করে মায়ের খোঁজ নিতেন, ছোট বোনদের পড়াশোনা নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন। মৃত্যুর আগের রাতেও শেষবারের জন্য মাকে বলেছিলেন, “মা, তুমি ভাত খাইছো তো?”
গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ১৮ বছরের কিশোর মো. আরিফ। ডান চোখের নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায় সেই গুলি। রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আরিফের মা-বাবার জীবনে নেমে এসেছে গভীর অন্ধকার। তাদের চোখে এখনো ভেসে ওঠে ছেলের হাসিমাখা মুখ। বুক ফাটা আর্তনাদ আর অশ্রুসিক্ত চোখে কাটছে তাদের প্রতিটি দিন।
আরিফের মা ফরিদা বেগম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একদিন কথা না কইলে ছেলেরও মন ভালো থাকতো না। আমার মনও খারাপ থাকতো। ছেলে কইতো মা তোমার লগে কথা না কইলে রাইতে আমার ঘুম আসে না। মৃত্যুর আগের দিন রাইতে ছেলের লগে কথা হইছে। ছেলে আমার খোঁজখবর নিছে, জিজ্ঞাসা করছে মা তুমি ভাত খাইছো? ছোট দুই বোন ঠিক মতো পড়ালেখা করে কি না সেই খোঁজও নিয়েছে।
নিহত আরিফের মা
এটাই ছিল ছেলের সঙ্গে শহীদ মো. আরিফের মা ফরিদা বেগমের শেষ কথা। এরপর দিন খবর আসে ছেলে আরিফ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। ছেলের এমন মৃত্যুর খবর বিশ্বাস করছিলেন না মা। ছেলের কথা কিছুতেই ভুলতে পারেন না মা ফরিদা বেগম। সন্তান হারানোর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও আজও কান্না থামেনি ফরিদা বেগমের। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তিনি পাগল প্রায়।
ফরিদা বেগম আরও বলেন, পাঁচ বোনের একমাত্র ভাই ছিল আরিফ। প্রতিদিন ফোন করে সবার বাসার খোঁজ নিতো। আরিফকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল সকলের। পড়ালেখা করে ভালো কিছু করবে এটাই ছিল সকলের আশা। পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফুটাবে। বাবা-মাকে নিয়ে ছেলেরও অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নের কথা মায়ের কাছে বলতেন আরিফ। তাদের জন্য পাকা ঘর করবেন। তাদের সেই ঘরে রাখবেন। কিন্তু সেটি আর হয়ে ওঠেনি।
তিনি ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেছেন। একই সঙ্গে যার নির্দেশে এতো মায়ের বুক খালি হয়েছে সেই শেখ হাসিনার বিচার দেখে মরতে চান মা ফরিদা বেগম।
শহীদ মো. আরিফের পিতা মো. ইউছুফ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল আরিফ। তার চিন্তায় একেবারে ভেঙে পড়েছি। ওর মা সারাক্ষণ কাঁদতে থাকে। অভাবের সংসারে পরিবারের হাল ধরতে তাকে ঢাকা পাঠানো হয়েছিল। সেখানে তার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে হোটেলে কাজ করতো। শেষ ঢাকায় যাওয়ার ১৭-১৮ দিন পর গুলিতে মারা যায়। আমি কোনোমতে কৃষিকাজ করে সন্তানগুলোকে বড় করেছি। সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হতো, সন্তানদের পড়াশোনার অনেক খরচ হতো।
নিহত আরিফের বাবা
এদিকে আমার দুই মেয়ে এখনো পড়াশোনা করে- সবমিলিয়ে আমি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। আমার ছয় সন্তানের মধ্যে আরিফ একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল। আমি চেয়েছিলাম আমার সন্তান ঢাকায় চাকরি করে আমাকে সহযোগিতা করবে, আমি কখনো ভাবিনি আমার সন্তান এভাবে হারিয়ে যাবে। এটা যদি জানতাম তাহলে আমার হাজার কষ্ট হলেও আমি তাকে ঢাকায় পাঠাতাম না। গ্রামে রেখেই আমি কাজ করে তাকে পড়াশোনা শেষ করাতাম। আরিফও চাইতো আমাদের সংসারের অভাব ঘোচাতে।
তিনি আরও বলেন, ওর মাকে কোনোভাবে বুঝাতে পারছি না; তাকে নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকতে হয়। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছে।
একমাত্র ছেলেকে নিয়ে পরিবারের সকলের অনেক আশা ভরসা ছিল। পড়ালেখা করে বড় হয়ে চাকুরি করে সকলের মুখে হাসি ফুটাবে। কিন্তু এর আগেই তাকে পরপারে চলে যেতে হলো। ‘ভবিষ্যতে আমাদের আশা ভরসা কিছু নেই। আমার আশা ছিল ছেলে আরিফকে ঘিরে। এখন আমরা মেয়েগুলো নিয়ে কি করবো জানি না। ওদের লেখাপড়াই বা কিভাবে করাবো সেটাও জানি না।
তিনি বলেন,আমিও বয়সের কারণে বিভিন্নভাবে অসুস্থ। আমি আর কামলা খাটতে পারি না। শরীরে এখন আর শক্তি পাই না। উপার্জন করার মতো ছেলে আরিফ-ই ছিলো আমার পরিবারের ভরসা, কিন্তু আমার পোলাডারে ওরা আর বাঁচতে দিল না।
যারা তাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে তাদের উপযুক্ত বিচার দাবি করেন বাবা ইউছুফ। তিনি জানান, জামায়াতে ইসলামী থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে কিছু অনুদান পেয়েছেন।
আন্দোলনে নিহত আরিফের বোনেরা জানায়, এখনো তাদের দুই বোন পড়াশোনা করছে। তাদের পড়াশোনা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এবার একজন এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। সরকার যদি পারে, তাকে একটি চাকরি দিলে পরিবারটা কোনোমতে চলে যেতো।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আরিফের মামাতো ভাই সাহাবুদ্দিন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) হোটেলের জন্য বাজার করতে গিয়ে যাত্রাবাড়িতে আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আমার ভাই আরিফ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। গুলি তার চোখের সামনে দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। সেখানে থাকা কিছু লোক খবর দেন আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে ভাইকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে চিকিৎসা না পেয়ে আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে নেয়ার পরে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, বিকাল তিনটার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। পরের দিন রাত নয়টায় তার মরদেহ হাসপাতাল থেকে গ্রামের বাড়ি ভোলাতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওর বাবা-মা এখনো কাঁদতে থাকে সন্তানের স্মৃতি নিয়ে। তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, কাকে নিয়ে থাকবে- সেই চিন্তা করে দিন-রাত পার করেন।
আরিফের শিক্ষক এবং সহপাঠীরা বলেন, আরিফ খুবই ভালো একজন শিক্ষার্থী ছিল। এলাকায় কোনো রাজনীতিও করতো না। পড়াশোনায় ভালো মনযোগী ছিলেন আর সংসারেই ছিল তার সবচেয়ে বেশি মনযোগ।